বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ০৮:৫৭ পূর্বাহ্ন

ট্রেনের কোচ কেনায় দুর্নীতির অর্থ লন্ডনে

ট্রেনের কোচ কেনায় দুর্নীতির অর্থ লন্ডনে

স্বদেশ ডেস্ক: রেলে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার কোচ ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। খোদ রেলওয়ের বর্তমান মহাপরিচালকসহ সংস্থাটির বেশকিছু কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, দুর্নীতির মাধ্যমে কামানো এসব অর্থ লন্ডনে পাচার করা হয়েছে বলেও এতে বলা হয়। ২০১৭ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে এসব কোচ কেনা হয়। অভিযুক্ত মহাপরিচালক সামসুজ্জামান সে সময় ছিলেন রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক। তার বিরুদ্ধে এর আগেও অসংখ্য অভিযোগ ছিল। দুদকের তদন্ত দল সেসবের অনুসন্ধানেও মাঠে নেমেছে।
অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গত মাসে দুই সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি করেছে দুদক। এর প্রধান করা হয়েছে কমিশনের সহকারী পরিচালক (মানিলন্ডারিং) মামুনুর রশীদ চৌধুরীকে এবং উপসহকারী পরিচালক সোমা হোড় হলেন সদস্য। সম্প্রতি রেলওয়ের মহাপরিচালক
মো. সামসুজ্জামানের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে তথ্যাদি চেয়ে রেলপথ সচিব বরাবর চিঠি প্রেরণ করেছে দুদকের এ কমিটি।
জানা গেছে, ইন্দোনেশিয়া থেকে ২০০ মিটারগেজ কোচ কেনে রেলওয়ে। এগুলো সরবরাহের কাজ পায় ইন্দোনেশিয়ার পিটি ইনকা কোম্পানি। এসব কোচ কেনায় ঘুষ লেনদেন, দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন করে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে চলছে দুদকের অনুসন্ধান। দুদক সূত্র জানায়, তদন্তকালে একে একে বেরিয়ে আসছে রেলের আরও অনেক কর্মকর্তার নাম, যারা এ অপকর্মে সম্পৃক্ত। জানা গেছে, একটি সিন্ডিকেট রয়েছে যে চক্রের মাধ্যমে রেলে চলছে মহাদুর্নীতির মচ্ছব। কর্মকর্তাদের কেউ এ সিন্ডিকেটের নির্দেশ না মানলে তাদের হয়রানি করা হয়। রেলের তথা রাষ্ট্রের স্বার্থ হাসিলের পরিবর্তে এ সিন্ডিকেট ঠিকাদারের স্বার্থ দেখছে অবৈধভাবে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিতে। তাদের দুর্নীতিতে সায় না দেওয়া কর্মকর্তাদের কোণঠাসা করে রাখা, এমনকি প্রকাশ্যে দুর্ব্যবহারের মাধ্যমে নাজেহাল করার মতো কা-ও ঘটেছে। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধাচরণকারী অনেক কর্মকর্তাকে তদন্তের নামে হয়রানি, পদোন্নতি আটকে রাখা ও বদলি করে হয়রানি করার প্রমাণও মিলছে দুদকের তদন্তে। এ ছাড়া প্রকল্পে সম্পৃক্ত নন এমন কর্মকর্তাদেরও স্রেফ ব্যক্তিগত পছন্দের কারণে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে সূত্রের খবর, তদন্তকালও বেশ চাতুর্যের সঙ্গে উতরে যেতে চাইছেন অভিযুক্ত কর্মকর্তারা। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল গত ১০ বছরে বিশ্বাস বিল্ডার্স ও শিরিজা মেটালের মাধ্যমে রেল ইঞ্জিন মেরামতের তথ্য। এর জবাবে রেলওয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘রিকুইজিশনের ভিত্তিতে শিরিজা মেটাল এবং বিশ্বাস বিল্ডার্স কোম্পানির মাধ্যমে কোনো রেল ইঞ্জিনের মেরামতকাজ সম্পন্ন করানো হয়নি।’ জমা দেওয়া তথ্যাদিতে স্বাক্ষর করেছেন রেলের প্রধান নির্বাহী/কেলোকা শাহ সূফী নূর মোহাম্মদ ও উপপরিচালক পিপিঅ্যান্ডসি/ লোকো হুমায়রা মহিউদ্দিন।
বাস্তবতা হচ্ছে, প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের মাধ্যমে ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ট্রাকশন মোটর সরবরাহ এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চুক্তি, নথিপত্র যাচাই করে দেখা যায়Ñ ক্রয়সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহে চতুরতার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানের নাম কিংবা বেনামে যন্ত্রাংশ সরবরাহের তথ্য নিশ্চিত করেছে একটি সূত্র। শুধু তাই নয়, অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের অধীনে দরপত্র অনুমোদনের সুবিধা নিতে দরপত্রকে কয়েকটি প্যাকেজে ভাগ করে দেওয়া হয়। ফলে এসব দরপত্র মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনে পাঠাতে হয়নি।
দুদকের নথিতে বলা হয়, ২০১৭ সালে ৫৭৯ কোটি ৩৮ লাখ ৯৭ হাজার টাকায় ইন্দোনেশিয়া থেকে মিটারগেজ কোচ সংগ্রহ করে রেল। পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দিতে এসব কোচ কেনার দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কয়েক কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন করা হয়েছে। এ দুর্নীতিতে মূল অভিযুক্ত রেলওয়ের মহাপরিচালক শামসুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে দুদকের তদন্ত চলছে। তাই মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
দুদকের নথিতে বলা আছে, পিটি ইনকাকে কাজ দেওয়ার বিনিময়ে কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট বিশ্বাস বিল্ডার্স থেকে কয়েক কোটি টাকা ঘুষ নেন শামসুজ্জামান। অবৈধভাবে উপার্জিত এ অর্থ বিশ্বাস বিল্ডার্সে স্বত্বাধিকারী আফসার বিশ্বাসের কাছে গচ্ছিত আছে। কার্যাদেশ নিয়ে (পিএস/ইবিআই/পিটিইনকা/২০১৯/১৬.২.২০) রেলওয়ের অর্ডারের রেফারেন্স সংযুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, পিটি ইনকা নিজে তৈরি করে না, অ্যাসেমব্লিং করে ডিজাইন হিসেবে। এসব ইস্যুতে তদন্ত করছে দুদকের মানিলন্ডারিং বিভাগ (ফাইল ০০.০১.০০০.৪০৩.০১.০৩৭.০৩৭০১৯)। সেখানেও লন্ডনে অর্থপাচারের বিষয়ে বলা আছে। এসব কর্মে আফসার বিশ্বাসের পাশাপাশি নাসির, ফারুক গংয়ের নাম ওঠে এসেছে দুদকের তদন্তে।
দুদকের নথিপত্রে দেখা যায়, ২০০ কোচ কেনার ক্ষেত্রে দরপত্রে শর্ত ছিল কমপক্ষে দেড় হাজার কোচ তৈরি ও সরবরাহের। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার পিটি ইনকার সে যোগ্যতা না থাকায় পরে তা পরিবর্তন করা হয়। এক্ষেত্রে রেলওয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিংস্টক) শামসুজ্জামানের মৌখিক নির্দেশে পরিবর্তন করে শর্ত দেওয়া হয় ৫০০ কোচ তৈরি ও সরবরাহের অভিজ্ঞতার। এতে কারিগরি যোগ্যতায় টিকে যায় পিটি ইনকা।
সূত্রমতে, দুদকের তদন্ত কমিটিকে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪, দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা ২০০৭, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা ২০১৯-এর বিধান মোতাবেক অভিযোগটি অনুসন্ধান কাজ সম্পন্ন করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অনুসন্ধানকালে কোনো ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধকরণ অথবা কোনো সম্পদ/সম্পত্তি ক্রোক করা হলে তা দ্রুত লিখিতভাবে দুদকের মানিলন্ডারিং শাখাকে অবহিত করতে হবে।
শামসুজ্জামানের অর্থ পাচারের অভিযোগে বলা হয়েছে, বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে লন্ডনে পাচার করেন। তার ছেলে সাদমান জামানের কাছে এসব অর্থ পাঠানো হয়। ব্যাংক ও শাখার নামও অভিযোগে উল্লে­খ রয়েছে। তা হলো, লন্ডনের বার্কলেস ব্যাংকের ১২৮ মুরগেট শাখা। ফোন নম্বর ০৩৪৫৭৩৪৫৩৪৫। শামসুজ্জামানের ছেলে সাদমান যুক্তরাজ্যের লন্ডনে ও ইসরায়েলে বসবাস করেন।
দুদক আরও জানায়, শামসুজ্জামানের আরও অনেক অনিয়মের বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে। ২০১১ সালে যুগ্ম মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) থাকাকালে ১০০টি মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ কোচ ক্রয় প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক ছিলেন শামসুজ্জামান। সে সময় তিনি পিটি ইনকা থেকে নি¤œমানের কোচ ক্রয় করেছিলেন। এ ছাড়া রেলের ১১০টি ট্রাকশন মোটর মেরামতে অনিয়মের মাধ্যমে তিনি ২৪ কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ এসেছে। উপরন্তু রেলের ২৬০০ ও ২৭০০ গ্রুপের রেল ইঞ্জিন মেরামতের জন্য ১৫টি ট্রাকশন মোটর কানাডার ফেরদৌস ইন্টারন্যাশনাল থেকে আনা হয়। কিন্তু এগুলো ছিল খুবই নি¤œমানের। এই ক্রয় কমিটিরও চেয়ারম্যান ছিলেন শামসুজ্জামান। দুদকের নথিতে আরও বলা হয়, ২০০৬ সালে রেল ভবনে সিএমই/প্রজেক্টকালীন সময়ে বরাদ্দের বাইরে ৮ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। এ নিয়ে তখন অডিট আপত্তিও ওঠে। এর সঙ্গেও শামসুজ্জামানের সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এর বাইরে শামসুজ্জামানের অবৈধ সম্পদের বিষয়েও দুদকে অভিযোগ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ঢাকার শান্তিবাগে তার আড়াই হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট রয়েছে, দাম প্রায় ২ কোটি টাকা। সাবেক স্ত্রীকেও একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া পূর্বাচলে সাড়ে সাত কাঠার প্ল­ট, মিরপুরে সাড়ে তিন কাঠা জমি, যশোরের ঝিকরগাছায় ৬০ বিঘা জমিসহ দোতলা বাড়ির মালিক তিনি। এসব বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি নন রেলওয়ের এই মহাপরিচালক। মুঠোফোনে যোগাযোগ করে এমনকি তার দপ্তরে গিয়েও এসব বিষয়ে তার বক্তব্য নেওয়া যায়নি। একটি বাক্যেই সব প্রশ্নের ইতি টেনে দিয়ে তিনি বলেন, দুদকের তদন্তকালে মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877