বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ০৪:০২ পূর্বাহ্ন

নিষেধাজ্ঞার পরও কীভাবে দেশ ছাড়ে দুর্নীতিবাজরা

নিষেধাজ্ঞার পরও কীভাবে দেশ ছাড়ে দুর্নীতিবাজরা

স্বদেশ ডেস্ক:

প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও সাউথ-বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংকের বিদায়ী চেয়ারম্যান এসএম আমজাদ হোসেন দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়েছেন। এ খবর গতকাল রবিবার হাইকোর্টের নজরে আনা হলে আদালত হতাশা প্রকাশ করেন। দুদকের আইনজীবীকে উদ্দেশ করে হাইকোর্ট বলেন, ‘আসামি দেশত্যাগ করে চলে গেল, আপনারা নীরব দর্শক হয়ে দেখছেন। যেখানে দুদক আছে, বিএফআইইউ আছে, ডিবি আছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে তার পরও সে কীভাবে পালিয়ে যায়? দেশের টাকা বিদেশ চলে যায়, এর পর আসামিরা পালিয়ে যায়। দেশে এতগুলো সংস্থা থাকতে দুর্নীতিবাজরা কীভাবে দেশত্যাগ করে।’

গতকাল রবিবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি এসএম মজিবুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ প্রশ্ন তোলেন। পরে এসএম আমজাদ হোসেন কীভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন তা জানতে চেয়েছেন আদালত। এ ছাড়া তার মামলার বিস্তারিত তথ্য আজ সোমবার দুপুরের মধ্যে হাইকোর্টকে জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

আমজাদ হোসেনের সপরিবারে পালিয়ে যাওয়া নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর আদালতের নজরে আনেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক। পরে আদালত দুদকের আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘মামলা হয়েছে, নিষেধাজ্ঞা আছে, তদন্তও হচ্ছে; তার পরও কীভাবে সে দেশত্যাগ করল?’ এ সময় দুদকের আইনজীবী

খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘ইয়েস মাই লর্ড দুদকের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সে কীভাবে চলে গেল। মাই লর্ড আমরা সব সময় ট্রান্সপারেন্ট (স্বচ্ছ), আমরা কাজ করছি।’ বিচারপতি বলেন, বুঝলাম তো আপনারা কাজ করছেন, তা হলে গেল কী করে। কী পদক্ষেপ নিলেন। সে কীভাবে দেশ ছাড়ল। দুদকের আইনজীবী বলেন, ‘এটি নিয়ে আমার অফিসের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কথা না বলে কিছু বলতে পারব না।’

নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বিচারপতি বলেন, তা হলে এটি আমাদের জানান, তার বিদেশ যেতে নিষেধাজ্ঞা ছিল কিনা? নিষেধাজ্ঞা থেকে থাকলে সে গেল কীভাবে। আদালত বলেন, কী কী মামলা করেছেন, কীভাবে ফ্রিজ করলেন, কীভাবে নিষেধাজ্ঞা হলো, কখন কীভাবে পালিয়ে গেল- এগুলোর বিস্তারিত ইতিহাস জানাবেন। আমরা আগামীকাল (আজ) আদেশ দেব। আদালত আরও বলেন, ‘হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে- এমন অভিযোগ থাকার পরও সে কীভাবে পালিয়ে যায়? তা হলে দুদক কী কাজ করল। বিএফআইইউ কী কাজ করল। কীভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে এ বিষয়ে আমরা রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলকেও শুনাব। অনেক কাজ করছেন, এটি তো মুখে বললেই হবে না। কিন্তু পালানো থামাতে পারছি না। এটি তো একটি সিরিয়াস ম্যাটার। আমরা যদি এখন এসবের বিষয়ে লক্ষ্য না রাখি, তা হলে তো দেশের টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটি সিরিয়াস ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম। এ বিষয়ে আমাদের সিরিয়াস স্ট্যান্ড নেওয়া উচিত। দেশের টাকা দেশের বাইরে যাবে কেন।’ আদালত আরও বলেন, ‘দেশের টাকা নিয়ে বিদেশে আরামে বসবাস করবে আর দেশের অর্থনীতির বারটা বাজবে। জনগণের ঘাম ও শ্রমের টাকা। প্রবাসীরা কত কষ্ট করে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। সেই টাকা যদি এভাবে বিদেশে পাচার হয়ে যায়, এটি তো মারাত্মক বিষয়।

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘ইমিগ্রেশনটা কীভাবে পার হলো, এটি রাষ্ট্রপক্ষকে জানাতে বলেন। এটি জানা বেশি দরকার। ইমিগ্রেশন বলতে পারবে সাউথ-বাংলার চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন কয়টায় গেলেন। বিমানে গেলেন নাকি স্থলপথে- এটি জানা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন পিকে হালদারের বিচারের আদেশ বিভিন্ন সংস্থার কাছে পৌঁছাতে তিন ঘণ্টা লেগেছিল।’ তখন আদালত বলেন, ‘এখনকার যুগে কি তিন ঘণ্টা সময় লাগে আদেশ পৌঁছাতে। এটি এক মিনিটের ব্যাপার। কোর্টের আদেশ কমিনিউকেটেড করা এক মিনিটের ব্যাপার। তিন ঘণ্টা লাগবে কেন? কী আর বলব। আমরা হতাশ। এটি তো আপনাদের অবহেলা।’

তখন দুদকের আইনজীবী বলেন, ‘এখানে দুদকের কোনো অবহেলা নেই। অবহেলা ছিল পুলিশের।’ আদালত বলেন, ‘ওকে আমরা দেখব। আমরা হতাশ হয়ে যাই। আমরা চাই আমাদের অর্থনীতি ভালো থাকুক। দেশের মানুষ উপকৃত হোক, দেশের উন্নয়ন হোক, মানুষ যাতে ডাল-ভাত আনন্দের সঙ্গে খেতে পারে। এভাবে টাকা যদি বাইরে চলে যায়, তা হলে দেশের মানুষ কীভাবে সুন্দর জীবনযাপন করবে। এগুলো আমাদের দেখতে হবে। এটি দেখা দুদকের প্রধান দায়িত্ব।’

এর আগে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাউথ-বাংলা ব্যাংকের বিদায়ী চেয়ারম্যানের বিদেশ পালিয়ে যাওয়ার প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকটির সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান এসএম আমজাদ হোসেন দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন। স্থলসীমান্ত দিয়ে বুধবার ভারত হয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছেন। তার সঙ্গে স্ত্রী সুফিয়া আমজাদ এবং মেয়ে তাজরির আমজাদও রয়েছেন। আমজাদ হোসেনের দুর্নীতির কারণে সম্প্রতি তার সব ব্যাংক হিসাব জব্দ (অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ) করেন আদালত। এ ছাড়া সাউথ-বাংলা ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ থেকে তিনি সরে যেতে বাধ্য হন।

ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- আমজাদ হোসেন আমেরিকা, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারতে একাধিক বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। পাচার করা বিপুল অঙ্কের অর্থে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রাসাদ গড়েছেন। আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধে দুদকে নতুন করে আরও ৮২৯ কোটি টাকা জালিয়াতির তথ্য মিলেছে। এর কিছু দিন আগে আরও ৪৩০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ ছিল। এর অনুসন্ধানও শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে তার জালিয়াতি করা অর্থের পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এর মধ্যে ৯ কর্মচারীর নামে তার ২৫ কোটি টাকা ঋণ তুলে আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন দেশে অর্থপাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পর আমজাদ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৯৩৫টি ব্যাংক হিসাব জব্দের (ফ্রিজ) আদেশ দেন আদালত। দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিচালক গুলশান আনোয়ারের আবেদনের পর ২১ অক্টোবর ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ কেএম ইমরুল কায়েশ হিসাবগুলো জব্দের আদেশ দেন। ইমিগ্রেশনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আমজাদ হোসেন বছরজুড়েই কলকাতা, দুবাই, যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুর যাতায়াত করতেন, যা স্বাভাবিক যাতায়াত নয় বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এর আগে বিদেশে অর্থপাচার ও জালিয়াতির কারণে গত বছরের ৯ জানুয়ারি আমজাদ হোসেন ও পরিবারের সদস্যদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক। এ নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ১১ থেকে ১৫ জানুয়ারি মেয়েকে নিয়ে তিনি সিঙ্গাপুর ঘুরে আসেন।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877