বুধবার, ২২ মে ২০২৪, ০২:৫২ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
পর্যটক সামলাতে দেয়াল তুলছে জাপান ঢাবিতে গোলাম মাওলা রনির ওপর হামলা টস জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ে পাঠাল যুক্তরাষ্ট্র, একাদশে যারা আজিজ আহমেদের ওপর মার্কিন ভিসানীতি প্রয়োগ হয়নি: ওবায়দুল কাদের অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত থাকবে কৃষি খাতে ফলন বাড়াতে অস্ট্রেলিয়ার প্রযুক্তি সহায়তা চান প্রধানমন্ত্রী ভিকারুননিসায় ১৬৯ শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিল, অনিয়ম তদন্তের নির্দেশ ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে থাকতে পারে : সিইসি সাবেক সেনাপ্রধানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা যে বার্তা দিচ্ছে শিয়ালের টানাহেঁচড়া দেখে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেল এক নারী ও দুই শিশুর লাশ
মামলা ভিত্তিহীন, আমি সত্যের পথে আছি : মির্জা কাদের

মামলা ভিত্তিহীন, আমি সত্যের পথে আছি : মির্জা কাদের

স্বদেশ ডেস্ক:

প্রায় আড়াই মাসের নীরবতা কাটিয়ে নোয়াখালীতে ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ প্রশাসন; চলছে ধরপাকড়। সম্প্রতি বসুরহাটের হামলা-পাল্টা হামলায় একজন নিহত এবং শতাধিক আহত হওয়ার ঘটনায় উপজেলার সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান বাদলকে গতকাল কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বাদলের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে অনেকটা আড়ালে চলে গেছে একরামুল করিম চৌধুরী এমপির আলোচনা। নোয়াখালীর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে গত কিছু দিনের ইস্যু ছিলেন একরাম চৌধুরী ও স্থানীয় কমিটি গঠন।

নিহত আলাউদ্দিনের ভাই এমদাদ হোসেন বাদী হয়ে গত বৃহস্পতিবার রাতে বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা, তার ভাই শাহাদাত হোসেন ও ছেলে মির্জা মাশরুর কাদের তাসিকসহ ১৬৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। বৃহস্পতিবার থেকেই বসুরহাট পৌরসভা ঘেরাও করে রাখে পুলিশ। মির্জা কাদেরের গ্রেপ্তারের খবরও ছড়িয়ে পড়ে। তবে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, নজরদারিতে রাখা হয়েছে। জানতে চাইলে গতকাল শুক্রবার বিকালে মির্জা কাদের আমাদের সময়কে বলেন, ‘গত বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে আমি হত্যামামলাসহ ১৮টি মামলা ফেস করেছি। রাজনীতি করলে মামলা হয়। এতে আমি ভীত নই। আমি শুধু জানি, এই মামলা ভিত্তিহীন। আমি সত্যের পথে আছি, সত্য কথা বলছি।’

বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যম সরগরম গত বুধবার সংঘটিত বসুরহাটের ঘটনায়। বৃহত্তর নোয়াখালীকে বাদ দিয়ে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে এখন বসুরহাট। এ অবস্থার মধ্যে কৌশলী ভূমিকায় রয়েছেন নোয়াখালী সদর আসনের সংসদ সদস্য, নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী এবং তার পুত্র সাবাব চৌধুরী।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত দুদিন দৃঢ়ভাবে বলে আসছেন, ‘অপরাধী যেই হোক তাকে ধরা হবে; অপরাধ করে কেউ ছাড় পাবে না।’

নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের ভাষ্য, সাম্প্রতিক ঘটনার সূত্রপাত একদিন বা দুদিনে নয়। দীর্ঘদিন ধরে চলছে। নোয়াখালী আওয়ামী লীগে এই অস্থিরতায় বারবার নাম এসেছে এমপি একরামুল করিম চৌধুরীর। নতুন করে যুক্ত হয়েছেন তার ছেলে সাবাব চৌধুরী। বিভিন্ন সময় একরামের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে। গত এক সপ্তাহ ধরে তিনি কৌশলী ভূমিকায় রয়েছেন।

স্থানীয় নেতারা জানান, চাকরিতে নিয়োগবাণিজ্য, আধিপত্য বিস্তার করে টেন্ডারবাণিজ্য, দলের তৃণমূল থেকে শীর্ষনেতাদের অবমূল্যায়ন থেকে শুরু করে নিজস্ব বলয় তৈরির নামে দলে পদবাণিজ্যের মতো অভিযোগ পুরনো। কিন্তু সাম্প্রতিক অস্থিরতার মূল ইস্যু ছিল নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি নিয়ে। পরবর্তী সময়ে এই জল নানা দিকে গড়িয়েছে। অধিকাংশ ঘটনাতেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একরামুল করিম চৌধুরীর নাম বলছেন স্থানীয়রা।

গত ৩১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই মির্জা আবদুল কাদের নানা অভিযোগ প্রকাশ্য নিয়ে আসেন একরামুল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে। গত আড়াই মাসে অন্তত ২০ বার একরাম ও তার পুত্রের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির চিত্র উপস্থাপন করেন মির্জা কাদের। তিনি তদন্তও দাবি করেন।

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে একরামুল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে বেনামি অসংখ্য অভিযোগ জমা হয়। ওই অভিযোগপত্রে একরামুল করিমের জীবনবৃত্তান্তও উঠে আসে। সেখানে বলা হয়- একরাম চৌধুরীর বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ছিলেন রাজনীতিক। সুনামের সঙ্গে রাজনীতি করায় অবশিষ্ট তেমন কিছু তিনি রেখে যাননি। ‘হাজী ইদ্রিস অ্যান্ড সন্স’ নামে ছিল শুধু একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

অভিযোগগুলোতে উঠে এসেছে- একরামুল করিম চৌধুরী কখনো ছাত্রলীগ বা যুবলীগ করেননি। আশির দশকে চট্টগ্রাম আবাহনীতে ফুটবলার হিসেবে যোগ দেন। ওই সময়েই পিতার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যবহার করে ঠিকাদারি শুরু করেন। চট্টগ্রাম বন্দরে সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসাও করেছেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে যখন আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দল আন্দোলন-সংগ্রামে ব্যস্ত, ঠিক তখন তিনি ঠিকাদারিতে ছিলেন পূর্ণ মনোযোগী। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদের পতন হলে একরামুল করিম চৌধুরী নতুন উদ্যমে ব্যবসা করতে থাকেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পূর্ব পর্যন্ত তিনি হয়ে ওঠেন বিস্তর বিত্তবৈভবের মালিক। সেই সময় দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের সুপারিশে নোয়াখালী জেলার নেতা হানিফ প্রফেসরের মাধ্যমে জেলার কোষাধ্যক্ষ পদ পান একরামুল করিম চৌধুরী।

অভিযোগে আরও উঠে এসেছে, একরামুল করিম চৌধুরীর রাজনীতির বয়স ৫ বছর না হতেই ২০০১ সালের দিকে দলীয় মনোনয়ন চান। মনোনয়ন না পাওয়ায় নোয়াখালী-৫ আসনে দলের মনোনীত প্রার্থী ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। শুধু তাই নয়, নিজে স্বতন্ত্র প্রার্থীও হন। সেই নির্বাচনে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বিজয়ী হন। ওবায়দুল কাদের হন দ্বিতীয় এবং একরাম হন তৃতীয়।

পার্টি অফিসে পাঠানো অভিযোগে আরও বলা হয়, ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে একরামুল করিম চৌধুরীকে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। বছর দুয়েক পর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে পুনরায় তাকে দলে ফেরত নেন। দলে এসে কৌশলী ভূমিকা নেন একরামুল করিম চৌধুরী। যার হাত ধরে দলে তার উত্থান- সেই হানিফ প্রফেসরকে বাদ দিয়ে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। দলের ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে জামায়াত-বিএনপি তথা ভিন্ন দলের নেতাদের জায়গা দিয়ে তৈরি করতে থাকেন নিজস্ব বলয়।

২০০৮ সালে নোয়াখালী সদর আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আজ অবধি তিনি আছেন একনায়কতন্ত্রের ভূমিকায়। যে কারণে ক্ষোভ বাড়তে থাকে জেলা আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের মধ্যে। আর সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে সম্প্রতি মির্জা কাদেরের বক্তব্যে। বর্তমানে নোয়াখালী জেলার যে প্রস্তাবিত কমিটি একরাম চৌধুরী কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছেন, তাতে অন্তত ৪০ জন বিতর্কিত ব্যক্তির নাম রয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয় নেতাদের। এমপিপুত্র সাবাব চৌধুরীকে জেলার প্রস্তাবিত কমিটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক হিসেবে স্থান দেওয়া হয়েছে।

নোয়াখালী জেলার প্রবীণ এক নেতার অভিযোগ- পিতা একরাম চৌধুরীর পধ ধরে হাঁটছেন তার পুত্র সাবাব চৌধুরী। পিতার প্রশ্রয়ে লাগামহীন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন সাবাব। নিজের চিন্তার সঙ্গে মিল না হলেই নিজের তৈরি করা ‘মামা বাহিনী’ ওরফে ‘আঙ্কেল বাহিনী’ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। ইতোমধ্যে নানা সভা-সমাবেশে, স্থানীয় নির্বাচনে হামলা, গুলিবর্ষণ এবং গাড়িচাপা দিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনাও ঘটিয়েছেন সাবাব।

নোয়াখালীর বিভিন্ন সভা-সমাবেশেও পরিবারের উপস্থিতি থাকে সর্বাগ্রে। সর্বশেষ গত ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে একরামুল করিম চৌধুরী ছিলেন প্রধান অতিথি, ছেলে সাবাব চৌধুরী ছিলেন বিশেষ অতিথি। জেলার প্রবীণ নেতাদের না রেখে সাবাব চৌধুরীকে বিশেষ অতিথি করায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন একরাম চৌধুরী।

একরাম চৌধুরীর স্ত্রী কামরুন্নাহার শিউলিও নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার চেয়ারম্যান। ভাগনে মেয়র, বেয়াই এমপি, জামাই ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং চাচাতো ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তার পরিবারের হাতেই বন্দি নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ- এমনটা উল্লেখ করে নোয়াখালীতে এখনো বইছে সমালোচনার ঝড়।

নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি অ্যাডভোকেট মুহিব উল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, মির্জা আবদুল কাদের যেসব অভিযোগ তুলেছেন সব অভিযোগের সত্যতা আছে। তদন্ত করলেই সব বের হয়ে আসবে। আমরা চাই, একরামুল করিমের বিরুদ্ধে তদন্ত হোক এবং নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। নোয়াখালী জেলার প্রস্তাবিত কমিটি যাচাই-বাছাই করে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের বাদ দিয়ে ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করার আহ্বান জানান তিনি।

স্বেচ্ছাসেবক লীগের নোয়াখালী জেলা শাখার সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য মোস্তফা ইকবাল বলেন, এতটুকু বলা যায়- নোয়াখালীতে টাকা ছাড়া একজনেরও চাকরি হয় না। কমিশন ছাড়া কোনো টেন্ডার হয় না। এমনকি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যে মডেল মসজিদ আমাদের উপহার দিয়েছেন, সেই আল্লাহর ঘর নির্মাণেও কমিশন নিচ্ছেন তিনি। আর প্রস্তাবিত কমিটির ক্ষেত্রে কারও মতামত নেওয়া হয়নি। নিজের মতো করে অন্তত ৩০ জনের নাম পাঠানো হয়েছে- যারা বিগত সময়ে জামায়াত, বিএনপি, জাসদ ও ফ্রিডম পার্টি করেছেন।

এ বিষয়ে একরামুল করিম চৌধুরী ও তার পুত্র সাবাব চৌধুরীর মুঠোফোনে কল দিয়ে এবং এসএমএস পাঠিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

বিভিন্ন সময় তিনি তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছেন। একরামুল করিমের দাবি, আমি তিলে তিলে তিনি নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ গড়ে তুলেছেন। যেখানে বিএনপির ঘাঁটি ছিলেন, সেখান আজ আওয়ামী লীগের জয়-জয়কার।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877