পহেলা সেপ্টেম্বর, ২০১৯ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীর একশত একতম জন্মবার্ষিকী। স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কিংবদন্তিতুল্য জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীকে নিয়ে, যিনি তার অসাধারণ মেধা, যোগ্যতা, দেশপ্রেম, দূরদর্শী সমরকৌশল প্রয়োগ করে তুলনামূলকভাবে বহুগুণে শক্তিশালী শত্রুবাহিনীকে পরাস্ত করে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলাফলকে অনুকূলে নিয়ে আসেন। কিছু বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিক মুক্তিযুদ্ধে সামরিক নেতৃত্বকে খাটো করে দেখেন, যা অনাকাঙ্খিত।
জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী ছিলেন একাধারে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও সেনাবাহিনীর প্রথম প্রধান সেনাপতি এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ‘জেনারেল’ পদবির কর্মকর্তা, যিনি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের সেনাবাহিনীকে গড়ে তুলেছিলেন। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৭ ও ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তানের দু’টি যুদ্ধেও বীরত্বের সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিশ্বের ইতিহাসে চারটি বড় বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, এমন সামরিক অফিসারের সংখ্যাও খুবই কম। তিনিই একমাত্র অফিসার যিনি একযোগে তিনটি দেশের সশস্ত্র বাহিনী অর্থাৎ ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনী, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।
সামরিক দিক থেকে এ দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য মিলিটারি লিডার তৈরি হয়েছিলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে ও পরবর্তীকালে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে সিনিয়র বাঙালি মুসলমান অফিসার ছিলেন তিনজন : (১) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইশফাকুল মজিদ, বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করায় জন্য পাকিস্তানিরা তাকে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বেই বরখাস্ত ও গ্রেফতার করে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছিল, (২) লেফটেন্যান্ট জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিন, যিনি ছিলেন সেনাসদরে কর্মরত এবং (৩) কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী, যিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এদের মধ্যে কর্নেল ওসমানীকেই মহান আল্লাহ প্রস্তুত করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সিপাহসালার হিসেবে। শুধু তাই-ই না, মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য খোদ পাকিস্তানি মিলিটারি একাডেমিতেই প্রশিক্ষিত হয়েছিলেন একদল অসীম সাহসী টগবগে অফিসার, যারা সৌম্য, শক্তি ও ক্ষিপ্রতার মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে শত্রু বাহিনীকে প্রতিহত, পর্যুদস্ত ও ধ্বংস করার কৌশল রপ্ত করেছিলেন। মহান আল্লাহর দয়ায় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টও সৃষ্টি হয়েছিল, যার প্রতিটি ইউনিট ছিল শত্রুর জন্য যমদূতের মতো।
৬। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কাল রাত্রিতে এ ভূখণ্ডের অসহায়, নিরীহ মানুষের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ ও নির্মম, নিষ্ঠুর, নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে সমগ্র জাতি হতভম্ব ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। পুনরায় সামরিক উর্দি পড়ে আগ্নেয়গিরির লেলিহান শিখার মতো জ্বলে ওঠেন তিনি। তার জন্য আরো সুবিধা হয়েছিল যে, তিনি ইতোমধ্যেই ব্যাপক রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অর্জন করে জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। সে জন্য কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নেতাদের সাথেও তার সখ্য ও সুমধুর সম্পর্ক ছিল। ফলে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার বেগ পেতে হয়নি।
যুদ্ধবিদ্যার সুনিপুণ কারিগর অসাধারণ সাহসী, তেজস্বী ও নির্ভীক সেনানায়ক জেনারেল ওসমানীর সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সুদক্ষ নেতৃত্বে দ্রুতগতিতে মুক্তিযুদ্ধ বেগবান হয়। তিনি বাংলাদেশকে এগারোটা সেক্টরে ভাগ করে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন। অতঃপর তিনটি নিয়মিত ব্রিগেড (জেড, কে ও এস ফোর্স) সৃষ্টি করেন। কয়েক মাসের মধ্যেই নবগঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিকট পাকিস্তানি বাহিনী নাস্তানাবুদ হতে থাকে, বিভিন্ন যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে থাকে এবং ৯ মাসেরও কম সময়ে আমাদের বিস্ময়কর বিজয় অর্জিত হয়।
১৯১৮ সালে বাবার কর্মস্থল সুনামগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন আতাউল গনি ওসমানী, যিনি শৈশবে ‘আতা’ নামেই পরিচিত ছিলেন। তার পৈতৃক নিবাস সিলেট জেলার বালাগঞ্জ থানার (বর্তমানে ওসমানী নগর উপজেলা) দয়ামীরে। ওসমানীর বাবা মরহুম খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ছিলেন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। আসামের সুনামগঞ্জ মহকুমায় সাব-ডিভিশনাল অফিসার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। পদোন্নতি পেয়ে হয়েছিলেন জেলা প্রশাসক। ১৯৫৬ সালে পবিত্র হজব্রত পালন করতে গিয়ে মক্কার আরাফাতে ইন্তেকাল করেন এবং সেখানে জাবালে রহমতে তাকে দাফন করা হয়। ওসমানীর পূর্বপুরুষ শাহজালাল (রহ:) এর ৩৬০ সঙ্গীর অন্যতম হজরত শাহ নিজাম উদ্দিন ওসমানী (রহ:)। ওসমানীকে ১৯২৯ সালে ১১ বছর বয়সে গৌহাটির ‘কটনস্ স্কুল অব আসাম’-এ ভর্তি করা হয়।
১৯৩২ সালে সিলেট গভর্নমেন্ট পাইলট হাইস্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ওসমানী স্কুলের প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম হতেন। ১৯৩৪ সালে এ স্কুল হতেই ম্যাট্রিক পাস করেন কৃতিত্বের সাথে। সমগ্র ভারতে তিনি প্রথম স্থান লাভ করেন। এই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য ব্রিটিশ সরকার ওসমানীকে ‘প্রিটোরিয়া পুরস্কার’ করে। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৩৬ সালে আই এ এবং ১৯৩৮ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ওসমানী শৃঙ্খলা, কর্তব্য ও ন্যায়পরায়ণতাসহ চারিত্রিক গুণাবলির মাধ্যমে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। গুণাবলির কারণে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউওটিসির সার্জেন্ট পদে নিযুক্ত করা হয়। এ ছাড়াও তাকে স্যার সৈয়দ আহমদ হলের ছাত্রদের শৃঙ্খলা বিধানকারী কার্যাধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসাম-বেঙ্গল ছাত্র সঙ্ঘের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। লখনৌতে ‘সার্ভেন্টস অব ইন্ডিয়া সোসাইটি হলে’ জিন্নাহ ও নেহরুর উপস্থিতিতে নিখিল ভারত ছাত্র সম্মেলনে ওসমানী আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে সম্মেলন পরিচালনা করেন। একজন ছাত্রের জন্য এসব ছিল বড় সম্মানের ব্যাপার।
১৯৩৯ সালে ওসমানী ব্রিটিশ-ভারতীয় রয়্যাল মিলিটারি একাডেমিতে যোগদান করেন। অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ১৯৪০ সালে কমিশন লাভ করেন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ভর্তির মৌখিক পরীক্ষায় ইন্টারভিউ বোর্ডের চেয়ারম্যান ওসমানীকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কি মনে করেন, আপনার উচ্চতা একজন সৈনিকের জন্য যথোপযুক্ত?’ তিনি বলেছিলেন, ‘আমি নেপোলিয়ানের চেয়েও লম্বা’। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল এবং প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও আদেশ এবং নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতায় পারদর্শিতার কারণে এত জুনিয়র অফিসার হওয়া সত্ত্বেও তাকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ানের কমান্ডার হিসেবে বার্মা সেক্টরে নিয়োগ করা হয়।
১৯৪২ সালে যুদ্ধ চলাকালে মেজর পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। সে সময়ে তিনি ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মেজর, যা বাঙালি মুসলমানদের জন্য ছিল অত্যন্ত সম্মান ও গৌরবের বিষয়। বাবার ইচ্ছানুযায়ী ১৯৪৫ সালে তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের পলিটিক্যাল ক্যাডারে পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। কিন্তু দেশসেবার ব্রত ধারণ করে সেনাবাহিনীকেই বেঁছে নেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ১৯৪৫ সালে তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এরই মধ্যে লে. কর্নেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ওসমানী ৭ অক্টোবর নবগঠিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের কোয়েটা স্টাফ কলেজ হতে গ্রাজুয়েশন লাভ করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি চিফ অব জেনারেল স্টাফের ডেপুটি হিসেবে নিযুক্ত হন।
১৯৫০ সালে তিনি যশোর সেনানিবাসে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক নিযুক্ত হন এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের প্রতিষ্ঠা ও এর পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ববাংলার আরো কয়েকটি আঞ্চলিক স্টেশনের দায়িত্বও তিনি সফলতার সাথে পালন করেন। পরবর্তীকালে তিনি ১৪তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৯ম ব্যাটালিয়ানের রাইফেলস কোম্পানির পরিচালক এবং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ই.পি.আর.) অতিরিক্ত কমান্ড্যান্টের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৫ সালের ১২ ডিসেম্বর সেনাসদরে মিলিটারি অপারেশন ডাইরেক্টরেটে জেনারেল স্টাফ অফিসার গ্রেড-১ হিসেবে নিযুক্তি পান এবং ১৯৫৬ সালের ১৬ মে কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়ে মিলিটারি অপারেশনের ডেপুটি ডাইরেক্টরের দায়িত্বে নিযুক্ত হন।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এ সময় তিনি আন্তর্জাতিক সংস্থা সিয়াটো ও সেন্টোতে পাকিস্তান বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকাকালীন জেনারেল ওসমানী স্পষ্টভাষী, স্বাধীনচেতা, নির্ভীক কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং বাঙালি সেনাদের অধিকার রক্ষার্থে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ গানটিকে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মার্চ বা রণসঙ্গীত হিসেবে মনোনীত করে সরকারের অনুমোদন লাভে সক্ষম হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তিনি অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন এবং তাকে ‘পাপা টাইগার’, ’টাইগার ওসমানী’, ‘বঙ্গশার্দুল’ ইত্যাদি নামে অলঙ্কৃত করা হয়েছে। ওসমানী ১৯৬৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
ওসমানীর গভীর দেশপ্রেম ও বাঙালিদের অধিকার আদায়ে আপসহীন মনোভাব সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু অবহিত ছিলেন। জাতীয় স্বার্থে বঙ্গবন্ধু তাকে রাজনীতিতে যোগদান করার জন্য আহ্বান জানান। ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং সাধারণ নির্বাচনে বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোপালগঞ্জ ও বিশ্বনাথসহ গঠিত আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কাল রাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির ওপর বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে ওসমানী কালবিলম্ব না করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহকে সমর্থন দেন এবং ইপিআর, পুলিশ, আনসারসহ অবসরপ্রাপ্ত সব বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ৪ এপ্রিল বৃহত্তর সিলেটের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কদের নিয়ে এক ঐতিহাসিক বৈঠক করে ছিলেন। সব অফিসার ওসমানীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন। তিনি তার দিকনির্দেশনা ও যুদ্ধপরিকল্পনা সবাইকে অবহিত করেন এবং পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করার নির্দেশ দেন। এ বৈঠকেই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা সর্বসম্মতিক্রমে কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক মনোনীত করেন।
১৯৭১ সালে ১২ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার এক ঘোষণায় কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিবাহিনী গঠন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করে কেবিনেট মন্ত্রীর পদমর্যাদায় তাকে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত করে এবং তার শপথ গ্রহণ করানো হয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজ দক্ষতা ও কৌশল প্রয়োগ করে মুক্তিবাহিনীকে সুসংগঠিত করে দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা দিয়ে গেরিলাযোদ্ধাদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণও করতেন। জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার ওসমানীকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল পদে উন্নীত এবং অসাধারণ বীরত্বের জন্য ‘বঙ্গবীর’ উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গবীর ওসমানীকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ ও বিমান মন্ত্রী নিযুক্ত করেন। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৯৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ওসমানী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং আগের মন্ত্রণালয়গুলোসহ ডাক, তার ও টেলিফোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদীয় গণতন্ত্র বিলুপ্ত করে বাকশাল কায়েম করা হলে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ওসমানী সংসদ সদস্য পদ, মন্ত্রিত্ব ও আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৬ সালে ৫ সেপ্টেম্বর সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি ‘জাতীয় জনতা পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন এবং ‘গণনীতির রূপরেখা’ নামে একটি বই রচনা করেন। ১৯৭৮ ও ১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করে ছিলেন। পরবর্তীকালে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পেছনে ওসমানীর অবদান অসামান্য। তিনি ছিলেন খাঁটি দেশপ্রেমিক এবং নির্লোভ রাজনীতিবিদ। তিনি নীতি-আদর্শের ব্যাপারে ছিলেন অটল।
১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জেনারেল এম এ জি ওসমানী লন্ডনের সেন্টপল হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। ২০ ফেব্রুয়ারি পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী হজরত শাহজালাল (রহ:) দরগাহসংলগ্ন তার মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়।