বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০৮:৪০ পূর্বাহ্ন

বিএনপিতে নেতায় নেতায় অনৈক্য

বিএনপিতে নেতায় নেতায় অনৈক্য

স্বদেশ ডেস্ক:

দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে; কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার তাগিদ যেন কম। দলের নীতিনির্ধারক থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীরা নানা গ্রুপ ও উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে আছেন।

দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংসদীয় আসনে বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠন কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব-কোন্দল প্রকাশ হয়েছে। এর বাইরে দলে প্রভাব বিস্তার কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে রয়েছে গ্রুপিং। এর নেপথ্যেও রয়েছে কমিটিতে যার যার পছন্দের নেতাকে পদ দেওয়ার বিষয়টি।

নেতারা আরও জানান, কিছু ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতাদের দ্বন্দ্বের ধরন ও কারণ ভিন্ন। ওয়ান-ইলেভেনে দলের মধ্যে গড়ে ওঠা সংস্কারপন্থি ও জিয়া পরিবারপন্থি- এই দুই ধারা এখনো বিদ্যমান। এরা কেউ কাউকেই বিশ্বাস-আস্থায় আনতে পারছেন না। নেতাদের এই দ্বন্দ্ব দলের পুনর্গঠনের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অবশ্য বিএনপিতে দ্বন্দ্ব আছে এই বিষয়টি মানতে নারাজ দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, আমি মনে করি এই মুহূর্তে বিএনপি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল।

এই দলে কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব নেই, তবে প্রতিযোগিতা তো থাকবেই। এটিকে দ্বন্দ্ব বলা যাবে না।

গত মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাহী কমিটির সিরিজ বৈঠকেও দলের গ্রুপিংয়ের বিষয়টি নেতাদের বক্তব্যে উঠে আসে। জামায়াতে ইসলামীকে ২০-দলীয় জোটে রাখা না রাখা নিয়েও চলছে নানা তৎপরতা।

জানা গেছে, পটুয়াখালী-২ সংসদীয় আসনে তিনটি গ্রুপ। এগুলোর নেতৃত্বে আছেন সাবেক এমপি শহীদুল আলম তালুকদার, দলের নির্বাহী কমিটির সহ-দপ্তর সম্পাদক মুনির হোসেন ও সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ফারুক হোসেন। গ্রুপিংয়ের এমন চিত্র পটুয়াখালী জেলার ১৪টি সাংগঠনিক থানাতেও। তিন মাসের জন্য গত বছরের ৩ নভেম্বর ঘোষিত জেলা আহ্বায়ক কমিটি এখন মেয়াদোত্তীর্ণ। পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সুধাংশু সরকার আমাদের সময়কে বলেন, আমরা গ্রুপিং নিরসনে কাজ করছি। ইতোমধ্যে ১৪টি সাংগঠনিক থানার মধ্যে ৬টির আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে।

১৯৯১ সাল থেকে বরিশাল জেলা ও পরে মহানগরের নেতৃত্বে আছেন মজিবর রহমান সরোয়ার। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৫ (সদর) আসনে নির্বাচন করেছেন। বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও তিনি বিএনপির মেয়রপ্রার্থী ছিলেন। সরোয়ার বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও বরিশাল মহানগরের সভাপতিও। তাকে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত রেখে মেয়াদোত্তীর্ণ বরিশাল মহানগর কমিটি ঢেলে সাজাতে চান দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। এরই মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। গত মঙ্গলবার সরোয়ারপন্থিরা ঢাকায় এসে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর আগে সরোয়ারবিরোধী ছাত্র ও যুবদলের সাবেক নেতারা দলের ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাজাহানসহ গুরুত্বপূর্ণ একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে দেখা করেন।

রাজশাহী জেলা ও মহানগরে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কবির হোসেন ও মিজানুর রহমান মিনু, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নাদিম মোস্তফা, মহানগর বিএনপির বর্তমান সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ও সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন- এই নেতাদের নেতৃত্বে দল নানা গ্রুপ-উপগ্রুপে বিভক্ত। বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হলেও সেখানে দলটির সাংগঠনিক অবস্থা এখন বেহাল। পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এক দায়িত্বশীল কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, এসব নেতাকে বাদ দিয়ে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি এদের মতামত নিয়ে করাও সম্ভব নয়।

সংসদীয় আসন নাটোর-১ (লালপুর-বাঘাতিপাড়া) এর বিভিন্ন কমিটি গঠন নিয়ে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা প্রয়াত ফজলুর রহমান পটলের পরিবার এবং দলের দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপুর অনুসারীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে। অভিযোগ রয়েছে- উপজেলা ও পৌর কমিটি টিপুর অনুসারীদের বাদ দিয়ে করা হয়েছে। এই নিয়ে একটি প্রতিবেদন তারেক রহমানকে দেওয়া হয়েছে। এই এলাকার সংকট নিরসনে সম্প্রতি দলের যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পাবনা বিএনপিতে চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের অনুসারীদেরও কমিটি গঠনে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ গেছে তারেক রহমানের কাছে।

স্বেচ্ছাসেবক দলের নতুন জেলা ও মহানগর কমিটিতে ত্যাগীদের মূল্যায়ন না করার অভিযোগ তুলে বিএনপির সহ-স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক সামসুজ্জামান ১৮ আগস্ট দল ছাড়ার ঘোষণা দেন। এতে দলের দ্বন্দ্ব প্রকাশ হয়। সামসুজ্জামানের ঘোষণার পর তার অনুসারী বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের জেলা ও মহানগর পর্যায়ের প্রায় ৩০০ নেতা কয়েক দিনের ব্যবধানে পদত্যাগ করেন। এই অবস্থায় সম্প্রতি মেয়াদোত্তীর্ণ মহানগর কমিটি ভেঙে আবদুল কাইয়ুম জালালী পংকীকে আহ্বায়ক ও সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকীকে সদস্যসচিব করে ২৯ সদস্যের সিলেট মহানগর কমিটি ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত কমিটির বড় অংশই চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদির বলয়ের। বাদ পড়েছেন অনেক সক্রিয় নেতা।

খুলনা মহানগর বিএনপিও গ্রুপিংয়ের কারণে স্থবির। সম্প্রতি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের উত্তরার বাসায় সাক্ষাৎ করে এই স্থবিরতা নিরসনে তার হস্তক্ষেপ কামনা করেন মহানগরের সিনিয়র সহসভাপতি সাহারুজ্জামান মোর্ত্তজা ও যুবদলের মহানগর কমিটির সাবেক সভাপতি শফিকুল আলম তুহিনের নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ নেতারা। তারা খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জুর বিরোধী হিসেবে পরিচিত। পরে খুলনা মহানগর বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাসুদ পারভেজ বাবু জানান, এক যুগেরও বেশি সময় পার করেছে খুলনা মহানগর বিএনপির কমিটি। সম্মেলন বা নতুন কমিটি গঠনের কার্যকর উদ্যোগও নেই। ফলে সংগঠনে এসেছে স্থবিরতা।

ছাত্রদল ও যুবদলের সাবেক নেতারা ঢাকা জেলার মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে সবাইকে নিয়ে নতুন কমিটি গঠনের আবেদন জানিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে চিঠি দিয়েছেন। তারা সম্প্রতি মহাসচিবের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল লক্ষীপুর জেলা কমিটি ভেঙে দেওয়া হলেও দ্বন্দ্বের কারণে আজ পর্যন্ত কমিটি দিতে পারেনি বিএনপি। এই সংকট নিরসনে স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু দায়িত্ব পাওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার থানা কমিটির নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।

১৯৭৮ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে ফরিদপুরের বিএনপির রাজনীতি দুই ভাগে বিভক্ত। এক পক্ষে ছিলেন সাবেক মন্ত্রী ও দলের সাবেক মহাসচিব কেএম ওবায়দুর রহমান, অন্য পক্ষে সাবেক মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ। দুজনেই প্রয়াত; কিন্তু তাদের উত্তরাধিকারদের মধ্যে সেই বিরোধ বিরাজমান। একদিকে নেতৃত্ব দেন ওবায়দুর রহমানের মেয়ে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, আরেক দিকে কামাল ইবনে ইউসুফের মেয়ে মহিলা দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক নায়াব ইউসুফ।

জানতে চাইলে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, পাঁচ ভাই এক জায়গায় থাকলে মতের অমিল হয়ে থাকে; এটাকে কি দ্বন্দ্ব বলবেন? বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। সেখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভিন্নমত তো থাকবেই। এটাই তো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। আমরা যারা দায়িত্বশীল, তারা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানও করছি। নিরপেক্ষ সরকারের ডাক এলে দেখবেন বিএনপি কতটা ঐক্যবদ্ধ।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877