বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ১০:১২ অপরাহ্ন

আবরারের ‘মৃত্যু’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মৃত্যু’…?

আবরারের ‘মৃত্যু’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মৃত্যু’…?

তৌকির হোসেন: বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের ‘অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু’ এক অর্থে ‘বিশ্ববিদ্যালয়েরই মৃত্যু’ ঘোষণা করেছে। আমরা সবাই জানি এটি কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। তারই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত বিশ জন শিক্ষার্থী প্রত্যক্ষভাবে তাকে নির্মম নির্যাতন করেছে, যার পরিণতিতে আবরার মারা যায়। নির্যাতন করে এই খুনের কারণ? আবরার ফাহাদ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিন্ন নদীর পানি দেওয়া-নেওয়া নিয়ে রাষ্ট্রীয় চুক্তির সমালোচনা করে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। বুয়েটের শেরে বাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে, বুয়েট ছাত্রলীগের কিছু ‘বড় ভাই’ (নেতাকর্মী) তাকে ডেকে নিয়ে ফোন, ফেইসবুক চেক করে, ‘শিবির সন্দেহে’ জেরা করে, মারধর করে। এবং অন্তত ছয়-সাত ঘণ্টার এই রিমান্ড ঘরানার জেরা, মারধর শেষ হলে আবরার ফাহাদের লাশ সিঁড়িতে ফেলে রাখা হয়। অথচ বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের বক্তব্য, ‘আমি আমার বিবেকের কাছে পরিষ্কার’।
প্রথমত, আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর ফোন, ফেইসবুক চেক করার অধিকার বা দায়িত্ব আরেক শিক্ষার্থী গ্রেফ ‘বড় ভাই’ কিংবা ‘ছাত্রলীগের নেতা’ হওয়ার কারণে পায় কি না সেই প্রশ্ন করা দরকার। আমাদের মনে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছবি আঁকা থাকে তাতে বস্তুত মনে হয়, প্রতিটি শিক্ষার্থী এই জায়গায় এলে স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ পাবে। একজনের ব্যক্তিগত বিষয় অন্যের নাক গলানোর এখতিয়ারে পড়বে না। অন্তত, দেশের ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলো’ এমন উদারনৈতিক আদর্শের চর্চাই হওয়ার কথা। বাস্তবে এসব হয় না। দ্বিতীয়ত, ‘শিবির সন্দেহে’ কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলা কি এখন বাংলাদেশে তাহলে জায়েজ? যেটা কি না সন্দেহ এবং যেই সন্দেহ যে কেউ করতে পারে এরকম একটা পরিবেশ তাহলে এখন তৈরি করা হয়ে গেছে? আর ‘শিবির করা না করা’ যদি পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের ব্যাপারই হয় তাহলে কি আর আইন-আদালতের চৌহদ্দিতে মোকাবিলা করার দরকার পড়ে না বরং তার বিচার/শাস্তি সবটাই গিয়ে ঠেকে ছাত্রলীগের কক্ষে, বড় ভাইদের কক্ষে? ‘শিবির’ হলে সে কি আর মানুষ থাকে না নাকি তাকে পিটিয়ে মারার সমুদয় সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থিত হয়ে পড়ে? এগুলো কেবল প্রশ্ন না। বরং এই প্রশ্নগুলোর দিকে তাকালে বর্তমান বাস্তবতা বোঝা যায়। মিশেল ফুকো যাকে বলেছেন ডিসকোর্স, যা আমরা ধরেই নিই আমাদের চারপাশে যা ঘটছে তা সত্য ও স্বাভাবিক; তাকে চিহ্নিত করতে চাইলে অন্তত এইরকম প্রশ্নগুলো করা দরকার। তখন অন্তত বোঝা যায়, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক ডিসকোর্স শুধু বিশ্ববিদ্যালয় কেন, পুরো দেশেরই রাজনৈতিক ডিসকোর্স কোন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে।
আবরার ফাহাদকে গণিতের খাতা খোলা রেখেই বড় ভাইদের কক্ষে যেতে হয়েছে কেন? বড় ভাইরা ডেকেছে বলে? নেতারা ডেকেছে তাই? নাকি এইরকম ডাকাডাকি সবসময়ই চলে, প্রতিদিনকার চর্চিত একটি অভ্যাসের বলে? যারা বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন, হলে থাকেন তারা খুব ভালো করেই অবগত আছেন এটি আসলে কীসের অভ্যাস। সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্কের অজুহাতে অগ্রজের অনুজের ওপর অত্যাচারের বৈধতা। এক কথায় যাকে আমরা বুঝি, ‘গেস্টরুম কালচার’ হিসেবে, ‘র‌্যাগিং কালচার’ হিসেবে। বুয়েটের হলে রাত বারোটা বাজে সিনিয়র ভাইয়েরা জুনিয়রদের নিয়ে কীসের মিটিং করে, কাদের জোকার বানায়, লাঞ্ছিত করে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হলগুলোতে গেস্টরুমে নয়টার পর কাদের দাঁড় করিয়ে রাখা হতো, এমনকি শীতের ঠান্ডায়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু বকর, হাফিজুর কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তাপসের মৃত্যু বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক বলির যে সিলসিলা, তারই সর্বশেষ সংযোজনÑ আবরার ফাহাদ। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতিই এক ধরনের সামাজিক অভ্যাস তৈরি করেছে। যার বলে যে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের কোনো বড় ভাই, তার অনুজদের কেবল এক ডাকেই উপস্থিত করবার এখতিয়ার রাখেন, যে কোনো সংঘবদ্ধ নেতাদের কক্ষে গণিত কষতে থাকা কোনো ছাত্রকে উঠিয়ে নিয়ে এসে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা যেতে পারে অমুক স্ট্যাটাস কেন দেওয়া হলো, তুমি কি ‘শিবির’, তুমি কি ‘বাম’? এই খুনের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজমান এই চর্চা, সিনিয়র-জুনিয়রের ‘চেইন অফ কমান্ড’ অনেকাংশে দায়ী। একে অস্বীকার করা যায় না। আবার এই পড়ালেখা করা নেতারা কোন ক্ষমতার বলে একটা খুন করার ‘অধিকার’ পর্যন্ত লাভ করে তাও আমাদের দেখা উচিত। একই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী হয়ে কখন একজন আরেকজনের ওপর এমন প্রভাব, র্কর্তৃত্ব বিস্তার করবার তাকদ অর্জন করে তাও আমাদের বোঝা উচিত। এই খুনের পর সবচেয়ে জোরগলায় যে দাবিটি বুয়েট থেকে উঠে আসছে তা হলো ‘ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা উচিত’। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা আদতে খুব ভালো কোনো বিষয় না বরং এটি ক্ষমতাসীনদের শক্তিই আরও পোক্ত করবে, বিরোধী দলের কোনো অবস্থান তৈরিতে ভূমিকা রাখবে না। বরং এইখানে স্পষ্ট করে বলা উচিত, ছাত্ররাজনীতির কোন কোন চর্চা বন্ধ করা দরকার? যে ছাত্ররাজনীতি ক্ষমতার গন্ধ শোঁকায়? না যে ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের হত্যাকারীতে পরিণত করে? যে ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে নিপীড়ন-নির্যাতন নিশ্চিত করে? না যে ছাত্ররাজনীতি ক্যাম্পাসে ছাত্রদের অধিকারের কথা বলে? বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যদি রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা হাজির না থাকে, তবে সেই ক্যাম্পাস কেবলই সার্টিফিকেটের কারখানায়, ব্যবসায়িক ক্যাম্পাসে পরিণত হবে। প্রাণবর্জিত, মৃত তেমন ক্যাম্পাসে ‘প্রশ্ন করবার কোনো শক্তি’ অবশিষ্ট থাকবে না।
প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাহিত্যিক-সমালোচক টেরি ইগলটনের আলোচিত প্রবন্ধ ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্যু’ এই অবস্থায় খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয়। ইগলটন অবশ্য আলোচনা করেছেন পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে আরও ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছে, মানবিক বিষয়গুলোকে পঠনপাঠনের জায়গা থেকে দূরে সরিয়ে বাজারে যেসব চলে সেই বিষয়গুলো পড়ানোর ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠেছে। যে বিষয়গুলোর বাণিজ্যিক মূল্য রয়েছে সেগুলো কোর্সে অন্তর্ভুক্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠছে অধিক উৎসাহী। শিক্ষকরা হয়ে উঠছেন বিক্রেতা, শিক্ষার্থীরা ক্রেতা। একটা আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, বিশ্ববিদ্যালয় চালনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে প্রতিস্থাপন করেছে। কয়েক সপ্তাহ আগে, খুব করে চাউর হয়েছিল, বাংলাদেশি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’-এর প্রথম ১০০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকায় স্থান পায়নি। এর নানা কারণ তখন আলোচিত হয়েছে। মানসম্পন্ন জার্নাল নেই, বলার মতো গবেষণাপত্র নেই ইত্যাদি। পরে আরেক পত্রিকার মারফতে জানা গেল, দুই একটি যা গবেষণাকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে তার সবগুলোই জীববিজ্ঞান বা প্রথাগত বিজ্ঞানকেন্দ্রিক। সমাজবিজ্ঞানে কোনো অবদান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই! সমাজবিজ্ঞান, মানবিক বিষয়গুলো এখানে অনেকটা অচ্ছুতের মতো, মানুষের মাঝে এসবের গুরুত্ব ক্রমশই কমছে ব্যবসায়িক বিষয়সমূহের সঙ্গে প্রতিযোগিতায়। কোন বিষয় পড়লে ঠিকঠাক চাকরি পাওয়া যাবে, না পড়িয়ে কীভাবে প্রমোশন পাওয়া যাবে, না জেনে কীভাবে লেকচারার হওয়া যাবে এইরকম চর্চায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হাবুডুবু খাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় এখন অনেক বেশি প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের আখড়া। জ্ঞানচর্চা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়তে নেই যেন!
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-ছাত্রদের মধ্যে দূরত্ব যোজন যোজন। যে কারণে, ছাত্রকল্যাণ পরিচালক বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকেন, ভিসি সংবাদ শুনে হয়ে পড়েন অসুস্থ। তবে শিক্ষকরাও সংহতি জানিয়েছেন ছাত্রদের সঙ্গে, এ আমাদের আশা জোগায়। তবে এই সম্পর্ক মজবুত হলে সম্ভবত অভিভাবকের জায়গা ‘বড় ভাই’ বা ‘নেতারা’ নিয়ে নিতে পারত না। যেখানে জ্ঞানচর্চার অনুপস্থিতি প্রকট, যেখানে নেতার ক্ষমতার রাজনীতি তুঙ্গে, যেখানে ক্ষমতা সম্পর্কই সব নির্ধারণ করে, সেখানে শিক্ষার্থীদের জানমালের নিরাপত্তা থাকার কথাও না। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জীবনের নিশ্চয়তাটুকু থাকে না, তাকে আমরা ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ কোন যুক্তিতে বলব? এখন যদি এই চিন্তা করবার ক্ষমতাটুকুও ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দিয়ে শেষ করে দেওয়া হয়, তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? তখন ফাহাদের মতো কেউ খুন হলে আপনি কীসের ওপর দাঁড়িয়ে কথা বলবেন? কোন ধরনের রাজনীতি বন্ধ করা দরকার সেই বিষয়টি স্পষ্ট করা দরকার। পুরো ছাত্ররাজনীতিই বন্ধ করে দিলে, জবাবদিহির কোনো শক্ত জায়গা থাকে না। আবু বকর-হাফিজুর-তাপসদের সিলসিলায় এবার ফাহাদ যুক্ত হলো। আমরা জানি না, এরপরে আর কার কার নাম যুক্ত হবে?

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877