রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০২:৩৮ অপরাহ্ন

‘এমপি বলয়’ ভাঙার চেষ্টায় নতুন সংকট

‘এমপি বলয়’ ভাঙার চেষ্টায় নতুন সংকট

স্বদেশ ডেস্ক:

এমপিদের বলয়ের বাইরের নেতাকর্মীদের জন্য রাজনীতি করা তৃণমূল বিএনপিতে সবচেয়ে কঠিন কাজ। এবার সেই ‘এমপি বলয়’ ভাঙার উদ্যোগ নিয়েছে দলটি। এর অংশ হিসেবে সম্প্রতি তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে আসন্ন উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৪৯ জন প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আসনগুলোয় দলীয় প্রতীকে সবশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা নেতাদের প্রভাব হ্রাস পাবে বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। এতে শঙ্কিত ‘এমপি বলয়ে’র নেতাকর্মীরা বলয় অটুট রাখতে তৎপর হয়ে উঠেছেন। ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন ‘এমপি বলয়ের’ বিরোধীরাও। একাধিক নেতা মনে করেন, এ অবস্থায় দলটিতে আসনভিত্তিক সংকট ঘনীভূত হবে।

তৃণমূলের পক্ষে থাকা নেতা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, তৃণমূল নেতাকর্মীরাই দলের প্রাণশক্তি। সব সময়ই বিএনপি তাদের মতামতকে মূল্যায়ন করেছে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটেছে, এটাও সত্য। তবে এবার স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত, দলের সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে তৃণমূলকে আরও প্রাধান্য দেওয়া হবে। তারাই নির্ধারণ করবেন তাদের প্রতিনিধি হওয়ার জন্য কে সবচেয়ে যোগ্য।

স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নে একটি নীতিমালা গত ১৯ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে দলের তৃণমূল নেতাদের কাছে পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বা আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব/১ নং যুগ্ম আহ্বায়ক, উপজেলা বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও ১ নং সাংগঠনিক সম্পাদক বা আহ্বায়ক, সদস্য সচিব ও ১ নং যুগ্ম আহ্বায়ক (যে কমিটিতে সদস্য সচিব নেই, সেখানে আহ্বায়ক, ১ ও ২ নং যুগ্ম আহ্বায়ক সুপারিশ করবেন) আলোচনাক্রমে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের জন্য লিখিত সুপারিশ করবেন।

পৌরসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে জেলা বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক বা আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব/১ নং যুগ্ম আহ্বায়ক, পৌরসভা বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও ১ নং সাংগঠনিক সম্পাদক বা আহ্বায়ক, সদস্য সচিব ও ১ নং যুগ্ম আহ্বায়ক (যে কমিটিতে সদস্য সচিব নেই, সেখানে আহ্বায়ক, ১ ও ২ নং যুগ্ম আহ্বায়ক) দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের জন্য লিখিত সুপারিশ করবেন।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বা আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব/১ নং যুগ্ম আহ্বায়ক, ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক বা আহ্বায়ক, সদস্য সচিব ও ১ নং যুগ্ম আহ্বায়ক (সদস্য সচিব না থাকলে আহ্বায়ক, ১ ও ২ নং যুগ্ম আহ্বায়ক) লিখিত সুপারিশ করবেন। এ সুপারিশ অনুযায়ী কেন্দ্র প্রার্থী চূড়ান্ত করবে।

দলের নতুন এ সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা বলেন, ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর পুরো তৃণমূল বিএনপি চলে যায় এমপিদের নিয়ন্ত্রণে। জেলা বা মহানগর বিএনপির কমিটিও তারা ভাগবাটোয়ারা করেন। শুধু তা-ই নয়, সবশেষ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে যিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন (নির্বাচিত হোন বা না হোন) তিনি ওই আসনের দলীয় বিষয়ে একক সিদ্ধান্তদাতা হয়ে পড়েন। এ কারণে অনেক ত্যাগী ও গুরুত্বপূর্র্ণ নেতা দল থেকে ছিটকে পড়েছেন। বলা চলে প্রতিটি আসনে এমপি বা প্রার্থী হওয়া মানেই ওই আসনে বিএনপির নীতিনির্ধারকে পরিণত হওয়া। এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছিলেন দলের সিনিয়র নেতারা। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় দলীয় ফোরামে আপত্তি উঠলেও হাইকমান্ড কর্ণপাত করেননি। ২০১৫ সালে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন শুরুর পরও একই প্রক্রিয়ায় চলছে দলটিতে। তৃণমূলে না থাকলেও ঢাকায় থাকা দলীয় এমপি বা সবশেষ নির্বাচনের প্রার্থীরা তাদের নিজস্ব প্যাডে যেভাবে চেয়েছেন সেভাবে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে দল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড থাকলেও বিএনপিতে এ সংক্রান্ত কোনো বোর্ড ঘোষণা করা হয়নি। দলটি শুধু সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ক্ষেত্রে মেয়রপ্রার্থী চূড়ান্ত করতে সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডকে ব্যবহার করে।

দলের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক সাবেক এমপি বলেন, এতদিন দল চলেছে এক রকম প্রক্রিয়ায়। দলের ভিত্তি সেভাবেই গড়ে উঠেছে। সেভাবেই সব সংদীয় আসনের উপজেলা বা ইউনিয়ন কমিটি হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর থেকে দল পুনর্গঠন শুরু করে বিএনপি। সেখানেও ‘এমপি বলয়ের’ মতামত অনুযায়ী কমিটি হয়েছে। তবে কোথাও কোথাও কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়ভাবে নেতায় নেতায় দ্বন্দ্বের জেরে সাবেক এমপির কমিটি হাতছাড়া হয়েছে। সেখানে আবার সাবেক এমপির লোকজন কোণঠাসা। এতদিন দলের মধ্যে অনিয়মই ছিল নিয়ম। যদি হঠাৎ করে ঠিক নিয়ম করা হয় তাহলে হবে না, কমিটিগুলোও নিরপেক্ষ হতে হবে। ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌর কমিটি কোনো না কোনো নেতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ফলে তৃণমূলের কমিটি নিরপেক্ষ না করে সিদ্ধান্ত দিলে তা হিতে বিপরীত হবে।

বিএনপির সাবেক একজন এমপি বলেন, হঠাৎ করে নতুন সিদ্ধান্তের আলোকে তৃণমূলের নির্ধারিত নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ প্রার্থী চূড়ান্ত করা হলো। আমার প্রশ্ন, তৃণমূলের মতামতের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দলের কোন ফোরাম দেয়। দলীয় গঠনতন্ত্রে বলা আছে, যে কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার এখতিয়ার স্থায়ী কমিটির। তিনি বলেন, যতদূর জানি স্থায়ী কমিটিতে বিষয়টি উত্থাপন করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই অন্ধকারে বলে জানান ওই সাবেক এমপি।

তৃণমূলের একাধিক নেতা জানান, নতুন নীতিমালায় যারা সুপারিশ করবেন বলা হচ্ছে, সেই সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরাই বিভিন্ন জায়গায় প্রার্থী হতে চান। খোদ সুপারিশকারীরা প্রার্থী হলে তখন কী সিদ্ধান্ত হবে তা নীতিমালায় স্পষ্ট করা হয়নি। এ ছাড়া অনেক নেতাই এলাকায় থাকেন না। এক্ষেত্রেও কেন্দ্রের কোনো নির্দেশনা নেই।

তৃণমূলের এক নেতা বলেন, ‘এমপি বলয়’ ভাঙার চেষ্টা না করে কমিটিগুলো কীভাবে নিরপেক্ষ করা যায়, কীভাবে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে কমিটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আনা যায় সেই চেষ্টা সবার করা উচিত। এটা না হলে তৃণমূল বিএনপি এক বলয় থেকে অন্য বলয়ে ছুটবে। এতে ত্যাগী নেতাকর্মীসহ অনেক জনপ্রিয় এমপিও এলাকাছাড়া হয়ে যাবেন। যা দলের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।

বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেতা জানান, প্রার্থী মনোনয়নে দলের নীতিমালা প্রশংসনীয় উদ্যোগ- এটা ঠিক। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা প্রার্থী ছিলেন তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল। কিন্তু নীতিমালায় তাদের কোনো ক্ষমতাই দেওয়া হয়নি। এ কারণে তৃণমূলে গ্রুপিং আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সূত্রমতে, বিএনপির দপ্তরে ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে কয়েকটি জায়গায় অনিয়মের কথা জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতারা। তারা স্বচ্ছতা বাড়াতে বাছাইকারী নেতার সংখ্যা ৫ জনের পরিবর্তে ১০ জনে বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন।

জানতে চাইলে পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এইচএম দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়ে দলীয় যে সিদ্ধান্ত তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারি না। তবে আমরা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রথমে সংশ্লি­ষ্ট ইউনিয়নে গিয়ে নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করি। তাদের মতামতের ভিত্তিতে ৩ জনের নাম নিই। তারপর উপজেলা পর্যায়ে বৈঠক করে সর্বসম্মতিক্রমে এ ৩ জনের নাম পাস হয়। পরে উপজেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষর দিয়ে ৩ জনের প্যানেল কেন্দ্রে পাঠানো হয়। কেন্দ্র সেখান থেকে একজনকে চূড়ান্ত করে। এভাবে করলে প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ হয় বলে আমি মনে করি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877