স্বদেশ ডেস্ক: ই-কমার্স জালিয়াতিতে প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে একের পর এক প্রতিষ্ঠানের নাম। সর্বশেষ সংযোজিত প্রতিষ্ঠান দালাল প্লাস। নামটি কেন দালাল করা হলো তার কোনো ব্যাখ্যা না থাকলেও প্রতিষ্ঠানের আড়ালে মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে কয়েকশ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে গ্রাহকের কাছ থেকে। এর আগে দালাল প্লাসের কর্ণধাররাই রেক্স আইটি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতারণার হাট বসিয়েছিল। ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম পলাশ তিন ডজনেরও বেশি মামলার আসামি হয়ে জেল খাটেন। সম্প্রতি তিনি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে পুরনো প্রতারণার কৌশল প্রয়োগ করেই নেপথ্যে থেকে গড়ে তোলেন দালাল প্লাস। বর্তমানে প্রায় লাখখানেক গ্রাহকের পণ্য বা টাকা বুঝিয়ে না দিয়েই অফিসের কার্যক্রম বন্ধ রেখেছেন তারা। বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা।
জানা যায়, ২০১৮ সালে সিপিএ মার্কেটিং ট্রেইনিংয়ের কথা বলে ব্যবসা শুরু করে রেক্স আইটি। কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হয় ওই প্রতিষ্ঠানে। তবে শিক্ষার্থীদের সিপিএ ট্রেনিংয়ের পরিবর্তে অফার দেওয়া হয় সিপিএ ডিজিটাল মার্কেটিং নামে অনলাইন ব্যবসায়। বিনিয়োগের শতকরা ৩০ থেকে ৮০ ভাগ পর্যন্ত
লভ্যাংশ ঘোষণায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে তরুণরা। রাজধানীর ধানমন্ডি, মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে শাখা খুলে ভর্তি করে দশ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী। এর মধ্যে অনেকে বিনিয়োগ করে লাখ লাখ টাকা। পরে কোম্পানি বন্ধ করে আড়ালে চলে যান প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম পলাশ। একই সঙ্গে অফিস বন্ধ করে আড়ালে চলে যায় রেক্স আইটির পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
রেক্স আইটির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা ৪২টি মামলা করেন। পালিয়ে বাঁচেন অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। দৈনিক আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। মূলত রেক্স আইটির প্রতারণার সঙ্গে যুক্তরাই পরবর্তী সময়ে খুলে বসে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান দালাল প্লাস। নানা লোভনীয় ও অদ্ভুত নামের অফারে আকৃষ্ট করেন গ্রাহকদের। ফলে প্রতিষ্ঠার মাত্র ছয় মাসে কোম্পানিটির লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে চারশ কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রেক্স আইটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাই বর্তমানে দালাল প্লাসের কর্ণধার। নেপথ্যে রয়েছেন রেক্স আইটির চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম পলাশ। দীর্ঘদিন জেল খাটার কারণে তিনি কোম্পানিটির সামনে থেকে নেতৃত্ব দেননি। রেক্স আইটির ট্রেইনার এসএম রাব্বি আল মামুনই বর্তমানে দালাল প্লাসের সিইও। এ ছাড়া দালাল প্লাসের শীর্ষ কর্মকর্তা ও পরিচালনা বোর্ডের প্রায় সব সদস্যই দালাল প্লাসের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
বর্তমানে দালার প্লাসের পরিচালনা বোর্ডে রয়েছেন সুমন আজিজুল, আবু জুবায়ের হোসেন, নিরব মনির, সালাউদ্দিন মুরাদ, এমকেই পিয়াস, আশীক আল মামুন, বোরহান উদ্দিন রনি। যারা প্রত্যেকেই রেক্স আইটির পরিচালনা বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
চলতি বছরের মার্চের শুরুতে প্রথম পণ্য বিক্রি শুরু করে দালাল প্লাস। যদিও প্রথম দিকে কোম্পানিটির নাম ছিল দালাল বাজার। এরপর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় দালাল। তবে বিভিন্ন অফার ও বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয় দালাল প্লাস। কোম্পানিটির ফেসবুক পেজ শুধু দালাল নামে রয়েছে। পেজটি ভিজিট করে দেখা গেছে, চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি দালাল বাজার নামে এটি খোলা হয়। এরপর ১৪ ফেব্রুয়ারি নাম পরিবর্তন করে দালাল রাখা হয়।
কলম্বাস, কমান্ডার, কমান্ডো, ঈগল, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, টাইফুন, কালবৈশাখী, তুফানÑ এমন চটকাদার নাম ব্যবহার করে শুরু করে অফার ঘোষণা। মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোন, ফ্ল্যাট, গাড়ি থেকে শুরু করে কাঁচাবাজার পর্যন্ত বিক্রি করেন তারা। তবে বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন থাকলেও মোটরসাইকেল, টেলিভিশন, ফ্রিজ ও বিভিন্ন দামি পণ্যেরই ঘোষণা দেওয়া হতো নানা অর্ডারের। ৩০ থেকে ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় আর ১০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ নিলেও পণ্য পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। অনেকে মাসের পর মাস অপেক্ষা করছেন।
করোনায় চাকরি হারিয়েছেন মোয়াজ্জেম হোসেন। পাঠাও অ্যাপসের মাধ্যমে মোটরসাইকেল চালাবেনÑ এমন ভাবনায় ৩৫ শতাংশ ছাড়ে বাইক অর্ডার করেন মাসতিনেক আগে। তবে বারবার আশ^াস দিলেও এখনো পণ্য পাননি তিনি।
একই অবস্থা মানিকগঞ্জের আকবর আলীর। দোকানে ব্যবসার জন্য পনেরোটি স্মার্টফোন অর্ডার করেছিলেন। কিন্তু তিন মাস পার হলেও স্মার্টফোন বুঝে পাননি।
গত দিন ধরে অফিস বন্ধের খবর শুনে মাথায় হাত আকবর আলীসহ হাজার হাজার গ্রাহকের। আদৌ পণ্য বা টাকা পাবেন কিনা তা বুঝতে পারছেন তারা। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনোভাবে যোগাযোগও করতে পারছেন না।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যেসব গ্রাহক মোটরসাইকেল অর্ডার করেছিলেন তাদের একটি চেক দেওয়া হয়েছে। তবে সেই চেকে ব্যাংক থেকে টাকা মিলবে না। গত ২৯ সেপ্টেম্বর এই চেক ফেরত বাবদ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও ২৯ সেপ্টেম্বর থেকেই অফিস বন্ধ। কাস্টমার কেয়ার, কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ফোন ধরছেন না। ঊর্ধ্বতনদের সবার মোবাইল নম্বরই বন্ধ।
তবে এসব গ্রাহকের সিটি ব্যাংকের যে চেক দেওয়া হয়েছে তাতে স্বাক্ষর রয়েছে জোবায়ের হোসাইন ও আজিজুল সুমনের। এর মধ্যে জোবায়ের রেক্স আইটির বরিশাল শাখার প্রধান ও আজিজুল সুমন ঢাকার একটি শাখার দায়িত্বে ছিলেন।
রেক্স আইটি থেকে প্রতারিত রবিউল হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, রেক্স আইটি আমাদের প্রায় ২শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল। এখন তারাই দালাল প্লাস খুলে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। রেক্স আইটির ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় দশ হাজারেরও বেশি সদস্য ছিল রেক্স আইটির। সর্বনিম্ন আট হাজার থেকে শুরু করে ৯০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছিলেন অনেক গ্রাহক।
এর মধ্যে আনারুল ইসলাম টুটুল নামের রাজশাহীর একজন ফ্রিল্যান্সার আত্মহত্যাও করেছিলেন। রেক্স আইটির কাছে তার পাওনা ছিল ১৭ লাখ টাকা। আত্মহত্যার আগে বিভিন্ন সময় ঘরে খাবার না থাকা ও রেক্স আইটির প্রতারণার কথা লিখেছিলেন ফেসবুকে।
দালাল প্লাসের সিইও এসএম রাব্বি আল মামুন মাত্র বছরখানেক আগেও ছিলেন কর্মহীন। অভাবের তাড়নায় পরিবারের সদস্যদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাড়িতে। রাব্বির দীর্ঘদিনের এক সহপাঠী আমাদের সময়কে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এক বছর আগেও তিন বেলা খাবার খাওয়ার টাকা ছিল না রাব্বির। আমরা একই সাথে রেক্স আইটিতে ভর্তি হয়েছিলাম। রাব্বিও প্রতারণার শিকার হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে রেক্স আইটি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগ দেয় রাব্বি। এর পরই ভাগ্য বদলাতে থাকে।
এ বিষয়ে জানতে দালাল প্লাসের সিইও এসএম রাব্বি আল মামুনের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও পাওয়া যায়নি তাকে। তার ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে বার্তা পাঠালেও উত্তর দেননি তিনি। তার বিভিন্ন সময়ে ব্যবহৃত দুটি সেলফোনও বন্ধ রয়েছে। ব্যবহার করছেন না অন্য কোনো যোগাযোগমাধ্যমও।
তবে মোবাইল নম্বর খোলা না পেলেও ইমোতে অ্যাকটিভ পাওয়া যায় দালাল প্লাসের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য আজিজুল সুমনকে। দালাল প্লাসের প্রতারণা এবং রেক্স আইটির প্রতারণার বিষয়ে জানতে চেয়ে মেসেজ করলে তিনি তা দেখেন। তবে উত্তর দেননি। বারবার কল করলেও প্রতিবারই কল কেটে দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ই-ক্যাবের সহসভাপতি মো. শাহাব উদ্দিন শিপন আমাদের সময়কে বলেন, দালাল প্লাস নামের কোনো প্রতিষ্ঠান ই-ক্যাবের সদস্য নয়।
দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনা এসব প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। সাধারণ মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে এরা পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে টাকা নিয়ে বিনিয়োগ করা হয় অন্য খাতে। এটা প্রতারণার শামিল। তিনি বলেন, মিথ্যা আশ^াস দিয়ে এরা ব্যবসা করছে। নামিদামি তারকারা ব্যবহৃত হচ্ছেন। এদের বিষয়েও সতর্ক হওয়া দরকার। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো মিথ্যা কনটেন্ট এবং প্রতিশ্রুতি যেন না দেয়, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। এই প্রতারণার জাল থেকে গ্রাহকদের রক্ষার জন্য দরকার ই-কমার্স অথরিটি। তিনি বলেন, এ ছাড়া আইন করে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। কারণ অনেকেই রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স না নিয়েই ব্যবসা করছেন। ক্লোজ মনিটরিং করতে হবে এসব কার্যক্রম।