স্বদেশ ডেস্ক:
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) মধ্যরাত থেকে দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে’ আসার দাবি করা হলেও আরো এক দফা বাড়িয়ে শনিবারও দেয়া হয়েছে কারফিউ।
সরকার বলছে, ‘সাবধানতার কারণে এখনো কারফিউ’ বহাল আছে। আর যত দিন পর্যন্ত পরিস্থিতি সার্বিকভাবে নিয়ন্ত্রণে না আসবে, তত দিন কারফিউ বহাল থাকবে।
যেভাবে শুরু হলো এবারের কারফিউ
কোটা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সাথে সংঘাতে জড়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
আন্দোলন ঘিরে ব্যাপক সংঘর্ষের পর বৃহস্পতিবার থেকেই বন্ধ হয়ে যায় ইন্টারনেট সেবা, আর তার আগেই বন্ধ করে দেয়া হয় মোবাইল ইন্টারনেট।
এমন প্রেক্ষাপটে শুক্রবার সকাল থেকেই ঢাকা শহরে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। পরে ওইদিন দিবাগত রাত ১২টা থেকেই জারি করা হয় কারফিউ।
প্রায় ১৭ বছর পর বাংলাদেশে আরেকটি কারফিউ জারির ঘটনা দেখা গেল। এর আগে, ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সবশেষ কারফিউ জারি করা হয়েছিল।
কত দিন চলবে কারফিউ?
২০ জুলাই থেকে জারি হওয়া কারফিউ শনিবারও থাকবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
এর আগে, বুধবার সাংবাদিকদের সাথে আলাপের সময় ‘স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরত এসেছে’ বলে দাবি করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
এদিকে ‘জনমনে স্বস্তি ফিরে এলেও সাবধানতার কারণে কারফিউ রাখা হয়েছে বলে’ বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
মন্ত্রী বলেন, ‘কারফিউ দেয়ার পরেই কিন্তু এই উচ্ছৃঙ্খল টেরোরিস্ট (উগ্রবাদী) যারা ছিল তাদের দমন করা গেছে। এখন জনমনে স্বস্তি এসেছে। সম্পূর্ণভাবে ফিরতে হয়তো কিছু সময় লাগবে। সেজন্য আমরা সাবধানতার কারণে এখনো কারফিউ রেখেছি।’
কারফিউ চলাকালে শুরুর দিকে সারাদেশেই প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়। মঙ্গলবার থেকে কারফিউ শিথিলের সময় বাড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন জেলায় আলাদাভাবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেয়া হয় কারফিউ।
বুধবার থেকে ঢাকা, নরসিংদী, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ বাদে বাকি জেলাগুলোর কারফিউর সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেয়া হয় স্থানীয় প্রশাসনের হাতে।
কিন্তু এই কারফিউ চলবে কতদিন?- এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন যে জনমনে স্বস্তি ফিরছে। এ কারণেই দুই ঘণ্টা থেকে চার ঘণ্টা, চার ঘণ্টা থেকে পাঁচ ঘণ্টা এবং এটা (কারফিউ) ক্রমান্বয়ে আমরা কমিয়ে আনব।’
তবে সম্পূর্ণরূপে আশ্বস্ত না হওয়া পর্যন্ত কারফিউ চলবে বলে জানান তিনি।
তিনি যোগ করেন, ‘জনমনে যখন সম্পূর্ণ স্বস্তি ফিরবে, আমরা যখন মনে করবো জঙ্গিরা আর বাংলাদেশে এরকম অসহনীয় নৃশংসতা করতে পারবে না তখন কারফিউ উঠবে।’
কারফিউ কী?
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রকাশনা সংস্থা ম্যারিয়াম ওয়েবস্টার বলছে, কারফিউ বলতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জনসাধারণের গতিবিধিকে নিয়ন্ত্রণ করা বোঝায়। এর ফলে সাধারণ মানুষের ঘর থেকে বের হওবার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ থাকে।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার তথ্যমতে, কারফিউ শব্দের উৎপত্তি চর্তুদশ শতকে, পুরানো ফ্রেঞ্চ শব্দ ‘Cuevrefu’ থেকে, যার অর্থ আগুন ঢাকা।
ফ্রান্সে সে সময়কার বেশিভাগ বাড়িই তৈরি করা হতো কাঠ দিয়ে আর ঘর গরম রাখতে মেঝের মাঝখানে আগুনের ব্যবস্থা করা হতো।
কিন্তু এর ফলে দুর্ঘটনার শঙ্কাও থাকতো। তাই রাতের বেলা আগুনের হাত থেকে নিজের এবং প্রতিবেশীর ঘর দুর্ঘটনা থেকে বাঁচাতে সন্ধ্যার সময় একটি ঘণ্টা বাজানো হতো। সেই ঘণ্টাকে ডাকা হতো কারফিউ।
অনলাইনে আইনি তথ্য দেয়া থমসন রয়টার্সের একটি প্রতিষ্ঠান ফাইন্ড ল বলছে, তিন ধরনের কারফিউ আইন আছে যার একটি ‘জরুরি কারফিউ আইন’।
সাধারণত নির্দিষ্ট সঙ্কটের প্রতিক্রিয়ায় স্থানীয়, রাজ্য বা ফেডারেল সরকারের অস্থায়ী আদেশে জরুরি কারফিউ আইন জারি করা হয়। যেমন-
– প্রাকৃতিক দুর্যোগ (হারিকেন, দাবানল, বিস্ফোরণ ইত্যাদি)
– জনস্বাস্থ্য সঙ্কট (রোগ, মহামারি ইত্যাদি)
– নাগরিক সঙ্কট (বিক্ষোভ, সহিংসতা, সন্ত্রাসী হুমকি ইত্যাদি)।
বিশেষ ক্ষমতা আইনে কারফিউ জারি
১৯৭৪ সালে প্রণীত বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৪ ধারার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশে ‘কারফিউ’ বা ‘সান্ধ্য আইন’ প্রণয়ন করা হয়।
এতে বলা হয়, ‘কোনো জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা মহানগরী এলাকায় পুলিশ কমিশনার, সরকারের নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে নির্দেশ করিতে পারেন যে আদশে উল্লিখিত অব্যাহতি সাপেক্ষে আদেশে উল্লিখিত এলাকা বা এলাকাসমূহে উপস্থিত কোনো ব্যক্তি, আদেশে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তি কর্তৃক প্রদত্ত লিখিত অনুমতি ব্যতীত, ঘরের বাহির হইবে না।’
অর্থাৎ সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কোনো জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নির্ধারিত সময়ের জন্য জনসাধারণের চলাচলে বিধিনিষেধ দিতে পারবেন। তবে মহানগরীর ক্ষেত্রে চলাচলে বিধিনিষেধ দেয়ার এই ক্ষমতা থাকে পুলিশ কমিশনারের।
বিশেষত কোনো সঙ্কটময় অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ দেয়া হয় বলে জানান পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক।
তিনি বলেন, ‘যখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়, দুষ্কৃতিকারীদের দাপট বেড়ে যায় এবং জনমনে অস্বস্তি ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয় এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে স্বাভাবিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিমশিম খায় তখন বাধ্য হয়ে কারফিউ দেয়া হয়।’
কেউ যদি এই আইন লঙ্ঘন করে তবে আইনে এক বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা দেয়ার বিধান রয়েছে।
কারফিউ আর ১৪৪ ধারার মধ্যে পার্থক্য কী?
কারফিউ এবং ১৪৪ ধারা- এই দুটি আইনের প্রয়োগই হয় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে। তবে এর প্রয়োগ হয় ভিন্ন দু’টি আইনে।
কারফিউ জারি করা হয় ১৯৭৪ সালে প্রণীত বিশেষ ক্ষমতা আইনে আর ১৪৪ ধারা জারি করা হয় বাংলাদেশের ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮-এর মাধ্যমে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই দু’টি আইনের মধ্যে কারফিউ বেশি ‘স্ট্রিক্ট’ বা কঠোর।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘বিশৃঙ্খলা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে কর্তৃপক্ষ ১৪৪ ধারায় পাঁচজনের বেশি মানুষরে জমায়েত নিষিদ্ধ করতে পারে। তারপরও কেউ চেষ্টা করলে পুলিশকে ওই জমায়েত ভঙ্গ করার ক্ষমতা দেয়া হয়। আর কারফিউ আরো কড়া। এতে সবার জন্য ঘর থেকে বের হওয়া নিষিদ্ধ থাকে।’
অর্থাৎ জনসাধারণ জড়ো হওয়ার ফলে যদি কোথাও মারামারি বা সহিংসতা বেধে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দেয় তবে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ কমিশনার ১৪৪ ধারা জারি করতে পারেন।
অন্যদিকে, কারফিউ দেয়া হলে নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সার্বিকভাবেই চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
এ সময় বিনাপ্রয়োজনে নাগরিকরা বাইরে বের হতে পারে না। বন্ধ থাকে অফিস-আদালত ও কলকারখানা।
কারফিউ জারি করলেই কি সেনাবাহিনী নামাতে হয়?
শনিবার কারফিউ জারি করার সাথেই দেশব্যাপী সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দেয় সরকার। এর আগেও দেশে কারফিউ দেয়ার সময় সেনাবাহিনীকে মাঠে দেখা গেছে।
তাহলে কি কারফিউর সময় সেনাবাহিনী মোতায়েনের কোনো বিধান রয়েছে?
আইনজীবী শাহদীন মালিক জানান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে বেসামরিক প্রশাসনকে সাহায্য করতে সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাইরে নিয়োগ করা হতে পারে।
তবে কারফিউর সাথে মাঠে সৈন্য নামানোর সরাসরি কোনো যোগসূত্র নেই।
বরং ব্যারাকে থাকায় সাধারণ সেনাবাহিনীকে নিয়ে মানুষের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক যে ভাবনা কাজ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তার একটা প্রভাব কাজ করে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।
সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘কারফিউ দিলে তো তা এনফোর্স (প্রয়োগ) করতে হবে, বলবৎ করতে হবে। বিদ্যমান পুলিশ বাহিনী, বিজিবি, আনসার- এদের দিয়ে যদি করা যায় তাহলে তো সেনাবাহিনী লাগে না।’
সাবেক এই পুলিশ প্রধানের মতে, সেনাবাহিনী থাকলে একদিকে মানুষের মনে একটা ভীতি থাকে, অন্যদিকে স্বস্তিতে থাকে শান্তিপ্রিয় জনগণ।
এছাড়াও সাধারণত ব্যারাকে থাকায় সেনাবাহিনী যখন মাঠে নামে তখন জনসাধারণের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে। ফলে তারা ঠিক ততটা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে না।
তিনি বলেন, ‘এ জন্য আমাদের দেশে কারফিউ দেয়া হলে তা এনফোর্স (প্রয়োগ) করার জন্য সেনাবাহিনী নামানোর কালচার আছে। কিন্তু সেনাবাহিনী নামাতে হবে এটা মেন্ডাটরি (আবশ্যিক) না।’
সূত্র : বিবিসি