স্বদেশ ডেস্ক:
বাংলাদেশ সফর শেষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল ফিরে গিয়ে নির্বাচন নিয়ে অর্থবহ সংলাপের ওপর গুরুত্ব দিয়ে পাঁচ দফা সুপারিশ করেছে।
একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে অর্থবহ সংলাপ এবং রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করেছে মার্কিন ওই প্রতিনিধ দল।
বাংলাদেশ সফর করে ওয়াশিংটনে ফিরে যাওয়ার পর রোববার (১৫ অক্টোবর) প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রতিনিধি দলটি।
তাদের অন্য সুপারিশগুলো হলো- বাকস্বাধীনতার সুরক্ষা ও ভিন্নমতকে সম্মান করা হয় নাগরিকদের জন্য এমন পরিবেশ তৈরি করা, স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনাসহ এমন পরিবেশ তৈরি করা যাতে সব দল একটি অর্থবহ নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় সামিল হতে পারে এবং নাগরিকদের মধ্যে সক্রিয় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনে অংশগ্রহণের সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করা।
‘বাংলাদেশ একটি সন্ধিক্ষণে রয়েছে এবং আসন্ন নির্বাচন হবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার জন্য একটি লিটমাস টেস্ট,’ উল্লেখ করে একটি বিবৃতি দিয়েছে মার্কিন প্রতিনিধি দল।
সেখানে বলা হয়েছে, এসব সুপারিশ একটি রোডম্যাপ তৈরি করবে, যা গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়ার জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমুলক নির্বাচন অর্জনে সহায়তা করতে পারে।
ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশ করা যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশের নির্বাচনের পটভূমিতে প্রাক-নির্বাচনী দলের ঢাকায় বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরে এসব সুপারিশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে সুপারিশগুলো কখন বাস্তবায়ন করতে হবে এবং না করলে কী হবে সে সম্পর্কে কিছু ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়নি।
ঢাকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি-উভয়েই যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের সুপারিশমালাকে স্বাগত জানিয়েছে।
তবে বিএনপি বলেছে, এগুলো বাস্তবায়নের জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিদায় করে নির্দলীয় সরকার জরুরি।
আর আওয়ামী লীগ বলেছে, মার্কিন দলের সুপারিশগুলো চমৎকার এবং দলটি মনে করে ‘যারা সহিংসতা করে নির্বাচনকে ঠেকাতে’ চায় তাদের জন্য এটি একটি কড়া বার্তা।
একজন নির্বাচন বিশ্লেষক বলেছেন, মার্কিন প্রতিনিধি দলের সুপারিশে নির্বাচন নিয়ে সংলাপ-সমঝোতা এবং নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনভাবে কাজ করার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
উল্লেখ্য, নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি প্রয়োগের ঘোষণা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর নির্বাচন-পূর্ব পরিবেশ পর্যালোচনা করতে আসা মার্কিন এ দলটির প্রতিবেদনকে আগামী নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো যা বলা হয়েছে
প্রাক-নির্বাচনী দলটির বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় সফলতা দেখিয়েছে। কিন্তু অগ্রগতির কিছু ক্ষেত্র থাকার পরেও দেশটির রাজনৈতিক পরিবেশ নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে ভয়ের পরিবেশ, রাজনৈতিক অবস্থানে অনড় থাকার মানসিকতা, আক্রমণাত্মক বক্তব্য ও রাজনৈতিক সহিংসতা, মত প্রকাশের সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসা এবং সর্বোপরি অংশীজনদের মধ্যে আস্থার ঘাটতি।
এতে বলা হয়, নারী, তরুণ ও অন্য প্রান্তিক গোষ্ঠীর জন্যও উল্লেখযোগ্য বাধা তৈরি হয়েছে।
‘এসব চ্যালেঞ্জগুলো গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা দেশটির টেকসই উন্নয়নের পথে বাধা তৈরি করতে পারে,’ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট পার্টির থিংক ট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত আইআরআই আর এনডিআই’র প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত মার্কিন নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল গত ৮-১২ অক্টোবর ঢাকায় নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের সাথে বৈঠক করেছিল।
এর মধ্যে ছিল প্রধানমন্ত্রী, কয়েকজন মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তা, নির্বাচন কমিশন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সিভিল সোসাইটি প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
মূলত যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে ঢাকায় আসা এ দলটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই মার্কিন প্রশাসনের বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা।
এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে।
বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া
বিরোধী দল বিএনপি বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক নির্বাচনী দলের সুপারিশে বাস্তব অবস্থাই উঠে এসেছে এবং দলটির নেতাদের মতে, এসবগুলোই তারা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছেন।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কার্যকর ও অর্থবহ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হলে এগুলো করতেই হবে।
‘কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে ক্ষমতায় রেখে এগুলো বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। সেজন্যই আমরা সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের দাবি করে আসছি। একটি নির্দলীয় সরকার আসলেই এগুলো বাস্তবায়ন করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হবে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ দলের সুপারিশমালা ও পর্যবেক্ষণকে তারা বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের জন্য সুখকর খবর বলেই মনে করছেন।
‘তবে তারা যে সংলাপের কথা বলেছেন সেটি দলগুলোর মধ্যে হওয়ার যৌক্তিকতা নেই। সহিংসতা করে নির্বাচন ঠেকাতে চায় এমন কারো সাথে আমরা সংলাপে বসতেও চাই না। অতীতে এ ধরনের সংলাপ সফলও হয়নি। বরং নির্বাচনের কোনো বিষয়ে কোনো দলের কিছু বলার থাকলে তারা সেটি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সাথে আলোচনা করতে পারে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
আব্দুর রহমান বলেন, সংলাপ এখন একটি সস্তা জনপ্রিয় কথামালায় পরিণত হয়েছে কারণ বাংলাদেশের বাস্তবতায় এটা ফলদায়ক কিছু নয়।
‘এর বাইরে মার্কিন দলটি যা সুপারিশ করেছে সেগুলো আমাদেরও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক অঙ্গীকার। তাই এ সুপারিশগুলো যারা সহিংসতা করে নির্বাচন ঠেকানোর কথা বলে তাদেরকে সে পথ পরিহার করার জন্য একটি বার্তা বলেই আমরা মনে করি,’ বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক বক্তৃতা ও কথাবার্তায় আমরা সহনশীল হবো। অন্তর্ভুক্তিমূলক, অংশগ্রহণমূলক ও সহিংসতামুক্ত ভোট আমরা চাই, যেখানে জনগণ নিজস্ব মতামত স্বাধীনভাবে ব্যক্ত করতে পারবে এবং যেখানে কেউ সহিংসতা করে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করতে পারবে না।’
অন্যদিকে নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলিম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের টিমটির দুটি সুপারিশ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হলো- নির্বাচনী গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে খোলামেলা ও অর্থবহ আলোচনা এবং স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করা।
‘নির্বাচন মানেই হলো সমঝোতা। দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা দরকার। আর নির্বাচন কমিশন শুধু আইনি দিক থেকে নয় বরং সত্যিকার ভাবে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে কি-না সেটি নিশ্চিত করতেই হবে। এ বার্তাই তারা দিয়েছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
তবে এসব সুপারিশমালা বাস্তবায়ন কবে নাগাদ করতে হবে বা না করলে কী হবে সেটি হয়তো পরে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশের পরই জানা যাবে বলে মনে করেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি