মিতবাক: উজ্জ্বল রঙের ফুলে ঢাকা বড় বড় গাছ, পথে ঝরা ফুলের গালিচা বিছানো। সারবাঁধা বিশাল বিশাল মহীরুহ শহরের আঁচলজুড়ে। পরিষ্কার রাস্তাঘাট, হাসিমুখ মানুষজন। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় সারা বছরই উপভোগ্য। নাইরোবি শহরের কথা বলছি। এদিকে, দেশের জন্য উথালিপাথালি মন। ভারতে ফিরব পাকাপাকি, অতএব মাসাইমারা একবার চাই-ই। নভেম্বরের মাঝামাঝি, চলেছি মাসাইমারা, তিনজনে। দিগন্ত ফুঁড়ে ছুটেছে মসৃণ কালো ঝকঝকে রাস্তা। গাড়ি ছুটছে হু-হু, স্পিডোমিটার দেখে চক্ষু ছানাবড়া। পথপাশে পশরা সাজিয়ে বসেছেন গ্রামবাসীরা। উজ্জ্বলরঙা সবজির কোলাজ, যেন আঁকা ছবি। পথের পাশে সাইনবোর্ড। পশুদের চলাচলের রাস্তায় গাড়ির স্পিড নিয়ন্ত্রিত। সবাই মেনে চলেন। মাঠে ছাগল-গোরুর মতো কীসব? —ওরে বাবা, জেব্রা! গাড়ি থামিয়ে ক্লিক ক্লিক। পথে ‘কার্নিভোর’ হোটেলে লাঞ্চ, সঙ্গে পরিবেশিত হল সাম্বা নাচ। লম্ফঝম্পতে খাবার ঢুকছে না মুখে।
ভিরমি লাগে, আদিগন্ত রুখাসুখা। এটাই রিফ্ট্ ভ্যালি?
মাসাই বাচ্চারা গোরু, ভেড়া নিয়ে চলেছে, সঙ্গে তাগড়াই কুকুর। এত্তটুকুন বাচ্চা, পিটিরপিটির তাকাচ্ছে। আহা রে! এত দায়িত্বের কাজ? চারদিকে এত হিংগ্র জন্তু!
ড্রাইভারসাব বললেন, ‘কুকুরগুলো রক্ষা করবে।’ তা নাহয় মানলাম, কিন্তু?
এই ‘কিন্তু’কে বাঙালি মায়েরা আঁচলছাড়া করেন না। আমার ছেলেটাকে দেখছি, দেখছি ওদেরকে! চেঁচালেন কর্তাসাহেব, ‘ওটা কী?’
‘মাউন্ট লঙ্গোনট্!’
আগ্নেয়গিরি, ঘুমোচ্ছে একশো বছর ধরে। জাগতে পারে যে-কোনও দিন! ‘এখন জাগিস না বাপু,’ ভয়ে বলি! ছেলে বলে, ‘বেশ মজা জেগে উঠলে।’ আঁতকে উঠি। ওরে থাম!
শেষ দুপুরে পৌঁছলাম রিসর্ট সারোভা-মারা-র তোরণদ্বারে। অনতিদূরে কালো কালো বিন্দু। পিঁপড়ের মতো কিলবিল করছে উইল্ডেবিস্ট। লম্বা-গলা জিরাফ-মা, বাচ্চাসহ।
রূপসী অস্ট্রিচসুন্দরী হেলতে-দুলতে রাস্তা পেরোলেন। পেছনে নতুন পালকে অস্ট্রিচ বাচ্চার দল। গাড়িতে অপেক্ষায় রইলাম।
আর মহারাজ? সন্তর্পণে তাকাই!
রিসর্টে ঢুকতেই, মাসাই-পোশাকে একদল ছেলেমেয়ে ওয়েলকাম জানাল। রিসেপশন রাজকীয়। কর্মীরা সবাই আফ্রিকান, অমায়িক আন্তরিক হাসি। প্রাণ জুড়িয়ে গেল।
দিনের আলো থাকতেই লাগেজ ফেলে দৌড়লাম সাফারি ড্রাইভে। আগে নাইট সাফারি ছিল, এখন বন্ধ।
হুড-খোলা গাড়িতে চলেছি তানজানিয়ার বর্ডারের দিকে। হঠাৎ দেখি, যেমন কালো পিঁপড়েরা পিলপিল ছোটে, তেমনি উইল্ডেবিস্টগুলো দৌড়চ্ছে, এদিক থেকে ওদিকে।
সূর্যাস্তের আলোর মায়ায় চক্ষু ছানাবড়া! কী কান্ড! সিংহীর দল তাড়া করছে, গাড়ির গা ঘেঁষে চলে গেলেন একজন মহারানি। ঘুরেও দেখলেন না, ছোঃ! সামান্য মানুষ! কয়েকটা বাচ্চাও রয়েছে দলে, তাদের ট্রেনিং চলছে।
কুট্টুস-পুটুস বাচ্চারা দুষ্টুমি করছে খুব, ধমক খাচ্ছে মায়েদের থেকে। আমরা হেসে অস্থির।
মহারাজাদের দেখলাম না! ড্রাইভারসাব বললেন, পশুরাজ শিকার করেন না। কিন্তু খাবেন আগে। তারপর রানিরা এবং বাচ্চারা। তাদের পেট ভরে গেলে দল বেঁধে হায়েনারা জুটবে। তারপর শকুনেরা। অরণ্যের পরম্পরা।
একদল পশুরাজ আয়েস করছেন। ঝাঁকড়া কেশরে মনোমুগ্ধকর ঝিলিক, পাশেই সিংহশিশুদের খুনসুটি!
জেব্রা বাচ্চাগুলোও অপুর্ব! মায়াময়! দুই-তিন প্রজাতির হরিণ, উইল্ডেবিস্ট, বাচ্চা সামলে চলেছে।
হাতিদের দলে মাঝখানে বাচ্চা, লংমার্চ, বীরদর্পে। হাজার কিসিমের পাখি। ব্ল্যাক রাইনো, ওয়াইল্ড বাফেলো। ড্রাইভারসাব তাদের সামলে চলেছেন।
কেন? আমরা তো মোষের দুধ খাই। মোষগুলো কলকাতার ফুটপাথে বাঁধা থাকে।
চমকে উঠলেন ড্রাইভারসাব। ‘হোয়াট!’
হুঁহুঁ বাবা, আমরাও চমকে দিতে পারি।
থ্রি-স্টার ফেসিলিটির টেন্ট হাউস, স্বপ্নস্বরূপ। খানদানি ডিনারের পর ফায়ারপ্লেসে বসে ব্ল্যাক কফি নিলাম। বাকিরা প্রায় সবাই ইউরোপিয়ান। ইন্ডিয়ান দেখে আলাপ জমাতে আসছেন। ছেলের টকাটক জবাব, কর্তারও।
ধীরে ধীরে কোনওমতে কথা বলি আমি।
টেন্ট হাউসটা সত্যিই রাজকীয়। সামান্য মধ্যবিত্ত, অনভ্যস্ত বিছানার অতিরিক্ত কোমলতায় রাতঘুম আসে? ছাড়া-ছাড়া ঘুমে পশুদের ভয় ধরানো আওয়াজ। মাসাইমারা অরণ্যের একেবারে গভীরে আমরা।
আফ্রিকান গলায় ভোরবেলায় আন্তরিক ‘জাম্বো’ শুনে ঘুম ভাঙে। বাইরে বেরিয়ে টেন্টের পরদায় হাত দিয়েই ছিটকে ভেতরে ঢুকলেন কর্তাবাবু! —বাইরেই সিংহ!
সে কী? সাংঘাতিক!
উঁকি দিলাম বাইরে। যথেষ্ট সাহস এনে। ও হরি! পাশের টেন্টের বোর্ডার। চেয়ারে টেবিলে শরীর ছড়িয়ে নাসিকাগর্জন-সহ নিদ্রিত।
প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষও অত্যন্ত আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্য।