স্বদেশ ডেস্ক:
প্রতারণা থেকে গ্রাহকদের সুরক্ষা ও ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে শুরু হওয়া ই-কমার্স ব্যবসায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। এর অংশ হিসেবে একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে ই-কমার্স আইন প্রণয়নে বিশেষ কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পূর্ণাঙ্গ আইন তৈরিতে এ কমিটি বিদেশি আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা ও কার্যক্রম পর্যালোচনা করবে। এ ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়েরও সহায়তা নেবে কমিটি। সেই সঙ্গে আলাদা নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়েও তারা কাজ করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ১ হাজার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান চলছে কোনো ধরনের নিবন্ধন ছাড়াই। সম্প্রতি ইভ্যালিসহ ১১টি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের ৩ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা হাতিয়েছে। অর্থ লোপাটের ঘটনা বেরিয়ে আসার পরই সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেয়। শুরু হয় ই-কমার্স আইন প্রণয়নের প্রাথমিক কার্যক্রম। সেই সঙ্গে নিবন্ধন ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, দেশে গেল বছর ই-কমার্স বাজারের আকার বেড়েছে ১৬৬ শতাংশ। বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার
কোটি টাকার বাজার রয়েছে এ খাতে। ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের ই-কমার্স খাত ২৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে পৌঁছবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। কোভিড-১৯ মহামারীকালীন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও ওষুধ ক্রয়-বিক্রয়ের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তবে এ খাতের মোট উদ্যোক্তার মধ্যে মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ ব্যবসায়িক কার্যক্রমে সাফল্য পেয়েছেন। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো কতটুকু সাফল্যের মুখ দেখেছে তা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘বিদ্যমান আইনের ৪২০ ধারায় (প্রতারণা) মামলা সহজেই জামিনযোগ্য বলে ই-কমার্সভিত্তিক আইনটি সংশোধনের দাবি উঠেছে। তবে সরকার ই-কমার্স বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরির কাজ করছে। আমরা ইভ্যালির বিষয়ের দায় এড়াচ্ছি না। এটিকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে চাই। আমরা ভাবছি কী করা যায়। কারণ, ই-কমার্স নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বহু মত রয়েছে।’ ই-কমার্সের সমস্যা সমাধানে সবাই মিলে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আইনি প্রক্রিয়া আরও কঠোর করতে হবে। আমরা চেষ্টা করছি আইন পরিবর্তন করে ই-কমার্স খাতকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনার। তিন-চার কিংবা ১০-১৫টি কোম্পানির জন্য ই-কমার্স খাতকে বিপদে ফেলতে চাই না। এ জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। আর দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় হিসেবে এর দায় এড়াতে চায় না বলেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অংশীজনদের সঙ্গে বসে আলোচনা করছে। উপায় খোঁজার চেষ্টা করছে। কোথায় কোথায় দুর্বলতা আছে, সেগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা চলছে। এ জন্য পৃথক আইন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন, নীতিমালা ও বিধিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের কাজ করছে সরকার।’ পাশাপাশি ই-কমার্সে লেনদেনে মানুষকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
ক্রেতাদের কাছ থেকে আগাম টাকা নিয়ে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করতে না পেরে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় আসা ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকাশপের বাইরে আরও ১০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে মনে করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের তৈরি এক প্রতিবেদনে এসব প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- আলেশা মার্ট, ধামাকা শপিং, সিরাজগঞ্জ শপিং, আলাদিনের প্রদীপ, বুম বুম, কিউকম, আদিয়ান মার্ট ও নিডস ডটকম বিডি। এসব প্রতিষ্ঠানে আর্থিক লেনদেনসহ যাবতীয় কার্যক্রম নজরদারিতে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষার কাজও করছে। অপরদিকে বিজনেস ইউনিক আইডেন্টিটিফিকেশন নম্বর নিয়ে ই-কমার্স ও ফেসবুক ব্যবসা করতে হবে- এমন বাধ্যবাধকতাও দিচ্ছে সরকার।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘গ্রাহকের সুরক্ষায় ই-কমার্স আইন প্রয়োজন। বাস্তবতার নিরিখে আইনের সংশোধন ও নতুন আইন প্রণয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া; তবে আইনের বিধিবিধানে ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তাদের সুরক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে হবে। পাশাপাশি দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান থাকতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ প্রতারণামূলক ব্যবসা করার সাহস না পায়। সর্বোপরি আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।’
দেশের ই-কমার্স খাতের চলমান সংকট নিরসনে এবং এ খাতের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। প্রচলিত আইনের সংশোধনের পাশাপাশি প্রতারণামূলক ই-কমার্স ব্যবসাগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। এদিকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা অফারে লোভে পড়ে গ্রাহকদের প্রতারিত হওয়া ঠেকাতে জনস্বার্থে প্রচার চালাতে পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ই-কমার্স নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশেই ই-কমার্সের ব্যবসা রয়েছে। এটা খুবই জনপ্রিয়। তবে আমাদের দেশে ই-কমার্স ব্যবসা নতুন। কতিপয় অসাধু ব্যক্তি তাদের অসাধু কার্যকলাপের জন্য ই-কমার্সের ব্যবসা পেছনের দিকে নিয়ে গেল। অথচ নতুন একটা ব্যবসায় মানুষজন কাজ করতে পারত। সেটাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়ে ই-কমার্স ব্যবসাটাকে নষ্টই করে ফেলা হলো।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার জানামতে ই-কমার্স নিয়ে কোনো আইন হয়নি। এটাকে আইনের আওতাভুক্ত করতে হবে। আমি মনে করি, যারা এ ধরনের ব্যবসা করবে তাদের কাছ থেকে একটা সিকিউরিটি বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ে তাদের লাইসেন্স দেবে। সে ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি যদি কোনো ধরনের প্রতারণার শিকার হন, তাদের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সিকিউরিটি মানি থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া যেতে পারে।’