স্বদেশ ডেস্ক:
– এক সপ্তাহে বিএনপির ২ জন নিহত
– ২২ মামলায় আসামি ১৫ হাজার
ঢাকায় বিরোধী দলের ডাকা তারুণ্যের সমাবেশে এসেছে বড় দুই ভাই। সেই অপরাধে ছোট ভাইকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এমনটিই দাবি করেছে লাকসামে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা সিয়াম হোসেন মনার বড় ভাই ও লাকসাম পৌরসভা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক রায়হান।
নিহত মনার আরেক বড় ভাই ও লাকসাম পৌরসভা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক রায়হানের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত শনিবার ঢাকার তারুণ্যের সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন নিহত মনার বড় দুই ভাই লাকসাম পৌরসভা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সফিউল্লাহ ও পৌরসভা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক রায়হান। সে জন্য ওই দিন রাত সাড়ে ৮টায় তাদের দুই ভাইকে লাকসাম পৌরশহরের উত্তর লাকসামের বাড়িতে হেলমেট পরে অস্ত্রসহ খুঁজতে যায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। দুই ভাইকে বাড়িতে না পেয়ে তাদের বাড়ির কিছুটা আগে লাকসাম ফায়ার সার্ভিস অফিসের কাছে তার বাবার মালিকানাধীন পুরনো লৌহজাত দ্রব্যাদির দোকানে গিয়ে তাদের আপন ছোট ভাই স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা সিয়াম হোসেন মনাকে (২২) পায় তারা। এ সময় জোর করে মনাকে তুলে নিয়ে যায়। পরে রাত আড়াইটায় পৌর শহরের গণ্ডামারা গ্রামের উম্মুলকোরা মাদরাসার সামনে সিয়াম হোসেন মনার লাশ পাওয়া যায়।
লাকসামে মনা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ছাড়াও গত এক সপ্তাহে বিএনপি ঘোষিত পদযাত্রা ও ঢাকার তারুণ্যের সমাবেশকে কেন্দ্র করে হত্যার শিকার হন বিএনপির দুই কর্মী। এ ছাড়া আহত হয় পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। এর মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে আছে অনেকে। বগুড়ায় বিএনপির সাথে সংঘর্ষের সময় পুলিশের টিয়ারশেলে অসুস্থ হয়েছে অর্ধশত স্কুলশিক্ষার্থী। ২২ মামলায় আসামি করা হয় ১৫ হাজার নেতাকর্মীকে।
গত ১৮ জুলাই লক্ষ্মীপুরে বিএনপির পদযাত্রা চলাকালে শহরের সামাদ মোড়ে আওয়ামী লীগের লোকজনের সাথে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় সজীব (২৫) নামে যুবদলের ওই কর্মীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়। প্রাণ বাঁচাতে তিনি কলেজ সড়কের মদিনউল্যা হাউজিংয়ের পাশের ফিরোজা টাওয়ার নামে একটি ভবনের নিচে আশ্রয় নেন। সেখানে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। নিহত সজীবের বাড়ি সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ এলাকায়। এ দিন সংঘর্ষে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো: সোহেল রানাসহ উভয়পক্ষের অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হাছিবুর রহমান দাবি করেন, শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় পুলিশ বাধা দেয়। নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। এ সময় পুলিশের সাথে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হামলায় অংশ নেয়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সজীব নামের কৃষক দলের একজন কর্মীকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। পুলিশের ছররা গুলিতে তাদের ৩০ থেকে ৪০ নেতা-কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বলেও দাবি করেন তিনি।
এ ছাড়া জেলা শহরের ঝুমুর সিনেমা হল এলাকা, রামগতি সড়কের আধুনিক হাসপাতাল, মটকা মসজিদ এলাকায় আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সাথে বিএনপি নেতাকর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষে অন্তত ২০০ জনের বেশি লোক আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
মিরপুর : গত ১৮ জুলাই রাজধানীর মিরপুরে বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে ছাত্রলীগের সংঘর্ষের ঘটনায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন আহত হন।
জয়পুরহাট : গত মঙ্গলবার বিকেলে জয়পুরহাট শহরের রেল গেট এলাকায় বিএনপির পদযাত্রা ও আওয়ামী লীগের শান্তি ও উন্নয়ন শোভাযাত্রা শেষে উভয় দলের মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে ৪০ জন আহত হয়েছে।
বগুড়া : বগুড়ায় বিএনপির পদযাত্রায় পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ ঠেকাতে টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে পুলিশ। বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষে শহরের ইয়াকুবিয়া স্কুল মোড় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় পুলিশসহ অনেক বিএনপি নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। পুলিশের ছররা গুলিতে অন্তত ২৫ জন বিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন বলে দাবি বিএনপি নেতাদের।
এ সময় ঘটনাস্থলে পাশে ইয়াকুবিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে তাদের স্থানীয় মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে নেয়া হয়। ধোঁয়ার গন্ধে অনেক শিক্ষার্থী বমি করা শুরু করে। বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার শফিক আমিন কাজল জানান, অনেক শিক্ষার্থী হাসপাতালে এসেছিল। অনেককে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু ২৭ জন ছাত্রী বেশি অসুস্থ হওয়ায় তাদের সন্ধ্যা পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রাখা হয়। তিনি আরো জানান, স্কুলের পাশের রাস্তায় টিয়ার শেল নিক্ষেপের কারণে শিক্ষার্থীরা ধোঁয়ায় বমি করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা ধোঁয়ার কারণে ভয় পেয়ে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা অবস্থায় নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী স্নেহা আক্তার বলেছিল, দুপুরে ক্লাস করছিলাম। হঠাৎ অনেক জোরে জোরে শব্দ হতে থাকে। এরপর ক্লাসের ভেতর ধোঁয়ায় ভরে যায়। তখন চোখ জ্বালা করছিল, নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। পরে ম্যাডাম এসে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আফিয়ার মা খাদিজা বেগম জানান, বিদ্যালয় থেকে খবর পেয়ে হাসপাতালে আসি। মেয়ে টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে স্যালাইন দিয়ে রেখেছিলেন চিকিৎসকরা। পরে সুস্থ হলে বাড়ি আনা হয়েছে।
খবর পেয়ে অসুস্থ শিক্ষার্থীদের দেখতে হাসপাতালে যান জেলা বিএনপি সভাপতি রেজাউল করিম বাদশাসহ অন্য নেতাকর্মীরা। পরবর্তীতে বগুড়া-৬ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপু শিক্ষার্থীদের দেখতে যান।
ফেনী : বিএনপির পদযাত্রায় পুলিশের সাথে নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে পুলিশ, বিএনপির নেতাকর্মীসহ অর্ধশতাধিক লোক আহত হয়েছেন।
খাগড়াছড়ি : খাগড়াছড়ি জেলা শহরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর সংঘর্ষের ঘটনায় তিন পুলিশসহ উভয়পক্ষের অন্তত এক শ’ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এম এন আবছার অভিযোগ করে বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা পদযাত্রায় অংশ নিতে দলীয় কার্যালয়ের সামনে জমায়েত হওয়ার আগে আওয়ামী লীগ বিনা উসকানিতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের কর্মীরা বিএনপির নেতাকর্মীদের মারধর করেছে। এতে বিএনপির ৫০ নেতাকর্মী আহত হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ : পদযাত্রা কর্মসূচি পালনের সময় বিএনপির সমর্থকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিচার্জ, রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধসহ শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছে বলে বিএনপি দাবি করে।
২২মামলায় আসামি ১৫ হাজার : বিভিন্ন থানা সূত্রে জানা যায়, বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচি ঘিরে হামলা, সহিংসতা, ভাঙচুর, সরকারি কাজে বাধা দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ৯টি জেলায় বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ২২টি মামলা হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি কোথাও কোথাও সরকারি দলের কর্মী-সমর্থকরাও এসব মামলার বাদি হয়েছেন। এসব মামলায় এক হাজার ৫৮৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামাসহ প্রায় ১৫ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় দলটির ১৩০ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ঢাকায় দু’টি, চট্টগ্রামে দু’টি, লক্ষ্মীপুরে চারটি, ফেনীতে তিনটি, বগুড়ায় চারটি, খাগড়াছড়িতে তিনটি, জয়পুরহাটে দু’টি, কিশোরগঞ্জ ও পিরোজপুরে একটি করে মামলা হয়েছে। তবে লক্ষ্মীপুরে দু’টি মামলার এজহারে কোনো আসামির নাম উল্লেখ করা হয়নি। অন্য মামলাগুলোর মধ্যে এজহারে নাম উল্লেখ থাকা আসামির অধিকাংশ বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। ১৩ হাজার ৩৭০ জনকে এসব মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া বগুড়ায় দায়েরকৃত চারটি মামলায় ২১১ বিএনপি নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করা হলেও মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি, বলা হয়েছে আসামি ‘অনেক’। এসব মামলার কিছু হয়েছে বিশেষ ক্ষমতা আইনে আবার কিছু হয়েছে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরীতে বিএনপির পদযাত্রা থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলার অভিযোগে দু’টি মামলা হয়েছে। খুলশী থানায় গত বুধবার রাতে পুলিশ ও এক আওয়ামী লীগ কর্মী বাদী হয়ে মামলা দু’টি করেন। তবে নগর বিএনপি কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বিএনপির পক্ষ থেকে মামলা করতে গেলে তা ফিরিয়ে দিয়েছে পুলিশ। গত বুধবার বিকেলে নগরীর লালখান বাজারে নৌকার নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর হয়। এর প্রতিবাদে ছাত্রলীগ-যুবলীগের কয়েকশ কর্মী নাসিমন ভবনে বিএনপি কার্যালয়ে হামলা করে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।
খুলনায় তারুণ্যের সমাবেশে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের ওপর হামলা, সরকারি কাজে বাধা ও গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে যুবদল-ছাত্রদলের ১৪ জন নেতার নাম উল্লেখসহ বিএনপির অজ্ঞাত আরো ৭০-৮০ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। গত সোমবার সন্ধ্যায় খুলনা সদর থানার সহকারী পরিদর্শক শরিফুল ইসলাম এ মামলা দায়ের করেন।
এ ছাড়া বগুড়া জেলায় বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আজগরসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে ছয়জন বিএনপির পদধারী নেতা। এ ছাড়া ঢাকায় ১৮ জন, নারায়ণগঞ্জে ৪ জন, খাগড়াছড়িতে ১৬ জন, লক্ষ্মীপুরে ২৮ জন, জয়পুরহাটে ৩ জন, পিরোজপুরে ১৭ জনকে গ্রেফতার হন। ফেনীতে তিন মামলায় সাড়ে তিন হাজার আসামি করা হলেও এখনো কাউকে গ্রেফতারের তথ্য পাওয়া যায়নি।