স্বদেশ ডেস্ক: ফুটফুটে দুই শিশু মিসকাত ও নুসরাত। দুই ভাইবোন। দাদা-দাদির সঙ্গে ঈদ করতে গ্রামে গিয়েছিল মায়ের সঙ্গে। কর্মব্যস্ততার কারণে তাদের বাবা বাবুল ফরাজী ছিলেন কেরানীগঞ্জেই। গ্রামে পাঠানোর আগে অজানা আশঙ্কায় দুই সন্তানকে জড়িয়ে অঝোরে কেঁদেছিলেন বাবুল।
সে সময় বাবার চোখের পানি মুছে দিয়ে ১২ বছর বয়সী মিসকাত বলেছিল, ‘আব্বা তুমি কাইন্দ না, ঈদের পর তাড়াতাড়ি আমরা চইল্লা আসমু।’ ঈদের ছুটি কাটিয়ে মিসকাত ও তার ৫ বছরের ছোট বোন নুসরাত গতকাল শুক্রবার বাসায় ফিরেছে ঠিকই, তবে লাশ হয়ে। লঞ্চের ধাক্কায় নৌকাডুবির একটি ঘটনা ল-ভ- করে দিয়েছে ফরাজীর পরিবার।
গতকাল শুক্রবার সকালে সদরঘাটের ওয়াইজঘাট থেকে আলম টাওয়ার ঘাটে যাওয়ার পথে মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটে এক নম্বর পন্টুন বরাবর বুড়িগঙ্গার মাঝ নদীতে। সদরঘাট টার্মিনালে থাকা এমভি পুরবী-৫ নামে একটি লঞ্চ কোনো সিগন্যাল ছাড়াই পেছনে বেগার দিলে সৃষ্ট ঢেউয়ে মিসকাতদের বহনকারী খেয়া নৌকাটি ডুবে যায়।
এ সময় মিসকাত ও নুসরাত ছাড়াও তাদের মা জোসনা বেগম, এক বছরের বোন নুসাইবা ও মামা শামীম হাওলাদার প্রাণে বেঁচে গেলেও ছোট্ট শিশু মিসকাত ও নুসরাত ডুবে যায়। নৌ দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর এম মাহবুবুল ইসলাম, পরিচালক শফিকুল হক, সদস্য (অপারেশন প্লানিং) দেলোয়ার হোসেন, ঢাকা নদীবন্দরের যুগ্ম পরিচালক একেএম আরিফ উদ্দিন, উপপরিচালক মিজানুর রহমান প্রমুখ। ঢাকা নদীবন্দরের উপপরিচালক মিজানুর রহমান জানান, ভুক্তভোগী পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।
সদরঘাট নৌ থানার ওসি মো. রেজাউল জানান, শিশু দুটির বাবা বাবুল ফরাজী কেরানীগঞ্জের কালিগঞ্জ এলাকায় তৈরি পোশাকের ব্যবসা করেন। তাদের গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ থানার উত্তমপুরে।
ঈদের ছুটিতে বাবুল স্ত্রী-সন্তানদের বরিশাল বাবা-মায়ের কাছে পাঠান। ছুটি কাটিয়ে বৃহস্পতিবার রাতের লঞ্চে বরিশাল থেকে মামা শামীম হাওলাদারকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা দেন।
ভোরে সদরঘাটে পৌঁছে তারা। এর পর নৌকায় করে কেরানীগঞ্জের বাসায় ফেরার পথে তাদের নৌকা ডুবে যায়। ওই খেয়া নৌকায় থাকা শিশু দুটির মা, বোন ও মামাকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও তাদের দুই ভাইবোনকে বাঁচানো যায়নি। তিনি আরও জানান, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে নৌ পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে।
অবশ্য নৌকাডুবির পর স্থানীয় মাঝিরা জোসনা বেগম, তার শিশুসন্তান নুসাইবা ও ছোট ভাই শামীমকে উদ্ধার করে। দুপুর ১২টার দিকে সদরঘাটের এক নম্বর পন্টুন বরাবর নদী থেকে প্রথমে মিসকাতের লাশ উদ্ধার করে ডুবুরিরা।
আধাঘণ্টা পর কাছাকাছি এলাকায় নুসরাতের লাশ ভেসে ওঠে। এই উদ্ধার অভিযানে কোস্টগার্ড ও বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধার কর্মীরাও অংশ নেয়। নিহত দুই শিশুর পরিবারের পক্ষ থেকে ময়নাতদন্ত ছাড়া মরদেহ নেওয়ার আবেদন করা হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বিনা ময়নাতদন্তে লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলেও ওসি রেজাউল জানান।
বাবুল ফরাজি জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিন সন্তানকে নিয়ে স্ত্রী জোসনা বেগম লঞ্চে করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। তাদের সঙ্গে বিজিবিতে চাকরিরত তার শ্যালক শামীম ছিলেন। শুক্রবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে তারা সদরঘাটে এসে নামে। সেখান থেকে কেরানীগঞ্জের বাসায় আসার উদ্দেশে ওয়াইজঘাট থেকে খেয়া নৌকায় ওঠে।
এর পর আমার সব শেষ…. বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবুল ফরাজি। শামীম হাওলাদার বলেন, নৌকায় আমার সঙ্গে বোন জোসনাÑ তার তিন সন্তান মিসকাত, নুসরাত ও এক বছর বয়সী নুসাইবা ছিল। মাঝ নদীতে এমভি পুবালী-৫ লঞ্চের ধাক্কায় আমাদের নৌকাটি ডুবে যায়। নুসাইবা ছিল আমার কোলে। ধাক্কা লাগার পর দেখলাম আমরা লঞ্চের নিচে, পানির মধ্যে। কোনো রকমে সাঁতরে বের হই। জোসনাও বের হয়। কিন্তু মিসকাত আর নুসরাতকে পাওয়া গেল না। লঞ্চটি বেপরোয়া গতিতে না চালালে এই দুর্ঘটনা হতো না বলে অভিযোগ করেন তিনি।
বিআইডব্লিউটিএর পরিবহন পরিদর্শক মো. সেলিম বলেন, লঞ্চটি সদরঘাটে যাত্রী নামিয়ে কেরানীগঞ্জের দিকে যাচ্ছিল। নৌকাটি লঞ্চের পেছন দিয়ে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনা ঘটে। মাঝি দেখেশুনে চালালে এ দুর্ঘটনা হতো না। তারপরও বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।