স্বদেশ ডেস্ক:
যুক্তরাষ্ট্রের সান্তা ক্লারা ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী জ্যাকব আমেদি ২০১৫ সালে তার চূড়ান্ত গবেষণা পত্র হিসেবে এই প্রবন্ধটি তৈরি করেছিলেন। ‘দি ইমপ্যাক্ট অব সোশাল মিডিয়া অন সোসাইটি’ নামে এই প্রবন্ধটি প্রকাশ করে অ্যাডভান্সড রাইটিং: পপ কালচার ইন্টারসেকশনস। স্কলার কমনসের সৌজন্যে প্রবন্ধটি উন্মুক্ত হিসেবে পাওয়া যায়।
পাঠকদের জন্য লেখাটি বাংলায় রূপান্তর করা হয়েছে। চার পর্বের রচনার প্রথম পর্ব এটি—
জ্ঞানই শক্তি। এই প্রবাদটি সবাই জানি। কিন্তু জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঠিক কী ভূমিকা রাখছে, খুব কম লোকই তা বোঝে বলে মনে হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর কল্যাণে যে কেউ অনলাইনে অবারিত তথ্যপ্রবাহ থেকে নিজের জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে পারে। আমাদের সমাজ, অর্থনীতি ও বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রভাব ফেলার ক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যম যে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, আজকের বিশ্বে তা অনস্বীকার্য।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হলো এক নব গণমঞ্চ, যা মানুষকে চিন্তাচেতনার আদান-প্রদানে, একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হতে, সম্পর্ক তৈরিতে, কোনো উদ্দেশ্যে সবাইকে সমবেত করতে, পরামর্শ পাওয়া ও দিকনির্দেশনা দেওয়ার সুযোগ করে দেয়।
সমস্বার্থের গোষ্ঠীগুলোকে—যেমন শিক্ষার্থীদের তাদের শ্রেনিকক্ষের বাইরেও— পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সমন্বিত প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ করে দেয় সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যম। এই যোগাযোগমাধ্যম শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতি, শ্রেণিবৈষম্য, স্বাস্থ্য, সম্পর্ক প্রভৃতি নানা বিষয়ে নানা মতের মানুষকে তাদের সৃজনশীলতা প্রকাশে ও পারস্পরিক সহযোগ সৃষ্টিতে সাহায্য করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুবাদে কত্ত সুবিধাই না আমরা পাচ্ছি—বিশ্বব্যাপী বন্ধুবান্ধব, পরিবারবর্গের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারছি, দেশ ও সংস্কৃতির দেয়াল ভেঙে ফেলতে পারছি। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেরও মন্দ দিক আছে।
আমাদের জীবনে সামাজিক মাধ্যমের খারাপ প্রভাবও আছে। একদিকে বিচ্ছিন্নতা, অন্যদিকে বৈশ্বিক পরিব্যাপ্তি—এই দুইয়ের যুক্তপ্রভাব আমাদের সংস্কৃতিকে ক্ষয়িষ্ণু করে দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা হরণ করছে। আমাদের মানবিক, শারীরিক ও আবেগিক সাহচর্যকে প্রতিস্থাপিত করছে ইন্টারনেট যোগাযোগ দ্বারা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের আত্মসংযম কেড়ে নিয়েছে। স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে। বিপরীতে এ মাধ্যম আমাদের এমন কিছু গ্রুপে যোগ দিতে প্ররোচিত করে যেখানে বিকৃত সব কথাবার্তা চলে যা আমাদের কানকে কলুষিত করে এবং পরিণতির কথা ভুলে আমাদের চেতনাবোধ যাতে বিস্ময়াভূত হয়।
পরিতাপের কথা এই যে, এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের অন্যতম বড় এক অসামাজিক প্রজন্মে রূপান্তরিত করছে। এখন আমরা ফোনে আলাপ করা চেয়ে খুদে বার্তায় যোগাযোগ করতে পছন্দ করি। মুখোমুখি সাক্ষাতের চেয়ে বরং অনলাইনে কথা বলাই শ্রেয় মনে করছি। এমনকি অনেকে ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামের মতো সহজলভ্য মঞ্চগুলো দিয়ে মানবীয় মিথস্ক্রিয়াকেও প্রতিস্থাপন করে ফেলেছে।
‘হাউ নট টু বি অ্যালোন’ (নিঃসঙ্গতা এড়াব কীভাবে) শীর্ষক প্রবন্ধে জোনাথন সাফরান ফোর লিখেছেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতিটা পদক্ষেপ আমাদের আবেগময় উপস্থিতিকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ করে দিয়েছে, মানবতা প্রকাশের চেয়ে তথ্য জানানোর পথ সুগম করেছে।’ যত দিন যাচ্ছে, এ কথা ততই সত্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
এই গবেষণার উদ্দেশ্য হলো, সামাজিক মাধ্যমের প্রধান তিন ধরনের নেতিবাচক প্রভাবের প্রমাণাদি পেশ করা। পৃথক গবেষণায় স্বতন্ত্রভাবে নানা গবেষক এসব মন্দ প্রভাবের প্রমাণ দিয়েছেন। প্রথমত, সামাজিক মাধ্যম অনলাইন ‘সম্পর্কের’ এবং ভাসা-ভাসা বন্ধুত্বের বোধ জিইয়ে রাখে যা শেষে আবেগিক ও মানসিক সংকটক সৃষ্টি করে। দ্বিতীয় যে ক্ষতিটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম করে, তা হলো, পারিবারিক ও ব্যক্তি জীবন থেকে সময় কেড়ে নিয়ে এ মাধ্যমের প্রতি সহজেই আসক্তি তৈরি করে। এ কারণে আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের নৈপুণ্য নষ্ট হতে থাকে এবং শেষে অসামাজিক আচরণ বেড়ে যায়। এবং তৃতীয়ত, অপরাধী, অনিষ্টকারী ও সন্ত্রাসীদের জন্য বিভিন্ন অপকর্ম ঘটানোর একটা হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে সামাজিক মাধ্যম। এই অপরাধকর্মের সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমের কারণে সৃষ্ট মানসিক সমস্যা কী সম্পর্ক— শেষে আমরা তা দেখব।
২. পটভূমি
সামাজিক মাধ্যমের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে প্রথমে আমি দৃষ্টিপাত করব। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে যে, সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের বেশি কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। একত্রে কাজ করা জন্য সমমনা মানুষদের দল গঠনে কার্যকর ভ‚মিকা রাখে সামাজিক মাধ্যম।
সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলো স্কুলে ভালো কিছু করার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ সহায়ক ভূমিকা রাখে। বিশেষত শ্রেণিকক্ষের বাইরে দলগত প্রকল্প (গ্রুপ প্রজেক্ট) ও স্কুল থেকে পাঠোত্তর প্রদত্ত কাজের (অ্যাসাইনমেন্ট) বেলায় শিক্ষার্থীদের পরস্পরকে সংযুক্ত হবার সুযোগ করে দেয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
উদাহরণস্বরূপ, ফেসবুক শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠোত্তর প্রদত্ত কাজের ধারণাগুলো আদান-প্রদানের সুযোগ করে দেয়। কিছু স্কুল ব্লগকে মতো শিক্ষা উপকরণ হিসেবে সফলভাবে ব্যবহার করে, যেখানে ইংরেজিতে দক্ষতা বাড়ানোর, লিখিত আকারে ভাবপ্রকাশ ও সৃজনশীলতার ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিপণন মাধ্যম হিসেবেও দারুণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেহেতু ব্যাপকহারে বাড়ছে, বিভিন্ন কোম্পানি পণ্যের বিপণনে এই আঙিনা ব্যবহার করছে। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পণ্যের বিজ্ঞাপন দেয়, যেখানে তারা ব্র্যান্ডের প্রচার চালায়, পণ্যের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা তুলে এবং গণসচেতনতা সৃষ্টি করে। প্রকৃতপক্ষে, কোম্পানিগুলো তাদের লাভের পরিমাণ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে বিজ্ঞাপনের প্রচারযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। সত্যি বলতে কি, কার্যযজ্ঞ সচল রাখার জন্য উপার্জনপ্রবাহ ত্বরাণ্বিত করতে বিজ্ঞাপনকেই মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সামাজিক মাধ্যম কোম্পানিগুলো।
উপরন্তু, প্রচলিত ধারার সংবাদমাধ্যম কিংবা অন্য যেকোনো যোগাযোগমাধ্যমের তুলনায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে দ্রুততার সঙ্গে তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের নিত্যকার উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কেউ নিখোঁজ হলে তার ছবিসমেত জরুরি সংবাদ আমরা স্মার্টফোনেই সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোয় পেয়ে যাই। লক্ষণীয় বিষয় হলো, সংবাদগুলো আমরা সরাসরি তাদের থেকেই পেয়ে যাচ্ছি, যাদের জীবনে ওই সংবাদ-ঘটনাটা ঘটেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে ছড়িয়ে পড়া কিছু ঘটনার মধ্যে উদাহরণ হিসেবে বলায় ২০১২ সালে [যুক্তরাষ্ট্রের] কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের অরোরায় সিনেমা হলে বন্দুকহামলা, ২০১৩ সালে বোস্টন ম্যারাথনে বোমাহামলা এবং জিম্বাবুয়েতে কয়েক সপ্তাহ আগে সিসিল নামের সিংহের মৃত্যুর কথা।
এসব ঘটনায় দেখা গেছে, প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের তুলনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দ্রুততার সঙ্গে কথা ছড়িয়ে দিয়েছে, ঘটনাগুলোয় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে আওয়াজ তোলার সুযোগ দিয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে দ্রুততার সঙ্গে তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বোস্টন ম্যারাথনে বোমাহামলার ঘটনা একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
হামলার পরপরই এফবিআই দুই সন্দেহভাজনের ছবি প্রকাশ করে, তাৎক্ষডুকভাবে সেই ছবি টুইটার, ফেসবুক ও রেডিটে ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক মাধ্যমে গ্রুপ তৈরি করে ওই হামলার ছবি ও তথ্য সবাই ছড়িয়ে দিতে শুরু করে। এ ধরনের তথ্যজ্ঞাপনকে জন-উৎস (ক্রাউডসোর্সিং) বা জন-গোয়েন্দা (ক্রাউড-স্লিউথিং) নামে অভিহিত করা হয়। এর ফলে পুরো দেশ যেন জেগে ছিল; পালানোর কোনো জো পায়নি দুষ্কৃতকারীরা। সপ্তাহ পার না হতেই এক সন্দেহভাজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় এবং অপরজনকে হেফাজতে (কাসটোডি) নেওয়া হয়। এগুলো হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অনেক উপকারিতার কয়েকটি উদাহরণ মাত্র।
ফেসবুক হলো অন্যতম জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম। বিশ্বব্যাপী এ মাধ্যমের ১৪০ কোটি ব্যবহারকারী আছে, যা পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। পৃথিবীকে ছোট্ট গ্রামে রূপান্তর করে এই মাধ্যম কোনো কিছু জানতে-বুঝতে, শিখতে ও তৎক্ষণাৎ তথ্য আদান-প্রদানে আমাদের সাহায্য করে।
তবে এসব উপকারী দিক থাকা সত্ত্বেও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সমাজে ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রভাবও ফেলছে। এই প্রবন্ধে আমি তিনটি মুখ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করব, যা আমার গবেষণায় উঠে এসেছে। এগুলো হলো : এক. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মানসিক সমস্যা, দুই. অপরাধীদের হাতিয়ার হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং তিন. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অপরাধকর্মের মধ্যে সম্পর্ক।
মূল : জ্যাকব আমেদি। ভাষান্তর : জাহাঙ্গীর আলম, শিক্ষার্থী, মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।