নাজমুন নাহার: ২৫ জুলাই কুতাইসি এয়ারপোর্টে নামলাম, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল ছুঁইছুঁই। এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে এসেই আগ্নেয়গিরির বাতাসের মতো কিছু একটা অনুভব করলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মিনিবাসে চড়ে বসলাম, বাসটি শহরের দিকে রওনা হলো। অনেকক্ষণ পর বাসটি থামলো শহরের মেইন স্কয়ারে। বাস থেকে নেমেই মনে হলো ভিন্ন এক অনুভূতি, যা পৃথিবীর কোথাও হয়নি। বাতাস প্রচ- গরম, যা চিন্তার বাইরে। এমন গরম বাতাসে খুব একটা মানুষকে বাইরে হাঁটতে দেখা যায় না। আমি তখন মরুভূমি সফরের কথা চিন্তা করলাম, প্রচ- তাপে আমার হাতের চামড়ায় যখন ফোস্কা পড়েছিল। নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে মাথায় রেখে ট্যুরিস্ট হোস্টেলে উঠলাম কুইন স্ট্রিটের ৬০ নম্বর তেমি হোস্টেলটা ছোট্ট কিন্তু খুব চমৎকার। পুরো ‘তামার দা কুইন স্ট্রিট’ জুড়ে রয়েছে প্রাচীন আমলের সব আর্কিটেকচার, বড় বড় পুরোনো গাছ, কেমন যেন পুরোনো আভিজাত্য ভরে আছে পুরো রাস্তার আশপাশে। হোস্টেলের জানালা বেশ উঁচু, জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম কিছুক্ষণ। হোস্টেলের ডর্মে পরিচয় হলো ফ্রান্স থেকে আশা ভিক্টরের সাথে প্যারিস থেকে আসা ভিক্টর আর আমার পরের দিনের অভিযাত্রার ম্যাপ ছিল একই দিকে। আমরা দু’জনই এক সাথে যাওয়ার প্ল্যান করলাম। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই আমি আর ভিক্টর রওনা দিলাম মেস্তিয়া টাউনের উদ্দেশে, ৪ ঘণ্টার পাহাড়ি পথ। গাড়ি একটু পরপরই বাঁক নিচ্ছে পাহাড়ি রাস্তায়। আমার কাছে খুব অপূর্ব লাগছিল। চারপাশের চমৎকার দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা যাচ্ছিলাম। আমাদের যাওয়ার পথে পড়ল লেক, পাহাড় আর সারিসারি পাইনের বন। হঠাৎ মিনিবাসটি এসে থামলো জটলা বাধা অনেকগুলো মানুষের সামনে, তাদের সবার হাতে লাঠি। গ্রামটির নাম সম্ভবত লেশগুয়ানি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবাই ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড়ালো। সবাই একটু হতচকিয়ে উঠলো আমাদের মিনিবাসের সবাই ট্যুরিস্ট। আমি জানলা দিয়ে সামনের দিকে তাকালাম। গ্রামবাসী সবাই রাস্তায়, সবার বিক্ষোভমুখী বজ্রকণ্ঠ। রাস্তায় বড় বড় পাথর ফেলানো, ওরা রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে এক সপ্তাহের জন্য। গ্রামবাসীর কিছু দাবি-দাওয়া আছে, তা মেনে নিতে হবে। নতুবা তারা কাউকেই ছাড়বে না। একটু পরেই দেখলাম সরকার দলের একজন মহিলা নেত্রী, সামনে কিছু টিভি সাংবাদিক তাদের ভাষায় দু-চার মিনিট কথা বললেন। অন্যদের পাত্তা না দিয়ে খুব রাগ দেখিয়ে তার গাড়িতে চড়ে চলে গেলেন একটু পরই দেখলাম বিশাল পুলিশ বাহিনী এলো বন্দুক তাক করতে করতে। লাইন ধরে তারা বন্দুক তাক করে ব্যারিকেডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এ দিকে উত্তপ্ত জনগণ পুলিশের মুখোমুখি লাঠি আর ইট-পাথর নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমরা একটু বিচলিত হয়ে পড়লাম, আমাদের মিনিবাসের পজিশন দু-পক্ষের মাঝামাঝি যে যেদিক থেকেই আক্রমণ করবে আমাদের গায়ে এসে পড়বে।
আমি বিপদের অশনি সঙ্কেত টের পেলাম। যুদ্ধের সময় অনেক নিরাপরাধ মানুষ যেভাবে মরে, এই গাড়ির ভেতর আমাদের সেভাবেই মরতে হবে। এলোপাতাড়ি গুলি করলে আমাদের কারো রক্ষা নেই। আমাদের ড্রাইভারকে আমি বললাম দরজা খুলে দিতে। দেখতে পাচ্ছি পুলিশের দিকে লক্ষ্য করে জনগণ ইট-পাথর ছুঁড়ে মারছে। এখনই হয়তো কয়েকটি লাশ পড়ে যেতে পারে সেখানকার নেতা-নেত্রীরা কেউ কেউ হাত উঁচু করে বলছে থামো থামো। কেউ কথা শুনছে না, গ্রামবাসী উত্তাল। দাবি আদায়ের জন্য তারা মরতে প্রস্তুত। আমাদের গাড়ির ওপর এসে কিছু ইট-পাথর পড়ল। তৎক্ষণাৎ আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লাম বাইরে, কি উত্তাল আমরা সবাই নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে থাকলাম। কেউ গাছের পেছনে, কেউ জঙ্গলে, কেউ গ্রামের বাড়ির পেছনে লুকাতে থাকলাম। কেউ আবার পাশে কোথাও দাঁড়িয়ে দেখছে। আমি আর ভিক্টর কিছু দূরত্বে একটা বড় গাছের কাছাকাছি নিজেদের আড়াল করলাম যেন গুলি এলেও মাটির সাথে বুক মিশিয়ে শুয়ে পড়তে পারি জঙ্গলের কাছাকাছি। আমাদের গ্রুপের ১৫ জন কে কোথায় অবস্থান করছে কিছুই বুঝতে পারছি না। শুনতে পেলাম পাহাড়ের দিকে গুলির আওয়াজ যাচ্ছে। ভিক্টর আমাকে বারবার বলছে ভয় পেও না। ভিক্টরকে বললাম, আমি ভয় পাই না, তবে অক্ষতভাবে বাঁচতে চাই। আমাকে দেশের পতাকা হাতে বিশ্বভ্রমণ শেষ করতে হবে।
ওর চোখে মুখে কিছুটা অস্বস্তি দেখলাম, ও বলছে এক সপ্তাহ আটকে থাকলে আমরা কিভাবে থাকবো এখানে ওকে বললাম, চলো আমরা হেঁটে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, পাহাড়ের ওপর দিয়ে হেঁটে মেস্তিয়া চলে যাই। ও বললো, আমার জিনিসপত্র, পাসপোর্ট গাড়ির ভেতর ব্যাগের মধ্যে। ড্রাইভের গাড়ি লক করে দিয়েছে কি না জানি না। ওর জন্য খারাপ লাগলো। পাসপোর্ট, টাকা-পয়সা গায়েব হয়ে গেলে অনেক ঝামেলায় পড়তে হবে। যদিও অনেক সময় টাকা পাসপোর্টের চেয়ে জীবন বাঁচানো গুরুত্বপূর্ণ।
আমি খানিকটা এগিয়ে যেতে থাকলাম। হঠাৎ ড্রাইভার কোথা থেকে এসে আমার হাত ধরে বললো, তুমি যেও না এখন, একটা বিপদ ঘটে যেতে পারে। একটু পর একজন মধ্যবয়স্ক লোক পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম, পরিস্থিতি কিছুটা ভালো। আমি মনে মনে ভাবলাম, জর্জিয়ার জঙ্গলে যদি এভাবে ৭ দিন আটকে থাকতে হয় তবে ভালোই হবে আমার মনে নতুন এডভেঞ্চারের আলো উদয় হলো। আমাদেরকে এই জঙ্গলে পাহাড়ি ঘাসের ওপর ঘুমাতে হবে, জঙ্গলের ফল খেয়ে থাকতে হবে, ঝরনার পানি খেয়ে বাঁচতে হবে। প্রকৃতির এই নির্যাস খেয়ে অনেক দিন বাঁচা যাবে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। এবার পরিস্থিতি দেখার জন্য আস্তে আস্তে পা ফেলে আমরা দু’জন হাঁটতে থাকলাম সামনের দিকে। পেয়ে গেলাম আমাদের গ্রুপের কয়েকজনকে। আমরা তখন কয়েকজন ড্রাইভারকে খুঁজতে থাকলাম। এক সময় ভিড়ের মধ্যে ড্রাইভারকে খুঁজে পাওয়া গেল, আমাদের গাড়িটা এক কোনায় পাথরের ব্যারিকেড ছাড়িয়ে পার হয়েছে কোনোভাবে, আমরা একটু স্বস্তি খুঁজে পেলাম। কোনোভাবে গাড়ির কাছাকাছি পৌঁছলাম। তখন পুলিশ আর জনগণের বাগি¦ত-া, কিছু লোক হতাহত হয়েছে। আর সবার দিকে সাংবাদিকদের ক্যামেরাগুলো তাক করা। এর মধ্যে আমাদের ড্রাইভার সুযোগ খুঁজছে আমাদের নিয়ে ছুটে যাওয়ার। ড্রাইভার আমাদের ভেতরে ঢুকিয়ে গাড়ি লক করে দিয়েছে পাহাড়ি ড্রাইভার, অনেক দক্ষ জীবন-মৃত্যুর এমন সন্ধিক্ষণে অনেকবারই আমাকে পড়তে হয়েছে; কিন্তু এটা একটু ভিন্ন অভিজ্ঞতা দিলো আমাকে, নতুন করে ভাবতে শিখালো মানুষের দাবি কতটা প্রখর হতে পারে। নিজের অধিকার আদায়ে এরাও কতটা বদ্ধপরিকর তখন বিকেলের সূর্য আকাশে আভা ছড়াচ্ছিল। প্রকৃতির ভাঁজে ভাঁজে আমাদের ড্রাইভার যেন আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
লেখক: বাংলাদেশি নারী পরিব্রাজক