স্বদেশ ডেস্ক:
সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালের বিশ্বের ধনী দেশগুলোর তালিকা করেছে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত মাসিক ম্যাগাজিন গ্লোবাল ফাইন্যান্স। ক্রয়ক্ষমতার সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি) জিডিপির ভিত্তিতে ই তালিকা করা হয়েছে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন- শামস্ বিশ্বাস
সুইজারল্যান্ড
সুইজারল্যান্ডের পিপিপিতে মাথাপিছু জিডিপি ৬৭ হাজার ৬০০ ডলার। সুইজারল্যান্ডের ঘড়ি, ট্রেন ও চকলেটের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। অবশ্য সুইস ব্যাংকগুলো কালো টাকা নিরাপদের সংরক্ষণের জন্য কুখ্যাত। আল্পস পর্বতমালা ও প্রশস্ত হ্রদ সুইজারল্যান্ডকে অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যরূপে ভূষিত করেছে। বিশ্বের পর্যটকদের জন্য এটি বিশেষ আকর্ষণীয় একটি দেশ। পর্যটন তো আছেই, ভারী শিল্পের জন্যও বিখ্যাত দেশটি। কোটিপতির ঘনত্বের দিক থেকেও দেশটি সবার ওপরে। প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ৯ হাজার ৪২৮ জনই কোটিপতি। শীর্ষ ধনী দেশের একটি হয়েও কোভিড ১৯-এর প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পায়নি দেশটি। সুইজারল্যান্ডের উৎপাদন কমেছে ৭ শতাংশ।
কাতার
কাতার একটি উত্তপ্ত ও শুষ্ক মরু এলাকা। বেশিরভাগ লোক শহরে, বিশেষত রাজধানী দোহা শহরে বাস করে। দেশটিতে খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বড় মজুদ আছে। এই প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে দেশটির অর্থনীতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে আল-থানি গোত্রের লোকজন কাতার অঞ্চলটিকে একটি আমিরাত হিসেবে শাসন করে আসছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে দেশটি ব্রিটিশ শাসনের অধীন আসে। ১৯৭১ সালে এটি পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্তও এটি একটি তুলনামূলকভাবে দরিদ্র দেশ ছিল। ওই সময় দেশটিতে পেট্রোলিয়ামের মজুদ আবিষ্কৃত ও তা উত্তোলন শুরু হয়। ২০ বছর ধরে বিশ্বে শীর্ষ ধনী দেশ কাতার। ২০১৪ সালের পর থেকে কাতারের অধিবাসীর মাথাপিছু আয় প্রতিবছর কমছে ১৫ হাজার ডলার। এর পরও পিপিপি জিডিপিতে পারস্য উপসাগরের দেশটির মাথাপিছু আয় ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯০০ ডলার। ২৮ লাখ অধিবাসীর দেশ কাতারের স্থানীয় মাত্র ১২ শতাংশ।
ম্যাকাউ
গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের দুটি বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চলের একটি ম্যাকাউ। আরেকটি হলো হংকং। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ম্যাকাউ পর্তুগিজ শাসনাধীন ছিল। এটি ছিল চীনে সর্বশেষ ইউরোপীয় কলোনি। চীনা-পর্তুগিজ যৌথ ঘোষণা ও ম্যাকাউয়ের মৌলিক নীতি অনুসারে ২০৪৯ সাল পর্যন্ত এটি বিশেষ সার্বভৌম ক্ষমতা ভোগ করবে। এশিয়ার জুয়ার রাজধানী বলা হয় ম্যাকাউকে। এখানে ৪০টির বেশি ক্যাসিনো আছে। করোনার কারণে ক্যাসিনো বন্ধ ছিল। গত জুলাই থেকে আবার খুলে দেওয়া হয়েছে। ৬ লাখ জনসংখ্যার ম্যাকাউয়ের পিপিপি জিডিপিতে মাথাপিছু আয় ১ লাখ ১৪ হাজার ৩৬২ ডলার। শিগগিরই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সিঙ্গাপুর
১৯৬৫ সালে স্বাধীনতা লাভের আগে সিঙ্গাপুর ব্রিটিশদের অধীন একটি ‘ক্রাউন কলোনি’ ছিল। স্বাধীন হওয়ার সময় দেশটির তেমন কিছুই ছিল না। স্বাধীনতা লাভের বছরে এই দেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৫১৬ মার্কিন ডলার। এই ৫১৬ মার্কিন ডলার ছিল তখন পূর্ব এশিয়ার মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ। স্বাধীনতার পর ইউরোপ থেকে বিনিয়োগ আসার মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি ধীরে ধীরে শক্তিশালী হওয়া শুরু করে। আশির দশকের মাঝখান দিকে এ দেশটি উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে। পিপিপি জিডিপিতে এ দেশের মাথাপিছু আয় ১ লাখ ৫ হাজার ৭০০ ডলার। এশিয়ার অন্যতম করের স্বর্গরাজ্য বা ট্যাক্স হ্যাভেনের এই দেশে অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করা হয় না। করও ধরতে গেলে খুবই কম। এ জন্য অনেকেই সিঙ্গাপুরের মতো ছোট্ট এ দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসে আগ্রহী। সিঙ্গাপুর প্রশাসন সমুদ্রতলের মাটি, পর্বত ও অন্যান্য দেশ থেকে মাটি সংগ্রহ করে দেশটির স্থলভাগের আয়তন বৃদ্ধি করে চলেছে। ষাটের দশকে দেশটির আয়তন ছিল প্রায় ৫৮২ বর্গকিলোমিটার। বর্তমান এটি ৬৯৯ বর্গকিলোমিটার এবং ২০৩৩ সাল নাগাদ এর পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে আরও ১০০ বর্গকিলোমিটার।
আয়ারল্যান্ড
কোভিড ১৯-এর আগে ব্রেক্সিট, বাণিজ্যযুদ্ধ, উদ্বাস্তুসহ নানা সমস্যায় যখন ইউরোপ ছিল জর্জরিত, তখনো উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের দ্বীপরাষ্ট্র আয়ারল্যান্ড ছিল সব কিছুর ঊর্ধ্বে। পুরো ইউরোপের প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ২ শতাংশ। আর আয়ারল্যান্ডের সাড়ে ৫ শতাংশ। মাত্র ৫০ লাখ মানুষের দেশটি শুরুতে অবশ্য বিপদেই পড়ে গিয়েছিল করোনার কারণে। কিন্তু বেতন কমানো, ব্যাংক খাতের সংস্কার ও কিছু আর্থিক সিদ্ধান্তের কারণে সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে উঠছে। আয়ারল্যান্ডের পিপিপিতে মাথাপিছু জিডিপি ৮৭ হাজার ডলার। আধুনিক সার্বভৌম রাষ্ট্রটি আয়ারল্যান্ড দ্বীপের পাঁচ-ষষ্ঠাংশ নিয়ে গঠিত। তা ১৯২১ সালের ৩ মে যুক্তরাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রথমে আইরিশ ফ্রি স্টেট এবং পরে প্রজাতন্ত্রী আয়ারল্যান্ড গঠন করে। আয়ারল্যান্ডের আয়তন মাত্র ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এ দেশের লোক সারাবছরে একনাগাড়ে সাত দিন সূর্য দেখার সুযোগ পায় না।
ব্রুনাই দারুস সালাম
সাড়ে চার লাখ অধিবাসীর এই দেশে ৪০ শতাংশের বেশি মানুষের আয় বছরে এক হাজার ডলারের কম। আবার আয়ের বৈষম্য ও পুষ্টিহীনতাও প্রকট। এর পরও পিপিপি জিডিপিতে এ দেশের মাথাপিছু আয় ৮৫ হাজার ডলার। তেলসহ বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে দেশটির। কেভিড ১৯-এ শুরুতে আক্রান্ত হলেও এখন প্রায় মুক্ত। ব্রুনাইয়ের রাজনীতি একটি পরম রাজতন্ত্র কাঠামোয় সংঘটিত হয়। ব্রুনাইয়ের সুলতান হলেন একাধারে রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধান। সরকারের হাতে নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত। ১৯৫৯ সালের সংবিধান অনুযায়ী পাদুকা সেরি বাগিন্দা সুলতান হাজি হাসানাল বোলকিয়াহ মুইজাদ্দিন ওয়াদ্দাউল্লাহ হলেন দেশের প্রধান। ষাটের দশকে একটি বিপ্লবের পর থেকে ব্রুনাইয়ে মার্শাল ল’ জারি হয়ে আছে। ষাটের দশকের শেষ দিকে এটি এই অঞ্চলের একমাত্র দেশ হিসেবে ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৮৪ সালে এসে দেশটি স্বাধীন হয়।
কুয়েত
১৯৩৪ সালে প্রথম মরুভূমির এই দেশে খনিজ তেল পাওয়া গিয়েছিল। ওই শুরু কুয়েতের উত্থান। বিশ্বের মোট তেলের ৬ শতাংশই কুয়েতের। কুয়েতের জিডিপির ৪০ শতাংশ আসে তেল থেকে। রপ্তানির ৯০ শতাংশই তেল। কুয়েতের পিপিপি ডলারে মাথাপিছু জিডিপি ৬৭ হাজার ৯০০ ডলার। কুয়েতের জনসংখ্যা মাত্র ৪১ লাখ। এর ৩০ লাখই অভিবাসী। তেলের দাম কমে যাওয়ায় কুয়েত অবশ্য ২০১৫ সাল থেকেই বিপদে আছে। কুয়েতের অর্থনীতি হচ্ছে একটি ছোট পেট্রোলিয়ামভিত্তিক অর্থনীতি। কুয়েতি দিনার বিশ্বের মুদ্রাগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যবান একক।
সংযুক্ত আরব আমিরাত
মধ্যপ্রাচ্যের সাতটি স্বাধীন রাষ্ট্রের একটি ফেডারেশন ‘সংযুক্ত আরব আমিরাত’। ১৯৭১ সালে দেশগুলো স্বাধীনতা লাভ করে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাতটি আমিরাতের নাম হলো আবুধাবি, আজমান, দুবাই, আল ফুজাইরাহ, রাআস আল খাইমাহ, আশ শারজাহ ও উম্ম আল কাইওয়াইন। আবুধাবি শহর ফেডারেশনের রাজধানী ও দুবাই দেশের বৃহত্তম শহর। শুরুতে দেশটি নির্ভরশীল ছিল কৃষি, মাছ ধরা ও মুক্তার ওপর। ১৯৫০ সালে তেল আবিষ্কারের পর থেকে বদলে যায় পুরো দেশটি। এখন অবশ্য দেশটির কেবল তেলের ওপর একক নির্ভরশীলতা নেই। বাণিজ্য, নির্মাণ ও পর্যটন থেকেও দেশটির আয় আছে। কোভিডের কারণে এবার দুবাই ওয়ার্ল্ড এক্সপো করতে পারছে না। এটি একটি বড় ধাক্কা। এই এক্সপোয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আড়াই কোটি মানুষ অংশ নেয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতের পিপিপিতে মাথাপিছু জিডিপি ৭০ হাজার ৪০০ ডলার।
লুক্সেমবার্গ
ইউরোপ মহাদেশের ক্ষুদ্রায়তন রাষ্ট্রের রাজধানীর নামও লুক্সেমবার্গ। বিশ্বের অন্যতম ট্যাক্স হ্যাভেন বা করস্বর্গ লুক্সেমবার্গ। এমন অনেকেই আছেন দেশটিতে যান, একটি ব্যাংক হিসাব খোলেন। তার পর আর যাওয়ার প্রয়োজনই হয় না। ২০১৫ সালে প্রথম দেশটির মাথাপিছু আয় এক লাখ ডলার অতিক্রম করে। এর পর আর তাদের পেছন ফিরতে হয়নি। এমনকি মহামারীতে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাদের আয় খুব একটা কমবে না। লুক্সেমবার্গের পিপিপি জিডিপি মাথাপিছু আয় ১ লাখ ১২ হাজার ডলার। সর্বোচ্চ মানের জীবনযাপনের দেশ লুক্সেমবার্গ। বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায়।
নরওয়ে
১৯৬০ সালে এখানে তেল আবিষ্কার হয়। যতদিন পর্যন্ত জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছিল, ততদিন দেশটির সমৃদ্ধি কেবলই বেড়েছে। এখন যে খুব বিপদে আছে, তাও নয়। পিপিপিতে মাথাপিছু আয় ৭৯ হাজার ৬০০ ডলার। আয়ের বৈষম্যের দিক থেকে উত্তর ইউরোপের স্ক্যান্ডিনেভিয়ার পশ্চিম অংশে অবস্থিত নরওয়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে। নরওয়ে ইউরোপের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন জনঘনত্বের রাষ্ট্র। ৫৪ লাখ জনসংখ্যার এ দেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৬ দশমিক ৫৩ ব্যক্তির বাস। নরওয়ে বছরের আট মাস বরফের নিচে ঢাকা থাকে। বছরের দুই মাস এখানে সূর্য ওঠে না।