সৌমিত্র দস্তিদার, কলকাতা থেকে:
বিশিষ্ট সাংবাদিক নিখিল চক্রবর্তী সখেদে বলেছিলেন– দেশভাগ, মহাত্মা গান্ধীকে খুন করার পর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্যতম কালো দিন।
কোনো কোনো সকাল নিঃসন্দেহে রাতের চেয়েও অন্ধকার। ৬ ডিসেম্বর দিনটিও তেমনি। ঘুম থেকে উঠেই মনে পড়ে গেল ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের এমন দিনেই অন্ধকার নেমে এসেছিল ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে। ভোরের কলকাতা কিন্তু সেভাবে কোনো অঁাচ পায়নি কী হতে চলেছে আগামী চব্বিশ ঘণ্টা। অন্যান্য দিনের মতোই স্বাভাবিক ছন্দে শুরু হয়েছিল শহরের জীবন। শব্দ করে বাস চলে যাচ্ছে রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে। ছুটির দিন। রবিবার। বাজার অন্যান্য দিনের চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই জমজমাট। মাংসের দোকানে লম্বা লাইন। ছোট বাচ্চাদের হাত ধরে বাবা-মায়েরা চিড়িয়াখানায় বা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল ঘুরতে যাচ্ছেন। এ সময় এদিকে পিকনিকে যাওয়ার ঢল নামে। সেজেগুজে গাড়ি বা ট্রাকে করে লোকজন। হইচই করতে করতে একটু দূরে কোথাও চলেছেন পিকনিকে। ধরে নেওয়া যায় ভারতের অন্য শহরের জীবনও চেনা ছন্দেই শুরু হয়েছিল। করসেবকদের জমায়েত নিয়ে কিছু মহলে চাপা একটা উদ্বেগ থাকলেও সাধারণ জনমনে সে ধরনের কোনো উদ্বেগ চোখে পড়েনি।
সেস্নাগান একটা উঠছিল বটে– মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে। রথযাত্রা চলছিল অযোধ্যার ‘রাম জন্মভূমি’ ফেরানোর দাবিতে। লালকৃষ্ণ আদভানির রথযাত্রার দাপটে সংখ্যালঘু মহল্লায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত উদ্বেগ ও সংঘর্ষের খবরও আসছিল। কিন্তু তখনো সাধারণ মননে সাম্প্রদায়িকতা আজকের মতো এমন গভীরভাবে ঢোকেনি। দেশভাগের আগে পরের মতোই এখন যে বিভাজন ও বিদ্বেষ এ দেশে ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে, ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে তা অত ভয়ংকর চেহারা নেয়নি। ফলে ঈশান কোণে যে কালো মেঘ জমছে, আমরা সাধারণ মানুষ তা টের পাইনি বা হতে পারে আমরা গুরুত্ব দিইনি।
অদ্ভzত এরই পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে চমৎকার সাদৃশ রয়েছে ১৯৩০ সালের জার্মানির। রাইখস্টাইগে, দেশের সংসদ ভবনে নিজেরাই আগুন লাগিয়ে ধীরে ধীরে ক্ষমতা দখলের পথে পৌঁছে যাচ্ছে হিটলারের জার্মানি, সেখানকার সাধারণ লোক টেরও পায়নি। মধ্যবিত্তের বড় অংশ তখন এক দেশ, এক নেতা এক পতাকার স্বপ্নে মুগ্ধ। চরম উগ্র জাতীয়তাবাদের হাওয়া আস্তে আস্তে সাইক্লোনের গতি পাচ্ছে। দেয়ালে দেয়ালে বিপর্যস্ত অর্থনীতির জার্মানিতে কাঁচা হাতে লেখা হচ্ছে– হিটলার তুমি আমাদের রুটি দাও; না হলে আমরা আবার কমিউনিস্ট হয়ে যাব।
কিন্তু ওই যে, এতসব হাড় হিম চিত্রনাট্য যে গোপনে তৈরি হচ্ছে, তা টেরও পাননি জার্মান জনতার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। ঈশান কোণে জমা মেঘ কখন যে জীবন ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, কজন আর তা আগাম বুঝতে পারবে! তেমনি ভারতীয় জনতার বিপুলসংখ্যক মানুষও ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের সকালে বোঝেনি উত্তর প্রদেশের ছোট্ট শহরে কোন নাটক অভিনীত হতে চলেছে। কথায় বলে ভোর দেখলে বাকি দিন কেমন যাবে তা আন্দাজ করা যায়। কিন্তু ওই যে বললাম, ঈশান কোণের দিকে কেউ ভালো করে তাকায়নি। অথচ বিপদ যে আসতে চলেছে তার আভাস কিন্তু ছিলই।
বস্তুতপক্ষে ১৯৯১-৯২ সাল ভারতীয় রাজনীতির সন্ধিক্ষণ। বলা যায় যে, ওই সময় এ দেশের রাজনীতি তার চিরাচরিত পথ ছেড়ে সম্পূর্ণ অন্য এক নতুন পথে পা দিল। নেহরু ও ইন্দিরা ঘরানার সমাজতন্ত্রের, রাশিয়ার অর্থনৈতিক মডেলের অনুসরণে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বদলে আজ যে বিলগ্নীকরণ বা দক্ষিণপন্থি বহুজাতিক পুঁজির ব্যক্তি-মালিকানানির্ভর অর্থনীতি এ দেশে কায়েম হয়েছে, তার সূচনা কিন্তু ১৯৯১ সালে এবং অবশ্যই কংগ্রেস আমলেই। তত দিনে নেহরু জমানার মূল্যবোধ ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় প্রধানমন্ত্রী, নেহরু পরিবারের বাইরের এক দক্ষিণী ব্রাহ্মণ পিভি নরসীমা রাও।
বড় কোনো ঘটনা ঘটলেই আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে বিজেপি, কংগ্রেস, বামপন্থি রাজনীতি কিংবা ছোট আঞ্চলিক দলগুলো নিয়ে। অথচ লড়াইটা কিন্তু শুধু দলের নয়। টানাপড়েন এলে দক্ষিণপন্থা বনাম বামপথ। দেশের ফেডারেল কাঠামো না অতি-কেন্দ্রীকতা। মুক্তবাজার অর্থনীতি বনাম সরকার নিয়ন্ত্রিত ওয়েলফেয়ার অর্থনীতি। গণতন্ত্র না একদলীয় শাসন। ধর্মনিরপেক্ষ নীতি বা হিন্দুরাষ্ট্র।
ভারত রাষ্ট্রের নীতি নিয়ে গবেষণা করলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে, শুধু আজ নয়, দেশভাগের আগে থেকেই আমাদের রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারক নেতাদের মধ্যকার এই পারস্পরিক চিন্তার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে দেশ কোন পথে চলবে তার দিকনির্দেশ। দেশভাগের আগে হিন্দু মহাসভা বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ যেমন ঘোষিত চরম হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ছিল, তেমনি জাতীয় কংগ্রেসের ভেতরেও প্রভাব ছিল দক্ষিণপন্থি রাজনীতির।
শেষ দিকে দক্ষিণপন্থিদের আক্রমণে মৌলানা আজাদ, এমনকি গান্ধী নেহরুকেও কোণঠাসা হতে হয়েছিল। দেশভাগের পরও জওয়াহেরলাল নেহরুকে তার সমাজতন্ত্রের প্রতি অন্তত মৌখিক ভাবালুতা আটকাতে একটা সময় দলের কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছিল কট্টর হিন্দুত্ববাদী বল্লভ ভাই প্যাটেলের ঘনিষ্ঠ পুরুষত্বম দাস ট্যান্ডনকে।
ফলে এই দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যই ভারতীয় রাজনীতির চালিকাশক্তি। নাম যাই হোক, আলাদা আলাদা দল হলেও মূল দ্বন্দ্ব আদর্শগত। এখন যা সরাসরি সামনে এসে গেছে নতুন করে। দেশের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি ফের চ্যালেঞ্জের মুখে। বিজেপি ও সংঘ পরিবারের দীর্ঘদিনের ঘোষিত লক্ষ্য হিন্দুরাষ্ট্র। এখন তা প্রায় প্রকাশ্যে এসেছে। তার সূচনা কিন্তু বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়েই।
ইন্দিরা গান্ধীকেও বুঝতে হয়েছিল প্রবল পরাক্রমশালী কংগ্রেসের পুরনো, পিতৃতান্ত্রিক, সামন্তবাদী মানসিকতার সিন্ডিকেট গোষ্ঠীর সঙ্গে।
আদভানির ঘড়ঘড় রথের আওয়াজ যখন ভারতে দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে, তখন দেশের দূরদর্শনের মারফত ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে রামায়ণের জানা-অজানা নানা দৃশ্য। প্রবল শক্তিশালী প্রযুক্তি জনমনে চারিয়ে দিচ্ছে লৌকিক-অলৌকিক রামকথা। নির্মিত হচ্ছে রামচন্দ্রের এক বিশাল কল্পিত আখ্যান। যে গাঁথায় শম্বুকের কোনো অস্তিত্ব নেই। সীতার অবমাননা যেখানে গৌণ। আর্য-অনার্য দ্বন্দ্বের নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা টিভি চ্যানেলের রামায়ণে পুরোপুরি অদৃশ্য। এই রামচন্দ্র বাল্মীকি বা তুলসী দাসের যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি একটি বিশেষ মতাদর্শের। যারা রামচন্দ্রকে সামনে রেখে নিজেদের বহু কাঙ্ক্ষিত হিন্দুরাষ্ট্র, আসলে যা বহুত্ববাদী হিন্দুত্ব নয়, মনুবাদী চিন্তার আধার, কায়েম করতে জন্মলগ্ন থেকে সক্রিয়– এ রাম সম্পূর্ণ তাদের।
আগেও বলেছি, যে সংঘ পরিবারের মস্ত গুণ তারা নিজেদের ঘোষিত নীতি থেকে কখনো একচুলও সরেনি। লেনিনের এক পা এগোনো এক পা পেছানোর শিক্ষা সঠিকভাবে মেনে পা ফেলার কৃতিত্ব কিন্তু আজকের ভারতের শাসকদের দিতেই হবে।
আমরা সাতাশ-আটাশ বছর আগে এসব খেয়াল করিনি। বামপন্থিরাও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লড়াই মূলত সংহত করেছিলেন আইনসভার চৌহদ্দির ভেতরে। রাস্তায় নেমে যে দক্ষিণপন্থি রাজনীতিকে ঠেকাতে হয় তা বামদের বড় অংশ ভুলে গিয়েছিল। তারা যখন ভাষণ সেমিনারে ব্যস্ত, আরএসএস তখন নীরবে, নিঃশব্দে গোপনে গোপনে সংগঠন গড়ে নিজেদের এজেন্ডা পৌঁছে দিয়েছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে। এক আরএসএসের কত মুখ। কোনোটা বনবাসীদের সেবায় নিবেদিত, কোনোটি আবার গ্রামে গ্রামে সরস্বতী স্কুলের মধ্য দিয়ে নিবিড় জনসংযোগ করে চলেছে বছরের পর বছর। পাশাপাশি তাত্ত্বিক ভিত্তি নির্মাণে দিনের পর দিন ঘাম ঝরিয়েছে সংঘ পরিবার।
সামাজিক পরিসরে হিন্দুত্ববাদ জায়গা পেয়েছে বলেই একদা যা ছিল সুপ্ত, গোপন এখন তাই প্রবল বিক্রমে সামনে এসে মেরুকরণের রাজনীতিকে চ্যাম্পিয়ন করতে উঠেপড়ে লেগেছে। তাই বাবরি মসজিদ ধ্বংস, গুজরাট গণহত্যা, আজকের ঘুষপেটিয়া ইস্যু, এনআরসি, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বিলোপ– কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। একটার সঙ্গে অন্যটির গভীর যোগ আছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে যে হিন্দুরাষ্ট্রের বীজ রোপণ, আজ এত দিনে তা মহীরুহের চেহারা নিয়েছে।
এত দিন বাদেও সেই অভিশপ্ত ৬ ডিসেম্বর মনে আছে। আমার মেয়ে তখন কত ছোট্ট। দাদাঠাকুমার কোলে করে কোথায় যেন বেড়াতে গিয়েছিল। বেলার দিকে সুপরিকল্পিতভাবে সাড়ে চারশ বছরের প্রাচীন স্থাপত্যে ভেঙে দেওয়া হলো। দুপুর দুপুর খবরটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তেই ভারত উপমহাদেশের জায়গায় জায়গায় অশান্তির আগুন জ্বলে উঠল। এপারের প্রতিক্রিয়ায়, পরে শুনেছি ওপারের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপরও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত দাঙ্গা-হাঙ্গামা ব্যাপক চেহারা নিয়েছিল। কিন্তু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষজনের চেষ্টায় তা মাত্রাছাড়া হয়নি।
নিমেষে কলকাতায় অঘোষিত কারফিউ জারি হলো। বাস ট্রাম প্রায় বন্ধ। মেয়ে ফিরে আসাতে শান্তি। টিভিতে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ঠাণ্ডা অথচ কঠিন গলায় দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি আজও মনে আছে। মধ্য কলকাতার হরিজন বস্তি, পাটোয়ারী বাগান, মালপাড়া, পার্কসার্কাস, মেটেবুরুজ, খিদিরপুর, মোমিনপুর সর্বত্রই পুলিশ আধাসামরিক বাহিনীর পাশাপাশি ছোটখাটো উত্তেজনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে বামপন্থি তরুণদের সক্রিয় ভূমিকা ভোলার নয়।
বাবরি মসজিদ ধ্বংস নিছক এক সম্প্রদায়ের অধিকার কেড়ে নেওয়া নয়। এ গণতন্ত্রের ওপর এক বড় আঘাত। এখন কোর্টের রায় যাই বলুক, এটা পরিষ্কার যে, বাবরি মসজিদ ধ্বংস সত্যি সত্যিই এক বিশাল ঝাঁকি। আধিপত্যবাদী রাজনীতির সূচনাপর্ব। এখন দেখা, শেষ অবধি কে জিতবে! দেশের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি না হিন্দুত্ববাদ। রাস্তায় রাস্তায় এখন মিছিলে মিছিলে দৃপ্ত সেস্নাগান কানে আসছে। ভেসে আসছে টুকরো টুকরো কবিতার লাইন– এ মিছিল এত নিষ্প্রাণ কেন, প্রাণ দিয়ে যাও, প্রাণ দিয়ে যাও। জলধারা যদি রুদ্ধ আজিকে, ঝরনা তাহলে গান দিয়ে যাও। দেখতে দেখতে কখন যে ৭ ডিসেম্বর এসে গেছে টেরও পাইনি।
লেখক : ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা