স্বদেশ ডেস্খ:
করোনা সংক্রমণে বিপর্যস্ত অর্থনীতি। আমদানি-রপ্তানি, নতুন বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় অভ্যন্তরীণ ঋণ বৃদ্ধির হার অনেক কমে গেছে। কিন্তু অফশোর ব্যাংকিংয়ের ঋণের আরও করুণ অবস্থা। শেষ তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ কমে গেছে। এ ছাড়া সস্তা সুদের এ ঋণেও রয়েছে খেলাপির ছোবল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনায় বৈদেশিক বাণিজ্য অনেকটাই থমকে গেছে। এজন্য কমে গেছে এ ঋণের চাহিদা। এ ছাড়া কয়েকটি ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিংয়ে নতুন করে ঋণ দেওয়ার মতো সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ২০১৯ সালের মার্চ শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে যা ছিল ৬০ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে অফশোর ব্যাংকিংয়ে ঋণ কমেছে ৩১৮ কোটি টাকা; দশমিক ৫২ শতাংশ। অফশোর ব্যাংকিং চালুর পর প্রথমবারের মতো ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির পরিবর্তে কমে গেল।
অফশোর ব্যাংকিং হলো বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দেওয়ার জন্য গঠিত ব্যাংকের আলাদা ইউনিট। দেশের বাইরে থেকে তহবিল সংগ্রহ করে রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার জন্য ১৯৮৫ সালে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে ৩৫টি ব্যাংক ইউনিট গঠন করে ঋণ বিতরণ করছে। এইচএসবিসি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, ইসলামী, ইস্টার্ন, ইউসিবি, দ্য সিটি, প্রাইম, ব্যাংক এশিয়া, ব্র্যাক, সাউথইস্ট অফশোর ব্যাংকিংয়ে শীর্ষ ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের মার্চে অফশোর ব্যাংকিং ঋণ ছিল ৩৩ হাজার ৩১১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি। পরের বছরে মার্চে এই ঋণ ২৬ শতাংশ বেড়ে হয় ৪১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের মার্চে অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো ৫৪ হাজার ১১৩ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে। ওই বছর থেকেই অফশোর ব্যাংকিংয়ের ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির হার কমে গেছে। ২০১৯ সালের মার্চে ঋণ বাড়ে মাত্র ৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তার আগের বছর প্রবৃদ্ধি হয় প্রায় ২৯ শতাংশ। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক প্রেসিডেন্ট ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, করোনার কারণে বৈদেশিক বাণিজ্য কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে গেছে। এজন্য স্বল্প সুদে বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল সংগ্রহ কঠিন হয়ে পড়েছে। এটি অনেক কমে গেছে। যার ফলে ঋণ দেওয়ার মতো অর্থ নেই। এ ছাড়া ঋণের চাহিদা অনেক কম। এজন্য অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ অনেক কম। তিনি আরও বলেন, আইনে কিছুটা কঠোরতা আরোপ করা হয়। সেটি শিথিল করা হয়েছে। এখন ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ করা সহজ হবে।
গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো অফশোর ব্যাংকিং পরিচালনার নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে বিতরণ করা ঋণের অন্তত ৭৫ শতাংশ বাংলাদেশে অবস্থিত কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়। এতে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যায়। অফশোর কার্যক্রমের তহবিল আহরণের সুযোগ বৃদ্ধি, বৈদেশিক তহবিলের ব্যবহার নিশ্চিত করা, তহবিল ব্যবস্থাপনা যথাযথ রাখার মাধ্যমে অফশোর ব্যবসার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রমের আরও সুষ্ঠু বিকাশের জন্য গত ১৮ জুন আইনে কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নগদ জমা সংরক্ষণের হার (সিআরআর) সাড়ে ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে মাত্র ২ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে একটি ব্যাংকের মূলধনের ২০ শতাংশের পরিবর্তে এখন থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত তহবিল সংগ্রহ করতে পারবে। এই সংশোধনের ফলে অফশোর ব্যাংকিংয়ে সক্ষমতা বাড়বে।
প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাহেল আহমেদ বলেন, করোনার প্রভাব সব কিছুতে পড়েছে। অফশোর ব্যাংকিংয়ের নতুন নীতিমালার কারণে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের সক্ষমতা কম ছিল। এ ছাড়া বছর দেড়েক জুড়ে আন্তর্জাতিক লাইবর রেট বেশি থাকায় এই ঋণের সুদহার বেশি পড়েছে। এজন্য গ্রাহকদের পক্ষ থেকে বেশি চাহিদা আসেনি। এসব কারণে অফশোর ব্যাংকিংয়ের ঋণ বিতরণ কমে গেছে।
গত মার্চে স্থানীয় মুদ্রায় বেসরকারি খাতের ঋণ বিতরণ মাত্র ৮ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ২৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে খেলাপি ঋণ ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের ছোবল থেকে বাদ যায়নি সস্তা সুদের বৈদেশিক মুদ্রার ঋণও। অফশোর ব্যাংকিংয়ের মোট খেলাপি ঋণ ৪৫১ কোটি টাকা। তবে অভ্যন্তরীণ ঋণের মতো অফশোরেও খেলাপি ঋণ সামান্য কমেছে। এ খেলাপি ঋণ মূলত এবি, ঢাকা, ব্র্যাক, প্রাইম ও উরি ব্যাংকের। এবি ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিংয়ে যে ঋণ দিয়েছে তার অর্ধেকই খেলাপি হয়ে গেছে।