স্বদেশ ডেস্ক:
আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ও অভ্যন্তরীণ পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে সৃষ্ট স্বীকৃত বিলের মূল্য যথাসময়ে পরিশোধ করছে না বেশির ভাগ ব্যাংক। ফলে এক ব্যাংকের কাছে আরেক ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে অনিষ্পন্ন স্বীকৃত বিল ছিল ৪ হাজার ২৯২টি। এসব বিলের বিপরীতে আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ ২৫ কোটি ৫৫ লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় ২ হাজার ২০২ কোটি টাকা)। বেশির ভাগ অর্থই মামলায় আটকে আছে। এর মধ্যে একটি ব্যাংকেরই বিলের সংখ্যা ১৬৪টি। মামলার বাইরে থাকা স্বীকৃত বিলের পাওনা পরিশোধে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে তাগিদ দিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে দ্রুত বকেয়া বিলের মূল্য পরিশোধ না করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রক্ষিত হিসাব থেকে তা কেটে পরিশোধ করা হবে বলে হুশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
স্বীকৃত বিল হলো আমদানি, রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ পণ্য সরবরাহের বিপরীতে সৃষ্ট ডকুমেন্টস। এ ধরনের ডকুমেন্টের বিপরীতে ব্যাংক গ্রাহকের পক্ষে স্বীকৃতি বা নিশ্চয়তা দেয়। সাধারণত আমদানিকারকের ব্যাংকের স্বীকৃতি বা নিশ্চয়তার বিপরীতে রপ্তানিকারকের ব্যাংক কিছু কমিশনের বিনিময়ে বিল কিনে নেয়। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে এটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত নিয়ম। এর মাধ্যমে আমদানিকারকের ব্যাংকের দায় সৃষ্টি হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বীকৃতি প্রদানের পর বিল পরিশোধ করা না হলে ব্যাংকারদের মধ্যে বিশ্বাসহীনতা ও আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়, যা ব্যাংক ব্যবসার ক্ষেত্রে অনাকাক্সিক্ষত। এ ছাড়া বিদেশেও ব্যাংকগুলোর গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়, যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করে।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংককেই গ্যারান্টিকৃত স্থানীয় স্বীকৃত বিলের মূল্য পরিশোধ করতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাংকগুলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্থ পরিশোধ না করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ৬০ দিন সময় দেওয়া হয়ে থাকে। এই অতিরিক্ত সময় দেওয়ার ফলে কেউ কেউ সুযোগের অপব্যবহার করছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী ব্যাংকগুলোর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের বলেন, স্বীকৃত বিলের মূল্য পরিশোধ করা ব্যাংকারদের নৈতিক কর্তব্য। বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে মামলা করার আবশ্যকতা থাকে না। অনাদায়ী স্বীকৃত বিলগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। মামলা করার কারণে ব্যাংকের প্রাপ্যতা আরও বৃদ্ধি পায় এবং মামলা সংক্রান্ত জটিলতা ও ব্যয় বৃদ্ধি পায়, যা কাম্য নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের স্বীকৃত বিলের বিপরীতে যথাসময়ে অর্থ পরিশোধ হয়নি। এর মধ্যে স্থানীয় তিন হাজার ৮০২টি স্থানীয় স্বীকৃত বিলের বিপরীতে আটকে আছে এক হাজার ৮২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মামলা ছাড়া এক হাজার ৪০৫টি বিলের বিপরীতে ৩৭৬ কোটি টাকা এবং মামলাভুক্ত দুই হাজার ৩৯৭টি বিলের বিপরীতে আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ এক হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে, এ সময় পর্যন্ত ৪৯০টি বৈদেশিক স্বীকৃত বিলের বিপরীতে বকেয়া ছিল ৩৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মামলা ছাড়া ২৯৭টি বৈদেশিক বিলের বিপরীতে ১৬০ কোটি টাকা এবং মামলাভুক্ত ১৯৩টি বৈদেশিক বিলের বিপরীতে বকেয়া অর্থের পরিমাণ ২২০ কোটি টাকা।
গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় অনিষ্পন্ন স্বীকৃত বিলগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির ওপর জোর দেওয়া হয়। সভায় বলা হয়, মামলা করে স্বীকৃত বিলের অর্থ পরিশোধ না করার বিষয়টি খুবই অপেশাদারি। ইস্যুয়িং ব্যাংকের কাছে বিল উপস্থাপন করার আগে আদালতে মামলা করা হলে সেক্ষেত্রে আদালতের রায় ব্যতীত করণীয় থাকে না। ওই সভায় বিভিন্ন ব্যাংকে আটকে থাকা শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ১৪৬টি স্থানীয় স্বীকৃত বিলের অর্থ পরিশোধ না হওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক জোয়ারদার ইসরাইল হোসেন জানান, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের প্রায় সব বিলই ২০১১-২০১৩ সালে সৃষ্ট। এসব বিলের বিপরীতে মামলা চলমান থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল আজিজ জানান, স্বীকৃত বিল পরিশোধিত না হলে আগে বিলে স্বীকৃতিদানকারী ব্যাংকের হিসাব বিকলন করে অর্থ পরিশোধের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করেও অর্থ না পাওয়ায় শাহজালাল ব্যাংক মামলা করতে বাধ্য হয়েছে।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, ফোর্সড লোন তৈরি করে স্বীকৃত বৈদেশিক বিল পরিশোধ করা হয়। স্থানীয় স্বীকৃত বিল পরিশোধের ক্ষেত্রেও বিলের অর্থ পরিশোধ না হলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের হিসাব বিকলনের মাধ্যমে পরিশোধ করার জন্য তিনি বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানান। সোনালী ব্যাংকের এমডি আতাউর রহমান প্রধান বলেন, হলমার্ক সংক্রান্ত মামলাগুলোর আওতাধীন স্বীকৃত বিলের অর্থ পরিশোধ করার সুযোগ নেই। কারণ বিলগুলোর অর্থ মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পর পরিশোধযোগ্য হবে বলে আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান বলেন, একটি ব্যাংক কর্তৃক বিলে স্বীকৃতি প্রদানের পর তা পরিশোধ না করার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না।