স্বদেশ ডেস্ক:
একটি ঐতিহাসিক বছর পার করল বাংলাদেশ। যে ইতিহাস কেবল এই ব-দ্বীপেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, অবাক বিস্ময়ে দেখেছে গোটা বিশ্ব। ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত বিরল গণ-অভ্যুত্থান বছরটিকে চিনিয়েছে নতুনভাবে। বিদায় নিয়েছে কঠিন স্বৈরাচার। যে স্বৈরাচারের বিদায়ঘণ্টা বাজানো পাঁচ মাস আগেই ছিল কল্পনাতীত, অসম্ভব। কেউ কেউ বলতো আমৃত্যু থাকবেন তিনি। কিন্তু নিয়তির অমোঘ নিয়মে পরিণতি হয়েছে তার নিদারুণ। পালিয়ে বিদায় নিয়েছেন শেখ হাসিনা। এই কর্তৃত্ববাদীর বিদায়ে ছাপিয়ে গেছে বছরের অন্যসব অর্জন কিংবা বিসর্জন। বছরের শুরুতে একতরফা নির্বাচনের পর মাঝামাঝিতে এসে হঠাৎ করেই ক্ষমতার স্বাদ রূপ নেয় বিস্বাদে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গুলি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় হাজারো যুবক। ফলাফল, বাংলাদেশ ফিরে পায় নব-স্বাধীনতার সুখ।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২৪ সাল। গত কয়েকটি নির্বাচনের মতো এটিও আলোচনায় ছিল দেশ গড়িয়ে বিশ্বজুড়ে। সাজানো ‘ডামি নির্বাচনে’ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সংসদে শপথ নিয়েছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনকে একপক্ষীয় ও পাতানো বলে উল্লেখ করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি)। টিআইবির মতে, ওই নির্বাচনের শেষের এক ঘণ্টায় ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ ভোট পড়েছে। সংস্থাটির মতে, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক দেখাতে নিজদলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে ভোট করলেও বেশির ভাগ আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। অন্তত ২৪১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি। নির্বাচনের এমন প্রক্রিয়া গণতন্ত্রের জন্য অশনিসঙ্কেত- বলেছিল টিআইবি। বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলোর নির্বাচন বর্জনের প্রেক্ষাপটে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও উৎসবমুখর দেখাতে ক্ষমতাসীন দল ওই নির্বাচনের আগে বিবিধ কৌশল গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর চেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী বেশি ছিলেন। ২৬৬ জন দলীয় প্রার্থীর বিপরীতে স্বতন্ত্র ছিলেন ২৬৯ জন। ভোটের দিন স্বল্প ভোটারের আগমন এবং ডামি লাইন তৈরি করে বিভিন্ন আসনে অন্য দলের প্রার্থীর এজেন্ট বের করে দেয়া হয়। ভোটের আগে ব্যালটে সিল মারা, ভোট চলাকালে প্রকাশ্যে সিল মারাসহ আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনিয়মের অভিযোগ ছিল নির্র্বাচনের পরতে পরতে।
কোটা-প্রথা পুনর্বহাল : পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সমতার ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কোটা-সুবিধা দেয়া হয়েছিল; কিন্তু ৫৬ শতাংশ কোটা ও ব্যাপক দুর্নীতির কারণে মেধাবী শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় ভালো করেও সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে পারতেন না। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলনের পর ২০১৮ সালে প্রথম কোটা-প্রথা বাতিল করে দেন তৎকালীন স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। সরকারি চাকরিতে আগের মতোই কোটা-প্রথা পুনর্বহাল করা হয়। ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ কোটা-পদ্ধতি বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। রায়ে বলা হয়, ২০১২ সালে করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেয়া রায় ও আদেশ, ২০১৩ সালের লিভ টু আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের তা বহাল ও সংশোধিত আদেশ এবং ২০১১ সালের ১৬ জানুয়ারির অফিস আদেশের (মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনীর কোটা) আলোকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনীদের জন্য কোটা পুনর্বহাল করতে সরকারকে নির্দেশ দেয়া হলো। একই সাথে জেলা, নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, উপজাতি-ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য কোটা-সহ, যদি অন্যান্য থাকে, কোটা বজায় রাখতে হবে। এ বিষয়ে যত দ্রুত সম্ভব আদেশ পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে পরিপত্র জারি করতে নির্দেশ দেয়া হলো।
শুরু হয় আন্দোলন : বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন কোটা-প্রথা পুনর্বহালের পরই নতুন করে আবার আন্দোলন শুরু হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবারো রাস্তায় নেমে পড়েন। যার নাম দেয়া হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সরকারি চাকরিতে কোটা-ব্যবস্থায় স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে টানা এ আন্দোলন চালিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা দল-মত নির্বিশেষে এই আন্দোলনে অংশ নেন।
কোটাবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলা : ১৬ জুলাই কোটা ইস্যুতে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ধারালো অস্ত্র, রড ও লাঠিসোঁটা হাতে থাকা নেতাকর্মীদের দখলে চলে যায় ক্যাম্পাস। সংঘর্ষের সময় কয়েকজন যুবককে আগ্নেয়াস্ত্র হাতেও দেখা যায়। হামলায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। এদের মধ্যে অনেক ছাত্রীও ছিলেন। এর এক দিন আগে কোটা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ আখ্যা দেন শেখ হাসিনা। তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদে ১৬ জুলাই মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা স্লোগান দেন ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে, কে বলেছে- স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’। এ নিয়ে সরকারপন্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আন্দোলনকারীদের সমালোচনাও করেন। ঢাবি ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলার দায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল থেকে ছাত্রলীগকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। ছাত্রলীগমুক্ত ক্যাম্পাসে বিভিন্ন হলে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। এ সময় শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ‘শিক্ষা-সন্ত্রাস, একসঙ্গে চলে না’, ‘শিক্ষা-ছাত্রলীগ, একসঙ্গে চলে না’, ‘ছাত্রলীগ বিতাড়িত করো, সন্ত্রাসমুক্ত দেশ গড়ো’- এসব স্লোগান দিতে দেখা যায়। ১৭ জুলাই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ছাত্রলীগ সবশেষ নিয়ন্ত্রণ হারায় সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে। এই হলের কোটা আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী ছাত্রলীগ নেতাদের রুম ভাঙচুর করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় ছাত্রলীগ নেতারা পালিয়ে যান।
আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড : ১৬ জুলাই বৈষমবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ, যে ফটকটি পরে ‘শহীদ আবু সাঈদ গেট’ নামকরণ করেন শিক্ষার্থীরা। আবু সাঈদ সেখানে একা দুই হাত প্রসারিত করে, বুক পেতে পুলিশ থেকে ৫০-৬০ ফিট দূরে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় দাঁড়িয়েছিলেন। তার হাতে ছিল কেবল একটি লাঠি। এরপরও তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপরই আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে ওঠে। আবু সাঈদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের (২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ) শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ছিলেন। অত্যন্ত দরিদ্র বাবা-মায়ের ৯ সন্তানের একজন ছিলেন সাঈদ। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ ও মেধাবী। পরিবারের মধ্যে প্রথম কোনো ব্যক্তি হিসেবে যখন তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তার ভাইবোনরা এতই উচ্ছ্বসিত ছিলেন যে নিজেদের পড়াশোনার খরচ বাঁচিয়ে তাকে দিতেন।
জুলাই-আগস্ট গণহত্যা : ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার গণ-অভুত্থানের সময় সরকারের চালানো দমনপীড়ন ও ব্যাপক হত্যাকাণ্ডকে ‘জুলাই গণহত্যা’ বলা হয়। কোটাপদ্ধতি পুনর্বহাল ও ব্যাপক গণ-অসন্তোষের জের ধরে এই দমন অভিযান পরিচালনা করে তৎকালীন সরকার, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জুলাই বিপ্লবে অন্তত ১ হাজার ৪২৩ জন ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছেন বলে দাবি করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম। গেল ২১ সেপ্টেম্বর এক ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেন, শহীদ এবং আহতদের সংখ্যায় আরো কিছু সংযোজন-বিভাজন হতে পারে। তবে এ বিষয়ে খুব শিগগিরই একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হবে। এত প্রাণহানি সত্ত্বেও হাসিনা সরকার এই গণহত্যার দায় অস্বীকার করে এবং দলটির এখন পর্যন্ত কোনো অনুশোচনা নেই।
এক দফা দাবিতে আন্দোলন, মার্চ টু ঢাকা : ৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিসভার পদত্যাগের একদফা দাবি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া সংগঠনটির সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হবে। পরে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন নাহিদ। তিনি বলেন, সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন চলবে। সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তাবাহিনীর উদ্দেশে তিনি বলেন, এই সরকারকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। আপনারা সরকারকে সমর্থন না দিয়ে জনগণকে সমর্থন দিন। এদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে রাজনৈতিক দল, শিল্পী গোষ্ঠী, শিক্ষক সমাজ থেকে শুরু সারা দেশের মানুষ সমর্থন জোগান। একটি সংবাদ সম্মেলনে দেশের সাবেক সেনাপ্রধানসহ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সশস্ত্র বাহিনীকে ছাত্র-জনতার মুখোমুখি দাঁড় না করানোর আহ্বান জানান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ডাকে অসহযোগ কর্মসূচি ঠেকাতে ৪ আগস্ট তিন দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। বলা হয়, সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। সেই সাথে অনির্দিষ্টকালের কারফিউও বহাল রাখা হয়। এদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’র ঘোষণা দেন। কিছু সময় পর সেই কর্মসূচি ৫ আগস্টের জন্য ঘোষণা দেন সমন্বয়করা। সারা দেশে বিক্ষোভ-আন্দোলন এবং গণ-অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত রাখারও ঘোষণা দেন। অন্যদিকে কঠোর হাতে নৈরাজ্যবাদীদের দমন করতে ৪ আগস্ট দেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। ৪ আগস্ট দুপুর থেকে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটকসহ বন্ধ করে দেয়া হয় বেশ কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আন্দোলনকারীদের ওপর সরাসরি গুলি না চালানোর নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের আবেদন খারিজ করে দেন হাইকোর্ট।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগ : ৫ আগস্ট সকালেও রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ছাত্র-জনতার সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ চলে। গুলিতে সেদিনও অনেক শিক্ষার্থী নিহত হন। তবে দুপুর ১২টার দিকে সংবাদ মাধ্যমে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশে ভাষণের ঘোষণা দেন। তখনই রাজধানীর বুকে ছাত্র-জনতার ঢল নামে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নেয়া লাখো মানুষের সমাবেশ বেলা আড়াইটার দিকে যাত্রা করে গণভবনের দিকে। এরপর জনগণের উদ্দেশে দেয়া ভাষণে শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা বলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সেনাপ্রধানের ভাষণের পরই উচ্ছ্বসিত ছাত্র-জনতার মিছিলে মিছিলে স্লোগান ছিল, ‘কী হয়েছে কী হয়েছে, শেখ হাসিনা পালাইছে’। ৩৬ দিন আগে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার চেয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত রূপ লাভ করল। যার জন্য শেষদিন পর্যন্ত সময়কে ‘৩৬ জুলাই’ বলে অ্যাখ্যা দেয় ছাত্র-জনতা।
ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ : গণ-অভ্যুত্থানের পরে ছাত্রদের দাবির মুখে নিষিদ্ধ করা হয় আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগ। ২৩ অক্টোবর এই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে সরকার। এ সংত্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিটবাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নানা ধরনের জননিরাপত্তা বিঘœকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল এবং এ সম্পর্কিত প্রামাণ্য তথ্য দেশের সব প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে।
গত ১৫ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ জনগণকে উন্মত্ত ও বেপরোয়া সশস্ত্র আক্রমণ করে শত শত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিকে হত্যা করেছে এবং আরো অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করেছে। সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে যে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজে জড়িত আছে। এই অবস্থায় সরকার ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯’ এর ধারা ১৮ এর উপ-ধারা (১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো এবং ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নামীয় ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হলো।
পালিয়ে গেলেও ক্ষত সর্বত্র : শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও দেড় দশকের স্বৈরাচারী শাসনের ফলে রাষ্ট্র্রে প্রতিটি অঙ্গে তৈরি হয়েছে গভীর ক্ষত। যে ক্ষত সারাতে রীতিমতো বেগ পেতে হচ্ছে ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে। রাষ্ট্রে সংস্কার চলছে। যে সংস্কারের আওতায় রয়েছে অর্থনীতি থেকে শুরু করে নির্বাচনব্যবস্থাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব অঙ্গ। কেবল ব্যংক খাতেই যে লুটপাট হয়েছে, তা দিয়ে ২৪টি পদ্মা সেতু বা ১৪টি মেট্রোরেল নির্মাণ করা যেতো বলে উল্লেখ করা হয়েছে এই সংক্রান্ত এক শে^তপত্রে। এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে লুটপাটতন্ত্র কায়েম করা হয়নি। এসব লুটপাটের চিত্র এখন বেরিয়ে আসছে। এসবের কারণে বছরজুড়ে দামের উত্তাপে পুড়েছে নিত্যপণ্যের বাজার। গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তন হলেও নিত্যপণ্যের বাজারে আসেনি স্বস্তি। পরিবর্তনের আগে বা পরে, বাড়তি দামের উত্তাপে হাত পুড়ছে ক্রেতাদের। দাম কমানোর উদ্যোগ হিসেবে শুল্ক কমালেও, আগের মতোই সিন্ডিকেটের হাতে বন্দী বাজার। এদিকে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও বাড়েনি মজুরি। তাই ভোক্তার কষ্ট ছিল বছরজুড়েই। মূল্যস্ফীতির চাপেই শুরু হয়েছিল চলতি বছরের পথচলা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব, প্রথম প্রান্তিকের তিন মাসই সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের কাছাকাছি। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল আরো চড়া।
২০২৪ সালে দেশে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের পাশাপাশি আলোচিত ছিল তাপদাহ। এছাড়া মে থেকে আগস্ট মাসজুড়ে দফায় দফায় বন্যায় আক্রান্ত হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। তবে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী হিসেবে বিবেচিত হয় আগস্ট মাসে দেশের পূর্বাঞ্চলে সংঘটিত বন্যা। বিশেষ করে ফেনী ও নোয়াখালী অঞ্চল আক্রান্ত হয় স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায়। সব মিলিয়ে দেশে মে মাস থেকে আগস্ট পর্যন্ত চার মাসে প্রাকৃতিক দুর্যোগে এক কোটি ৮৩ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব দুর্যোগের মধ্যে ছিল ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা। পাশাপাশি পুরো গ্রীষ্মকালজুড়েই মানুষকে ব্যাপক ভোগায় তীব্র গরম ও তাপপ্রবাহ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গণ-অভ্যুত্থানোত্তর বাংলাদেশ পুনর্গঠন রাতারাতি সম্ভব নয়। তবে এই পথে প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্য। কারণ চক্রান্ত লেগেই আছে। পরাজিত শক্তি আছে ওঁৎ পেতে। রাজনৈতিক বিভাজনে বিফলে যেতে পারে বিপ্লব।