স্বদেশ ডেস্ক; দিনে দিনে কেটে গেছে বহুদিন। মাসে মাসে পোহাইছে বছর। এভাবেই আশায় আশায় পেরিয়ে গেছে তিন যুগ। ৩৬ বছর। তবু হাল ছাড়েননি হাসিনা খাতুন (৪৬)। পরাণের গহিনে লুকিয়ে ছিল বাসনা- আবার তিনি ফিরবেন আপন গৃহে, খুঁজে পাবেন স্বজনদের। হারিয়ে যাওয়ার দীর্ঘ তিন যুগ পর সত্যিই অবশেষে তিনি ফিরে পেয়েছেন তার স্বজনদের।
মাত্র ১০ বছর বয়সে হারিয়ে যান হাসিনা খাতুন। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে অবশেষে স্বজনদের কাছে ফেরা হলো তার। গতকাল তিনি নাটোরের বড়াইগ্রাম পৌরসভার রয়না গ্রামে তার বাবা মৃত মখলেছুর রহমানের বাড়িতে ফিরে এলে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে তাকে এক নজর দেখার জন্য ভিড় জমায় শত শত মানুষ। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে- তা হলে এতদিন কোথায় ছিলেন হাসিনা খাতুন?
হাসিনার স্বজনরা জানান, সহজ-সরল হাসিনার স্মৃতিশক্তি একটু দুর্বল ছিল, কিছুই ঠিকঠাক মনে রাখতে পারতেন না। প্রায় ৩৬ বছর আগে একদিন হাসিনা কাউকে কিছু না বলে তার প্রতিবেশী এক নানির সঙ্গে বনপাড়া বাজারে যান। এর পর থেকে আর কোনো খোঁজ মেলেনি তার।
হাসিনা খাতুন জানান, তিনি বনপাড়া থেকে বাড়ি ফেরার জন্য একাই বাসে উঠে বসেন। তবে ভুল বাসে ওঠায় চলে যান ঈশ্বরদী। পরে যান ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশনে। কিন্তু ফিরবেন কীভাবে বুঝতে না পেরে বসে বসে কাঁদছিলেন। এ সময় আলমগীর হোসেন নামে রেলওয়ের একজন টিটি তাকে দেখতে পেয়ে নিজ বাড়িতে নিয়ে যান। কিছুদিন চেষ্টা করেও তার পরিচয় জানতে না পেরে পরে হাসিনার আশ্রয় মেলে আলমগীরের দুলাভাই কুষ্টিয়ার মিরপুর থানার কলাবাড়িয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেনের বাড়িতে। এর পর তারাই লালন-পালন করে গ্রামের এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেন। কিন্তু দীর্ঘ ১২ বছরেও কোনো সন্তান না হওয়ায় একপর্যায়ে ভেঙে যায় সে সংসার। এর পর হাসিনার আবার বিয়ে হয় সদর উপজেলার ভাদালিয়া গ্রামের বাসিন্দা কুষ্টিয়া চিনিকলের পাওয়ার টারবাইন অপারেটর হিসেবে কর্মরত আবদুস সাত্তারের সঙ্গে।
হাসিনা খাতুনের সঙ্গে আসা তার ধর্মভাই সোহেল রানা জানান, বিয়ের পর তিনি প্রায়ই মা-বাবাকে দেখতে চাইতেন। কিন্তু ঠিকানা বলতে পারতেন না। তবে ‘বাড়ি লক্ষ্মীকোল, বাবার নাম মখলেছ আর বাড়ির পাশে বড়াল নদী আছে’ শুধু এতটুকুই বলতে পারতেন। গত তিন বছরে এটুকু তথ্যের ভিত্তিতেই সোহেল রানা ও আবদুস সাত্তার হাসিনার স্বজনদের খুঁজে পেতে নাটোরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছেন। কিন্তু খোঁজ পাননি। অবশেষে ১৫ দিন আগে তারা বড়াইগ্রাম পৌরসভার লক্ষ্মীকোলের পাশে রয়না গ্রামে এসে খুঁজে পান ঠিকানা।
এর পর গতকাল শনিবার তারা হাসিনাকে নিয়ে আসেন স্বজনদের কাছে। কিন্তু ইতোমধ্যেই হাসিনার বাবা মখলেছুর রহমান ও সৎমা দুজনেই মারা গেছেন। রয়েছে শুধু তার ছোট দুই বোন আর বাড়িসংলগ্ন মামি ও মামাতো ভাইবোনরা। শনিবার শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িতে ফিরে এলে কান্নায় ভেঙে পড়েন হাসিনা ও তার স্বজনরা। মা-বাবা বেঁচে না থাকলেও তাদের স্মৃতি আর বেঁচে থাকা স্বজনদের বুকে জড়িয়ে দীর্ঘ তিন যুগ পর নতুন করে বাঁচার অবলম্বন পেলেন হাসিনা খাতুন।
হাসিনার মামাতো ভাই আমজাদ হোসেন বলেন, দীর্ঘ বছরে আমরা বোনকে এক প্রকার ভুলতেই বসেছিলাম। আর কোনোদিন তাকে পাব এমন আশা ছিল না। কিন্তু অবশেষে তাকে পেয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি।
হাসিনা খাতুন বলেন, সব সময়ই মা-বাবাসহ স্বজনদের দেখতে ইচ্ছা করত। কিন্তু বাড়ির ঠিকানা ঠিকমতো বলতে না পারায় শুধু নীরবে কেঁদেছি। স্বামীর চেষ্টায় অন্তত তাদের মুখ দেখতে পেরেছি, এতেই আমার কলিজা ঠাণ্ডা হয়েছে। এখন এটুকু ভেবে শান্তি পাচ্ছি যে, পৃথিবীতে আমারও আপন বলে কেউ আছে।