এক সময় সারাদেশে গড়ে ওঠে ডেসটিনি, যুবক, ইউনিপেসহ অসংখ্য মাল্টি লেভেল কোম্পানি (এমএলএম) ও সমবায় প্রতিষ্ঠান। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা কোম্পানিগুলো উচ্চসুদের প্রলোভন দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়। এখন অবশ্য ওইসব কোম্পানির দৌরাত্ম্য নেই। কিন্তু লাইসেন্সধারী বৈধ প্রতিষ্ঠানই জনগণের অর্থলুটের মচ্ছব শুরু করেছে। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থেকে লাইসেন্স নিয়ে দেদার আত্মসাৎ করছেন জনগণের টাকা।
রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমতাশালী এসব ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানে জমানো অর্থ ফেরত পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন আমানতকারীরা। দেশে বর্তমানে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যরত। এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় গ্রাহকরা ৪৭ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা জমা রেখেছেন। দু-একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের ক্ষেত্রে আমানতকারীদের মধ্যে কোনো ভীতি নেই। এর বাইরে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই আমানতকারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। গ্রাহক আকৃষ্ট করতে তারা ১২ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করেছেন, যখন ব্যাংকে অর্থ জমানোয় সুদহার ছিল ৬ শতাংশেরও কম। ইমেইল, মোবাইলে এসএমএস ও কল এবং সরাসরি দেখা করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা গ্রাহকদের প্রলুব্ধ করে আমানত সংগ্রহ করছেন।
যেসব প্রতিষ্ঠান এই প্রক্রিয়ায় উচ্চসুদে আমানত সংগ্রহ করেছে এখন তা ফেরত দিতে পারছে না। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ ধরনের অরাজকতা শুরুর পর গত বছর সার্কুলার জারি করে মোবাইলে এসএমএস ও কল দেওয়া নিষিদ্ধ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জনগণের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়ে বন্ধ হতে চলেছে পিপলস লিজিং নামে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৭ সালে কার্যক্রম শুরু করে পিপলস লিজিং। প্রতিষ্ঠানটির ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ৭৪৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। এ প্রতিষ্ঠানে আমানতকারীদের ২ হাজার ৩৬ কোটি টাকা জমা রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের আমানতকারী রফিকুল ইসলাম বলেন, পিপলস লিজিংয়ে এখন আমার ৯ কোটি টাকা রয়েছে।
শুধু এখানে নয়, আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ আরও অন্য লিজিং কোম্পানিতেও রয়েছে। কিন্তু এই রকম অবস্থা দেখে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোয়ও আমরা অর্থ উঠিয়ে নেওয়ার জন্য আবেদন করেছি। কিন্তু তারাও অর্থ দিতে পারছে না। সেই দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো আবার অবসায়ন হবে কিনা তা নিয়ে আমরা সন্দিহান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী অনিয়মের মাধ্যমে ৫৭০ কোটি টাকা বের করে নেন পিপলস লিজিংয়ের পরিচালকরা। এর বড় অংশই বের করা হয় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সামসুল আলামিন গ্রুপের নামে। গ্রুপের ২০ প্রতিষ্ঠান এবং কয়েকজন পরিচালকের নামে অনিয়ম করে বের করা হয় ১৪০ কোটি টাকা।
এ ছাড়া পরিচালক মতিউর রহমান, খবিরউদ্দিন, ইউসুফ ইসমাইল, বিশ্বজিৎ কুমার রায়ও নামে-বেনামে অর্থ বের করে নেন। পিপলসের সাবেক চেয়ারম্যান এম মোয়াজ্জেম হোসেন প্রতিষ্ঠানটির ১২৩ কোটি টাকার জমি নিজের নামে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি করে নিলেও পরে তা ছেড়ে দেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে এসব অনিয়ম বের হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি থেকে পরিচালক সামসুল আলামিন, নার্গিস আলামিন, হুমায়রা আলামিন ও খবিরউদ্দিনকে অপসারণ করা হয়। আর চেয়ারম্যান এম মোয়াজ্জেম হোসেন স্বেচ্ছায় পদ ছেড়ে দেন। মালিকদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে পিপলস লিজিংয়ের মতো আরও ১১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এগুলো হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), এফএএস ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফার্স্ট লিজ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, রিলায়েন্স ফিন্যান্স, ফারইস্ট ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, প্রাইম ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স, ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল এবং বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট। এই কোম্পানিগুলো থেকে অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না আমানতকারীরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে চরম ঝুঁকিপুর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে ‘রেডজোনে’রেখেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা জনগণের অর্থ আত্মসাতের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকাও আত্মসাৎ করেছেন। জাতীয় সংসদে প্রকাশিত তালিকা অনুসারে, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ৮৩৭ কোটি টাকা, এফএএস ফাইন্যান্স ৫০০ কোটি টাকা, পিপলস লিজিং ২৭৫ কোটি টাকা, বিআইএফসি ২০১ কোটি টাকা ও প্রাইম ফ্যাইন্যান্স বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান থেকে ২০৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না। এসব প্রতিষ্ঠানের এমডিরা জানান, এই মুহূর্তে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয়।
ঋণ ফেরত পাওয়া সাপেক্ষে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, আমানতকারীদের অর্থ দেখভালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেনি। এত প্রতিষ্ঠান এক সঙ্গে খারাপ হতে পারে না। অনিয়ম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পর্ষদ ভেঙে দিলে এত খারাপ অবস্থা হতো না। তবে পিপলস লিজিং বন্ধের সিদ্ধান্ত ভালো।
এতে সাময়িক ক্ষতি হলেও পুরো আর্থিক খাতের জন্য ভালো হবে। সবাই সচেতন হবে। সম্প্রতি গুলশানে ফাস ফাইন্যান্সের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, আমানতকারীরা অর্থের জন্য ভিড় করছেন। কিন্তু তাদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। আগের পরিচালক ঋণের নামে সব অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানের এমডি প্রীতিশ কুমার সরকার বলেন, পুরো খাতেই অর্থ সংকট চলছে। আমানতকারীরা অর্থ তুলে নিচ্ছেন, যার ফলে তহবিল সংকট পড়েছে। আগের দেওয়া ঋণ আদায় হচ্ছে না বলে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) ৯৫ শতাংশ ঋণ ও লিজই এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে। পাওনা টাকা ফেরত দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। এ প্রতিষ্ঠানের সাবেক চেয়ারম্যান বিকল্পধারা মহাসচিব মেজর মান্নান আত্মীয়স্বজনের নামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। এ প্রতিষ্ঠানে আমানতকারীরা অর্থ ফেরত পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
একই অবস্থা ইন্টারন্যাশাল লিজিংয়ের। চেষ্টা-তদবির করেও আমানতকারীরা অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না। একজন গ্রাহক জানান, তাদের কোম্পানির চেয়ারম্যান, পরিচালক ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের প্রায় ৪০ কোটি টাকা আমানত রাখা হয়। গত বছর থেকে চেষ্টা করেও কোনো অর্থ ফেরত দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। পিপলস লিজিংয়ের মতো অন্য যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংকট রয়েছে তাদের অবসায়ন করা হবে কিনা জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম জানান, আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের। এ জন্য যা যা দরকার আইন অনুযায়ী তাই ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের আশ্বস্ত করতে চাই তারা যেন কোনো বিপদে না পড়ে সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সজাগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সর্বমোট ৪৭ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকার আমানত রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ব্যাংক ও অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছে ১৮ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৬৬ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা; যার মধ্যে ৫ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে।