স্বদেশ ডেস্ক:
টিকা পরিকল্পনায় তালগোল অবস্থা থেকে যেন বেরোতেই পারছে না স্বাস্থ্য বিভাগ। টিকা কর্মসূচি নিয়ে একেক সময় একেক রকম সিদ্ধান্তের কথা জানানো হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে। কয়েকদিন আগেও বলা হয়েছিল, ৭ আগস্ট থেকে এক সপ্তাহে প্রায় এক কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই পরিকল্পনা থেকে স্বাস্থ্য বিভাগ সরে এসেছে।
তিনদিন আগেও টিকা কর্মসূচির সঙ্গে যুক্তরা বলেছিলেন, ৭ আগস্ট একদিনেই ৩২ লাখ মানুষকে গণটিকা দেওয়া হবে। সেই পরিকল্পনাও কাটছাঁট করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শনিবার শুধু একদিনে নয় বরং ৩২ লাখ মানুষকে ৬ দিনে টিকা দেওয়া হবে। এর আগে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী সবাইকে গণটিকা দেওয়ার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল।
কিন্তু গতকাল ঘোষিত ছয় দিনের টিকা কর্মসূচিতে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সীদের টিকা দেওয়া হচ্ছে না বলে জানানো হয়েছে। এমন বাস্তবতার মধ্যেই করোনা ভাইরাসের ডেল্টা ধরনের সংক্রমণের লাগাম টানতে আজ শনিবার দেশজুড়ে ১৫ হাজারেরও বেশি টিকাদান কেন্দ্রে শুরু হচ্ছে গণটিকা কর্মসূচি। এই গণটিকা কার্যক্রম
শুরু করতে ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। সারাদেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে এই টিকা কর্মসূচিতে যাতে কোনো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি না হয়- এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সজাগ থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে।
ইতোমধ্যে টিকা পৌঁছে গেছে জেলা পর্যায়ে। সারাদেশে ৪৬০০টি ইউনিয়ন, ১০৫৪টি পৌরসভা, সিটি করপোরেশন এলাকার ৪৩৩টি ওয়ার্ডে চলবে এই বিশেষ টিকাদান কর্মসূচি। ১৫ হাজারের বেশি টিকাদান কেন্দ্রে ৩২ হাজার ৭০৬ জন টিকাদানকারী এবং ৪৮ হাজার ৪৫৯ জন স্বেচ্ছাসেবী এই কর্মসূচিতে যুক্ত থাকবেন।
এই কর্মসূচি যেন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায়- এ ব্যাপারে সহযোগিতা করতে ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে নেতাকর্মীদের মাঠে থাকতেও বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে টিকা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত একাধিক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমাদের সময়ের কাছে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করেছেন। অবশ্য একাধিক জেলার পুলিশ সুপার আমাদের সময়কে বলেছেন, তারা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এড়াতে সজাগ রয়েছেন।
গণটিকা প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক আমাদের সময়কে বলেন, সরকার এখনো টিকা প্রদান নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। গণটিকা নিয়ে সরকারকে কৌশলগত পরিকল্পনা করতে হবে।
প্রতি ওয়ার্ডে স্থাপন করতে হবে টিকা কেন্দ্র। উপজেলায় টিকা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এলাকার পল্লী চিকিৎসক ও বয়স্কদের আগে টিকা দিতে হবে। এ কাজ বাস্তবায়নে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে, মসজিদে মাইকিং করতে হবে। কোভিড প্রতিরোধে টিকা ও সচেতনতার বিকল্প নেই। এটাতে সফল না হলে বাংলাদেশের জন্য ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি আসতে পারে বলে সতর্ক করেন তিনি।
গণটিকা কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হবে এ নিয়ে গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে এক অনলাইন সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ইউনিয়ন পরিষদের কেন্দ্রে ৬০০ জন এবং পৌরসভার প্রতিকেন্দ্রে ২০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে। ওই সভায় স্বাস্থ্য বিভাগ, পুলিশের রেঞ্জ ডিআইজি, সব মহানগর পুলিশ কমিশনার, সব জেলার পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জন, সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যুক্ত ছিলেন। সেখানেই গণটিকা কার্যক্রম এবং টিকা কেন্দ্রের বিশৃঙ্খলা এড়াতে বেশকিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়।
ঝিনাইদহ জেলার পুলিশ সুপার মুনতাসিরুল ইসলাম গত রাতে আমাদের সময়কে বলেন, তার জেলায় টিকাকেন্দ্রে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এড়াতে পুলিশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আজ শনিবার যারা টিকা নেবেন তাদের আগেই টিকার টোকেন দেওয়া হয়েছে। যারা টোকেন পেয়েছেন তারাই কেবল আজ টিকা নিতে আসবেন। আর যারা পাননি তারা পরে টিকা নিতে পারবেন। এ ছাড়া সদর হাসপাতালে টিকা কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
নীলফামারী জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. জাহাঙ্গীর কবির গত রাতে বলেন, আমরা আজ সকাল থেকে গণটিকা দেব। ইউনিয়নের প্রতিকেন্দ্রে ৬০০ জন এবং পৌরসভার কেন্দ্রের ২০০ জনকে শনিবার (আজ) টিকা দেওয়া হবে। কারা টিকা পাবেন সেই নিবন্ধনের বিষয়টি দেখভাল করছেন পৌরসভার মেয়র এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। ইতোমধ্যে টিকা হাতে পেয়েছেন এবং এ ব্যাপারে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
এদিকে গতকাল ঢাকার মহাখালীতে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের সভাকক্ষে টিকা কার্যক্রম নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে টিকাদানের পরিসর বাড়াতে যাচ্ছে সরকার। এর অংশ হিসেবে আগামী ৭ থেকে ১২ আগস্ট ছয় দিনে সারাদেশের ১৫ হাজারের বেশি টিকাদান কেন্দ্রে প্রায় ৩২ লাখ মানুষকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হবে। তবে ছয় দিনের টিকা কর্মসূচিতে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সীদের এখন গণটিকা দেওয়া হচ্ছে না।
কেন দেওয়া হচ্ছে না তার ব্যাখ্যায় ডা. খুরশীদ বলেন, ১৮ বছর বয়সী অনেকের ভোটার আইডি কার্ড নেই। এতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। তাই টিকাদানের বয়স ১৮ না করে ২৫ নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ওই বয়সসীমার ওপরে যারা আগেই সুরক্ষা অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন করেছেন, তাদের নিবন্ধনের সময় উল্লেখ করা কেন্দ্রে গিয়েই এসএমএস পাওয়ার ভিত্তিতে টিকা নিতে হবে। আর ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন এলাকায় ছয় দিনের বিশেষ ‘ক্যাম্পেইনের’ টিকাদান আলাদাভাবে পরিচালিত হবে। পঁচিশোর্ধ্ব যারা নিবন্ধন করতে পারেননি, তারাও এ সময় টিকা নিতে পারবেন। পঞ্চাশোর্ধ্বরা, নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠী এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন।
স্বাস্থ্য বিভাগের ৬ দিনের টিকা কর্মসূচিতে ৭ আগস্ট দেশের সব ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে টিকা কার্যক্রম শুরু হবে। ৮ ও ৯ আগস্ট ইউনিয়নের যেসব ওয়ার্ডে ৭ তারিখ নিয়মিত টিকাদান চালু ছিল, সেসব ওয়ার্ডে এবং পৌরসভার বাদ পড়া ওয়ার্ডে টিকা দেওয়া হবে। ৭ থেকে ৯ আগস্ট সিটি করপোরেশন এলাকায় টিকা কার্যক্রম চলবে। ৮ ও ৯ আগস্ট দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায় টিকা দেওয়া হবে। ১০ থেকে ১২ আগস্ট ৫৫ বছরের বেশি বয়সী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যেও টিকাদান কার্যক্রম চলবে।
৭ থেকে ১২ আগস্টের মধ্যে প্রতি জেলায় একদিন করে এই কর্মসূচি চলবে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেছেন, ঘাটতি থাকলেও সবাইকেই টিকা দিতে সরকার বদ্ধপরিকর। কোভ্যাক্স এবং বিভিন্ন টিকা উৎপাদনকারীদের সঙ্গে কথা হয়েছে। দেশেও টিকা উৎপাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। ‘নেতিবাচক চিন্তা ও কুসংস্কার’ পরিহার করে টিকা নিয়ে সবাইকে কোভিড প্রতিরোধে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান ডা. খুরশীদ আলম।
গত দশ দিনে দেশে ৩০ লাখ ডোজ কোভিড টিকা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আমরা যদি বড় আকারে ভ্যাকসিন ক্যাম্পেইন না করতে পারি, তা হলে বিরাট জনগোষ্ঠীকে কাভার করা যাবে না। এটা আমাদের কাছে একটি পাইলট প্রজেক্ট। এ থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করছি। এখন পর্যন্ত দেশে ১ কোটি ৯৯ হাজারের বেশি মানুষকে টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
করোনা ভাইরাস মহামারীতে আক্রান্ত ও মৃত্যু ঠেকাতে সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে সরকার ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ১৪ কোটি নাগরিককে বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করে। এরপর গত ৭ ফেব্রুয়ারি গণটিকাদান শুরু হলেও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা টিকা সময়মতো না পাওয়ায় তার গতি ব্যাহত হয়। উন্নয়নশীল বিশ্বে টিকাদান পর্যবেক্ষণে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্সের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, টিকাদানে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলংকা থেকে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
এই অবস্থা থেকে উত্তরনে চীন থেকে টিকা কিনছে সরকার। পাশাপাশি টিকা সরবরাহের বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম কোভ্যাক্স থেকেও টিকা আসতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মডার্না, ফাইজার ও সিনোফার্মের টিকা দেওয়া হচ্ছে। প্রত্যেকটিরই দুটি ডোজ নিতে হয়।
সরকারের কেনা, উপহার পাওয়া এবং কোভ্যাক্সের মাধ্যমে পাওয়া টিকা মিলিয়ে এ পর্যন্ত দেশে এসেছে ২ কোটি ৫৬ লাখ ৪৩ হাজার ৯২০ ডোজ টিকা। সরকারের টিকাদান টাস্কফোর্স বলছে, বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ নাগরিককে টিকা দিতে ১৩ কোটি ১৮ লাখ ডোজ টিকা লাগবে। আর ৬০ শতাংশকে টিকা দিতে লাগবে প্রায় ২০ কোটি ডোজ টিকা।
বাংলাদেশ এখন যে হারে টিকা দিচ্ছে, তাতে এই বছর নাগাদ ১৯ দশমিক ৬৪ শতাংশকে টিকা দেওয়া সম্ভব হবে বলে টাস্কফোর্সের অনুমান।
গত ২৬ জানুয়ারি টিকার জন্য নিবন্ধন শুরু হয়। তখন শুধু ৪০ বছর বা এর বেশি বয়সীরা নিবন্ধনের সুযোগ পাচ্ছিলেন।
মাঝে টিকার সংকট চললে বয়সসীমা আর বাড়ানো হয়নি। নতুন টিকা আসার পর গত ৫ জুলাই আগের চেয়ে আরও পাঁচ বছর কমিয়ে নিবন্ধনের জন্য যোগ্যদের বয়স ৩৫ বছর করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরপর ১৯ জুলাই আরও ৫ বছর কমিয়ে ৩০ বছর করা হয়েছিল। গ্রামপর্যায়ে টিকাদান শুরুর আগে সেই বয়সসীমা আরও ৫ বছর কমিয়ে ২৫ বছর করা হয়।