শনিবার, ২৯ Jun ২০২৪, ০৬:২৭ পূর্বাহ্ন

সৌদি আরবে ওমরাহ বা ট্যুরিস্ট ভিসায় হজ করা কেন ‘অবৈধ’

সৌদি আরবে ওমরাহ বা ট্যুরিস্ট ভিসায় হজ করা কেন ‘অবৈধ’

স্বদেশ ডেস্ক:

প্রত্যেক মুসলমানের জীবনে ইচ্ছা থাকে জীবনে একবার হলেও হজ করা। কিন্তু প্রতি বছর সর্বোচ্চ মাত্র ২০ লাখ মুসলমান হজ করতে পারেন।

সৌদি আরব সরকার জানিয়েছে যে এই বছর প্রায় ১৮ লাখ মানুষ হজ করেছেন। তারা সৌদি কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত আনুষ্ঠানিক হজ পদ্ধতিতে হজ পালন করেছেন। এই নিয়ম লঙ্ঘন করে যারা হজ করেছেন, তারা এই পরিসংখ্যানের অন্তর্ভুক্ত নন।

সৌদি আরবে এ বছর হজ পালন করতে গিয়ে ১৩০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যাদের অধিকাংশই মারা গিয়েছেন তাপমাত্রা ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাওয়ায় প্রচণ্ড গরমের কবলে পড়ে।

বার্তা সংস্থা এএফপির মতে, মৃতদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ‘অনিবন্ধিত’ হজযাত্রী, যারা ‘অবৈধ উপায়ে’ হজে যোগ দিয়েছিলেন।

তারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাঁবু এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের মতো সুবিধাগুলো নিতে পারেননি।

এখানে প্রশ্ন উঠেছে, কী কারণে কিছু মানুষ ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে অবৈধ পন্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হয়?

এই অবৈধ পন্থাগুলো কী এবং যারা ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই অবৈধ উপায় বেছে নেন তারা হজের সময় কোন কোন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন?

ওমরাহ বা ট্যুরিস্ট ভিসায় হজ কীভাবে সম্ভব?
পাকিস্তানের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক সাজ্জাদ কামার বিবিসির সংবাদদাতা সানা আসিফকে জানিয়েছেন, অনেকেই ওমরাহ বা ট্যুরিস্ট ভিসায় হজ করেন, যা একটি অবৈধ উপায়।

তিনি বলেন, ‘সৌদি সরকার ভিজিট ভিসায় ওমরাহ করার অনুমতি দেয় এবং অনেকে তা করেন। কিন্তু ভিজিট ভিসায় হজের অনুমতি নেই এবং সৌদি সরকার তা বিশেষভাবে নিষেধ করে।’

অধ্যাপক সাজ্জাদ কামার ব্যাখ্যা করেছেন যে ‘জিলক্বদ এবং জিলহজ্জ মাসে, কোন ভিনদেশী যদি সৌদি আরবে ভিজিট ট্যুরিস্ট ভিসায় আসেন তাহলে তাকে জেদ্দা বিমানবন্দরে অবতরণের অনুমতি দেয়া হয় না।’

‘এই দুই মাসে যারা ভিজিট ভিসায় আসেন তারা মদিনা, মুনাওয়ারা, রিয়াদ এবং দাম্মাম বিমানবন্দর যেতে পারেন।’

অধ্যাপক সাজ্জাদ জানান, ‘যাদের কাছে হজ পারমিট নেই এবং যারা ভিজিট ভিসা এসেছেন, তারা অন্য বিভিন্ন শহর হয়ে হজের স্থলে পৌঁছায় এবং কিছু হজ গ্রুপে যোগ দেয়।’

উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি পাকিস্তানের করাচি শহর থেকে যান, তিনি ইহরাম না পরে মদিনা, তায়েফ বা অন্যান্য শহরে পৌঁছে হজে যোগ দেন।

কী সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন ‘অবৈধ’ হজযাত্রীরা?
অধ্যাপক সাজ্জাদ কামারের মতে, হজ পারমিট ছাড়া একজন ব্যক্তি কোথাও নিবন্ধিত হতে পারেন না।

‘তারা কোনো সরকারি প্রকল্পের অংশ নয়, তারা কোনো বেসরকারি হজ গ্রুপের অংশ নয়, তাই তারা নিজেরা সব কিছুর ব্যবস্থা করে, যেমন মক্কায় পৌঁছানো এবং তারপর সেখানে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা।’

তার মতে, এই পন্থায় আসা হজযাত্রীরা মিনা, মুজদালিফা, মুশাইরা এবং আরাফাত কোথাও কোনও সুবিধা (আবাসন, খাবার, পরিবহন) পান না।

যেখানে কী না একজন নিবন্ধিত হজযাত্রী নানা সুবিধা পেয়ে থাকেন। কারণ এসব স্থানে নিবন্ধিত হজযাত্রীদের জন্য সৌদি সরকার সব ব্যবস্থা করে রাখে।

অধ্যাপক সাজ্জাদ কামার আরো বলেন, ‘কিছু লোক তাদের পরিচিতি ও সম্পর্কের কারণে তাঁবুতে জায়গা করে নিতে পারেন, কিন্তু সেখানে এমন অসংখ্য হজযাত্রী থাকেন যাদের এসব তাঁবুতে কোনো প্রবেশাধিকার নেই।’

একটি তাঁবুর ভিতরে জায়গা খুব কম থাকে, এমন কী বাড়তি একজনের জন্যও অতিরিক্ত কোনো জায়গা থাকে না।

এ কারণে অবৈধ উপায়ে যাওয়া মানুষেরা পথে পথে ঘুরতে থাকেন। তারাই প্রতিকূল আবহাওয়ায় বিশেষ করে প্রচণ্ড গরমে আক্রান্ত হন এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন, যেমনটি এবারো হয়েছে।

অধ্যাপক সাজ্জাদ কামারের মতে, এটা নতুন কিছু নয় বরং এটা অহরহই ঘটছে, বহু বছর ধরেই এমনটা হয়ে আসছে এবং এভাবে অবৈধ উপায়ে আসা হজযাত্রীর সংখ্যা অনেক বেশি। এবার গরমের কারণে বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে।

অবৈধভাবে হজ করার কারণ কী?
বিবিসি আরবি বিভাগের প্রতিবেদন অনুসারে, অনেক কারণে কিছু মানুষ এই অবৈধ পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ হলো অর্থ এবং বয়স।

হজের খরচ বেশি হওয়ায় অনেকেই সরকারি অনুমতি ছাড়াই হজ করতে প্ররোচিত হন।

উল্লেখ্য, ২০২০ সালে সরকার হজ আদায়ের জন্য পাকিস্তান থেকে আসা ব্যক্তিদের থেকে জনপ্রতি প্রায় পাঁচ লাখ রুপি করে নিয়েছিল, যা ২০২২ সালে বেড়ে সাত লাখ ১০ হাজার রুপি হয় এবং ২০২৩ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১২ লাখ রুপিতে।

মিসরের ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর হজ ফ্যাসিলিটেশন অনুসারে, সবচেয়ে সস্তা হজ প্রোগ্রামের জন্য খরচ হয় এক লাখ ৯১ হাজার মিসরীয় পাউন্ড অর্থাৎ প্রায় চার হাজার মার্কিন ডলার, যেখানে বিমানে হজের জন্য সবচেয়ে সস্তা প্যাকেজ দুই লাখ ২৬ হাজার মিসরীয় পাউন্ড।

জর্ডানে হজ ফি বাবদ খরচ হয় প্রায় তিন হাজার দিনার, যা চার হাজার দুই শ’ মার্কিন ডলারের সমান, যেখানে ভিজিট ভিসার মাধ্যমে একজন হজযাত্রীকে ‘পাচার’ করতে খরচ হয় প্রায় এক হাজার দিনার (প্রায় ১৪০০ ডলার)। কখনো কখনো দুই হাজার দিনার বা প্রায় ২৮০০ ডলারও খরচ হয়ে থাকে।

অন্যদিকে, জর্ডান থেকে সরকারি উপায়ে হজের খরচ প্রায় তিন হাজার ৯০ দিনার। এছাড়া ফ্লাইটে গেলে এবং মসজিদে নববীর পাঁচ শ’ মিটার আঙিনার মধ্যে অবস্থিত কোনো পাঁচ-তারা হোটেলে থাকলে এই খরচ বেড়ে চার হাজার সাত শ’ দিনার পর্যন্ত উঠে যেতে পারে।

অন্যদিকে বিবিসি বাংলার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে চলতি বছর সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে যাওয়ার সর্বনিম্ন প্যাকেজ প্রায় পাঁচ লাখ ৭৯ হাজার টাকা ধার্য করা হয়েছে। আর, বেসরকারিভাবে সর্বনিম্ন প্যাকেজ প্রায় পাঁচ লাখ ৯০ হাজার টাকা।

এর আগে ২০২৩ সালে সরকারিভাবে হজ প্যাকেজের খরচ ধরা হয়েছিল ছয় লাখ ৮৩ হাজার টাকা। বেসরকারি প্যাকেজে খরচের সর্বনিম্ন সীমা ছয় লাখ ৭২ হাজার টাকা স্থির করা হয়।

অর্থাৎ গত বছর দুই ব্যবস্থাপনাতেই প্রায় ৯০ হাজার টাকা করে বেশি খরচ হয়েছিল।

নিসাক কার্ড কী এবং ‘অবৈধ হজ’ বন্ধ করতে সৌদি সরকার কী করছে?
সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হজ মৌসুমে ভিজিট ভিসায় কাউকে মক্কায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।

সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ বিষয়ক জাতীয় কমিটির উপদেষ্টা সাদ আল-কুরাইশি বিবিসিকে বলেছেন ‘যাদের কাছে হজ ভিসা নেই তাদের এখানে থাকতে দেয়া হবে না এবং তাদের নিজ নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে।’

তিনি বলেন ‘নিসাক’ কার্ডগুলো হজযাত্রীদের সনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয়, যা সরকারি তত্ত্বাবধানে যাওয়া হজযাত্রীদের দেয়া হয় এবং পবিত্র স্থানে প্রবেশের জন্য এই কার্ডে বারকোড দেয়া থাকে।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, কিছু লোক এ ধরনের জাল কার্ড তৈরির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে।

আল-কুরাইশি আরো জানান যে হজ পালনের স্থানে থাকা নিরাপত্তা কর্মীরা অবৈধ হজযাত্রীদের বের করে দিচ্ছে।

‘বিভিন্ন আবাসিক ভবনে যেখানে নিয়ম লঙ্ঘনকারীরা অবস্থান নেন, সেখানেও অভিযান চালিয়ে তাদের উচ্ছেদ করা হয় এবং তাদের মক্কা থেকে জেদ্দায় পাঠানো হয় এরপর সেখান থেকে তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়,’ তিনি জানান।

তার মতে, ‘কিছু মানুষ হজযাত্রীদের থেকে অর্থ আদায় করে তাদের ভিজিট ভিসায় হজে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করে, যদিও এই ভিসায় হজ করার অনুমতি নেই।’

অধ্যাপক সাজ্জাদ কামার সৌদির পদক্ষেপের বিষয়ে ব্যাখ্যা বলতে গিয়ে বলেন, সৌদি সরকার তাদের নিয়ম জানিয়ে প্রতি বছর নিয়মিত হ্যান্ডআউট বা বিবৃতি দেয়। সৌদি সরকার বিশ্বের অন্যান্য দেশের সরকারকেও জানিয়ে দেয় যে ভিজিট ভিসায় হজের অনুমতি নেই।

এবার সৌদি সরকার খুব জোরালোভাবে এ ঘোষণা দিয়েছে। সৌদি আরবের হজমন্ত্রী তৌফিক আল-রাবিয়াহ নিজেই ঘোষণা করেছেন যে ভিজিট ভিসায় হজ নিষিদ্ধ।

তিনি আরো বলেছেন যে সৌদি সরকার তার নাগরিকদের কঠোরভাবে জানিয়েছে যে যাদের হজের অনুমতি নেই, কিন্তু নিয়ম ভেঙে হজ করার চেষ্টা করবে তাদের জরিমানা করা হবে।

অন্যদিকে বিদেশীদের জন্য, পরবর্তী ১০ বছর বা আজীবনের জন্য সৌদি আরবে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হবে। এতো কঠোরতার পরও বহু মানুষ এখনো অবৈধভাবে হজ পালনের চেষ্টা করেন।

অধ্যাপক সাজ্জাদ কামারের মতে, হজ উপলক্ষে ২০ থেকে ২৫ লাখ লোকের আনাগোনা হয়। তাই এতো মানুষের মধ্যে থেকে অনিবন্ধিত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা খুবই কঠিন কাজ।

এ বিষয়ে আলেমদের অবস্থান কী?
সৌদি আরবের সিনিয়র স্কলার কাউন্সিল নিশ্চিত করেছে যে হজ পারমিট শরিয়া অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়েছে এবং তারা স্পষ্টভাবে এটাও জানিয়েছে যে ‘অনুমতি ছাড়া হজে যাওয়া জায়েজ নয় এবং যারা তা করে তারা পাপী।’

মিসরে ফতোয়া হাউসের সেক্রেটারি ডক্টর মুহাম্মাদ আবদুল সামি নিশ্চিত করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ওমরাহ করতে যায় এবং হজের মৌসুমের অপেক্ষায় লুকিয়ে থাকে, সে শরিয়া মোতাবেক গুনাহ করে কারণ তা জায়েজ নয় কিন্তু তার হজ ও ওমরাহ হয়ে যাবে।’

তিনি বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, ‘ঘটনাটি এমন যে একজন নামাজ আদায়ের জন্য অজু করতে পানির বোতল চুরি করেছে।’

এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, তার নামাজ ঠিকই হবে কিন্তু অবৈধভাবে পানি সংগ্রহের জন্য তার গুনাহ হবে।

মিসরীয় ফতোয়া হাউস তার অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে, অনুমতি ছাড়া হজের হুকুম সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ‘অনুমতি ছাড়া হজ অনেক সমস্যার সৃষ্টি করে।’

তার মতে, ‘যদি হজযাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকে, তাহলে এর ফলে হজে বিভিন্ন সমস্যা, যেমন অতিরিক্ত ভিড়-সহ নানা অসুবিধা দেখা দেয়।’

সূত্র : বিবিসি

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877