স্বদেশ ডেস্ক:
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ‘লকডাউনের’ আদলে সাত দিনের কঠোর বিধিনিষেধের দ্বিতীয় দিনও বেশ শিথিলতার মধ্যে কেটেছে। সরকারের এই ‘কঠোর’ পদক্ষেপেও মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে বা স্বাস্থ্যবিধি মানার গরজ তৈরি হয়েছে বলে রাস্তাঘাটে চলাচলরত মানুষকে দেখে মনে হয়নি। এদিনও যানবাহন সংকটে কর্মস্থলমুখী মানুষের ভোগান্তি ছিল বেশি, তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে সড়কে। আর্থিক টানাপড়েনে নিম্নআয়ের ও শ্রমজীবী মানুষের সংকট আরও বেড়েছে। মার্কেট খোলার দাবিতে এদিনও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছেন ব্যবসায়ী-কর্মীরা।
এ ঢিলেঢালার মধ্যেই কর্মস্থলগামী মানুষের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশন এলাকায় সকাল-সন্ধ্যা গণপরিবহন চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আজ বুধবার থেকেই এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
করোনার সংক্রমণ হঠাৎ করে বাড়তে থাকায় সরকার সাত দিনের জন্য চলাচল ও জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে কঠোর বিধিনিষেধ জারি করে। ব্যবস্থাটি ‘লকডাউন’ না হলেও লোকজন একে তা-ই বলছে। কিন্তু যে কারণে এ কড়াকড়ি সেই স্বাস্থ্যবিধি মানা ও সচেতনতার কোনো বালাই দেখা যায়নি। মানুষ আগের
মতোই চলাফেরা করছে। মাস্ক এখনো থুতনিতেই আছে। অলিগলিতে দোকানপাট দিব্যি চলছে। ফলে ‘লকডাউনের’ দ্বিতীয় দিন গতকাল মঙ্গলবারও ঢিলেঢালাভাব ছিল। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ির পাশাপাশি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও রিকশা চলাচল করেছে পুরোদমে। মানুষের চলাচলও বেড়েছে। মার্কেট ও শপিংমলগুলো বন্ধ থাকলেও অলিগলি ও এলাকাভিত্তিক দোকানপাট খোলা ছিল স্বাভাবিক সময়ের মতোই। সেগুলোয় দোকানি-ক্রেতা কারোর মধ্যেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রণবতা তেমন দেখা যায়নি। চলাচল নিয়ন্ত্রণে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের কথা বলা হলেও অফিস-আদালত, ব্যাংক, গার্মেন্টস, শিল্পকারখানাসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান চালু থাকায় গত সোমবার ‘লকডাউনের’ প্রথমদিন থেকেই তা মানার ক্ষেত্রে মানুষের সাড়া পাওয়া যায়নি বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে অফিস চালু রেখে গণপরিবহন বন্ধ করায় কর্মজীবীদের ভোগান্তি ঠেকেছে চরমে। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে অফিসগামীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ অফিস তার স্টাফদের যাতায়াতের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করেনি। গণপরিবহনও বন্ধ। ফলে বাড়তি টাকা দিয়ে বিকল্প উপায়ে অফিসে যেতে হচ্ছে।
গতকাল সকালে মালিবাগ, শান্তিনগর, নয়া পল্টন, কাকরাইল ও মতিঝিল ঘুরে সড়কে আগের দিনের চেয়ে বেশি ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভাড়া করা বাসের চলাচল চোখে পড়েছে। কোনো কোনো সড়কে ট্রাফিক সিগন্যালে দেখা গেছে যানবাহনের লম্বা লাইন। মার্কেটগুলো বন্ধ থাকলেও মিষ্টির দোকান, গাড়ির গ্যারেজ, লন্ড্রিসহ অনেক বিভিন্ন ধরনের দোকানপাট খোলা দেখা গেছে, যেগুলো ‘লকডাউনে’ খোলা থাকার কথা নয়।
সকাল ১০টায় রাজধানীর মাতুয়াইল সাদ্দাম মার্কেট বাসস্ট্যান্ডে গাড়ির জন্য অপেক্ষায় ছিলেন শতশত কর্মজীবী মানুষ। তাদের একজন মো. শফিকুল ইসলাম। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও অফিসে যাওয়ার জন্য সিএনজিচালিত অটোরিকশা পাননি। বেসরকারি চাকরিজীবী শফিকুল বলেন, লকডাউনে যত ভোগান্তি সব স্বল্প আয়ের মানুষের। আমাদের তো ব্যক্তিগত গাড়ি নেই, যাতায়াতের জন্য বাড়তি খরচ করার মতো অতো টাকাও নেই। অফিস থেকেও যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়নি। বেশি টাকা দিয়েও অটোরিকশা পাওয়া যাচ্ছে না। এ কী বিপদ!
নিউসুপার মার্কেটের দোকান কর্মচারী মো. মিজানুর রহমান। লকডাউনে মার্কেট বন্ধ থাকায় তার আয় রোজগারও বন্ধ। মিজান বলেন, দিন চুক্তিতে বেতন পাই আমি। একদিন কাজ করলে ৩০০ টাকা। দোকান বন্ধ থাকলে আমার বেতনও বন্ধ থাকে। আজ দুদিন হলো একটা টাকাও আয় নাই। গতবার লকডাউনে অনেক ঋণ করে সংসার চালিয়েছি। সেই ঋণই শোধ করতে পারিনি। এখন প্রতিদিন নিউমার্কেট এলাকায় বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছি দোকান খোলার দাবিতে। জানি না কপালে কী আছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, লকডাউন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়বে দিনমজুর, শ্রমিকসহ নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষেরা। এ অল্প দিনের লকডাউনে ধনী ও মধ্যবিত্তের খাদ্য সংকট না হওয়ারই কথা। তাদের ক্ষতি হলেও অল্প দিনে পুষিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষদের না খেয়ে থাকতে হবে। তাই এসব মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যের জোগান রাখা দরকার। এ ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক হটলাইন চালু করার পাশাপাশি ব্যাপক প্রচার চালানোর পরামর্শ দেন তিনি।
ভোক্তা অধিকারবিষয়ক সংগঠন কনসাস কনজ্যুমার্স সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, লকডাউনের ঘোষণায় জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। কারণ বিগত সময়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে ক্রান্তিকালে বাজার নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। তবে সচেতন নাগরিক হিসেবে সচ্ছল মানুষের বিবেক থাকা উচিত যে, অতিরিক্ত কেনাকাটায় বাজারে যে অস্থিরতা তৈরি হয়, তার দুর্ভোগ পোহাতে হয় নিম্ন আয়ের মানুষদের। কারণ, দাম বাড়লে উচ্চবিত্তদের কিছু যায় আসে না, কিন্তু না খেয়ে থাকতে হয় দরিদ্রদের।
গতকালও শান্তিনগর বাজারের সামনে ফুটপাতে কর্মজীবী শ্রমিকদের কাজের অপেক্ষায় সড়কে বসে থাকতে দেখা গেছে। দুপুর ১২টার দিকে রহিম নামের একজন শ্রমিক জানান, তিনি গত সপ্তাহে দিনাজপুর থেকে ঢাকায় এসেছেন কাজের সন্ধানে। লকডাউনে পড়ে এখন বাড়ি যেতে পারছেন না। ঢাকায় কোনো কাজও পাচ্ছেন না।
ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ অব্যাহত
মার্কেট খুলে দেওয়ার দাবিতে টানা তৃতীয় দিনের মতো রাজধানীর নিউমার্কেট ও মিরপুর এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন ব্যবসায়ীরা। গতকাল সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চাঁদনী চক শপিং কমপ্লেক্সের সামনে বিক্ষোভ করেন ব্যবসায়ী ও দোকান মালিকেরা। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীরা দিনের নির্দিষ্ট একটা সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে মার্কেট খোলা রাখার দাবি জানান। মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরের পাশে বেলা ১১টার দিকে শতাধিক ব্যবসায়ী মানববন্ধন করছেন। তাদের দাবি, স্বল্প পরিসরে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার জন্য হলেও দোকানপাট খুলে দেওয়া হোক।
নিউ সুপার মার্কেট (দক্ষিণ) বণিক সমিতির সভাপতি শহীদুল্লাহ শহীদ বলেন, বইমেলা চলতে পারলে মার্কেট কেন বন্ধ থাকবে। চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মনজুর আহমেদ মনজু বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা আন্দোলন করে যাবেন। ঈদ ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। পাইকারি ব্যবসার মূলত এখনই সময়।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, করোনার এমন নাজুক পরিস্থিতির মাঝে রাস্তায় বিক্ষোভ, অবরোধ আমাদের কারোরই কাম্য নয়। কিন্তু ব্যবসায়ীদের কিছু করার নেই। গত বছরের বিপুল লোকসানে এ বছর আতঙ্কে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আমরা সরকারে কাছে আবেদন করেছি, মার্কেট ব্যবসায়ীদের দিকটাও বিবেচনা করা হোক। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে দিনের একটা অংশ দোকানপাট-মার্কেট খোলা থাকলে বড় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবেন মার্কেট ব্যবসায়ীরা।
এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় একই দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন ব্যবসায়ীরা। আমাদের সময়ের ব্যুরো, নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
গাজীপুর : সকালে টঙ্গী বাজারে গাজীপুর মহানগর ব্যবসায়ী সংগঠন মানববন্ধন করে। ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা জানান, ঈদ সামনে রেখে ধারদেনা করে ব্যবসা শুরুর প্রস্তুতি নিতে নিতেই আবার লকডাউন দেওয়ায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
সিদ্ধিরগঞ্জ : নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া ও সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড়ে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেন স্থানীয় বিভিন্ন মার্কেটের ব্যবসায়ীরা।
বগুড়া : বেলা ১১টায় শহরের সাতমাথা চত্বরে ইলেকট্রিক ব্যবসায়ীরা বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেন।
বরিশাল : দুপুর ১২টার দিকে নগরীর চকবাজার থেকে জেলা প্রশাসক কার্যালয় পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল করেন বরিশাল নগরীর ব্যবসায়ীরা। পরে তারা জেলা প্রশাসকের কাছে দোকান খোলা রাখার দাবি জানান।
টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শহরের সমবায় সুপার মার্কেটের সামনে বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। মির্জাপুরেও একই সময়ে বিক্ষোভ করেন ব্যবসায়ীরা।
সিরাজগঞ্জ : সকালে শহরের এসএস রোডে শহর দোকান মালিক সমিতির উদ্যোগে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন ব্যবসায়ীরা।
শৈলকুপা (ঝিনাইদহ) : শৈলকুপা বাজারের চৌরাস্তা মোড়ে শতশত ব্যবসায়ী বেঞ্চ দিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। সেখানে তারা বিক্ষোভও করেন।
স্বাস্থ্যবিধি মানাতে অভিযান
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল নিশ্চিতে গতকালও ঢাকায় অভিযান চালিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শেখ মো. মামুনুর রশিদ ধানমন্ডি ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে অভিযান পরিচালনা করেন। সায়েন্স ল্যাব মোড়ে দুপুর দেড়টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে আধা ঘণ্টায় তিনটি মামলা হয়েছে। তিনজনকে জরিমানা করা হয় আট হাজার টাকা। এ ছাড়া গুলশানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।