রবিবার, ০৫ জানুয়ারী ২০২৫, ০১:৩৬ অপরাহ্ন

২০১৪ সালের পথেই হাঁটছেন রওশন!

২০১৪ সালের পথেই হাঁটছেন রওশন!

স্বদেশ ডেস্ক:

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিতে পারেন জাতীয় পার্টির (জাপা) জি এম কাদের। এমন গুঞ্জন রাজনৈতিক মহলে। জি এম কাদেরের সিদ্ধান্ত মেনে কেউ কেউ প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলেও রওশন এরশাদের হস্তক্ষেপে প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে থেকে যেতে পারেন। যেমনটি হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ওই নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিলেও তার স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে ঠিকই নির্বাচনে থেকে যান বড় একটি অংশ। একই ফর্মুলায় এবারো যাতে কোনোভাবেই নির্বাচন থেকে জাতীয় পার্টি সরে যেতে না পারে- এমন প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হচ্ছে বলে গুঞ্জন উঠেছে।

জাপার রওশন ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত একজন বলেন, ম্যাডাম নির্বাচনী ট্রেন মিস করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক মাঠ তো আছে। আগামী ১৭ ডিসেম্বরই ঠিক হবে ম্যাডামের আগামী দিনের ভূমিকা। তার ভাষ্য, জি এম কাদের যদি নির্বাচন থেকে সরেই যান, তা হলে শীর্ষ অন্য নেতারা তো আর তার কথামতো সরবেন না। তখন ম্যাডাম সামনে আসবেন। যেমনটা ২০১৪ সালের নির্বাচনে হয়েছিল। তিনি (রওশন) নির্বাচন করছেন না, এতে সমস্যা কী? উপনির্বাচন করে এমপি হবেন কিংবা সংরক্ষিত আসন তো আছেই!
২০১৪ সালের দশম জাতীয় নির্বাচন বয়কট করেছিল বিএনপি-জামায়াতসহ বেশির ভাগ দল। বিএনপি-জামায়াতবিহীন ওই নির্বাচন থেকে সরে এসেছিলেন জাপার তৎকালীন চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। জি এম কাদেরসহ দলের অনেক জনপ্রিয় নেতা এরশাদের নির্দেশে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু পার্টির কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ সিনিয়র কিছু নেতাসহ দলের একটি গ্রুপকে নিয়ে নির্বাচনে থেকে যান। ২০১৪ সালে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ২০টি আসনে ভোট ছাড়াই এমপি হন। বাকি ১৪৭টি আসনে নির্বাচন হয়। সেখানে জাপা জিতেছিল ১৩টি আসনে। আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতার ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি মোট ৩৩টি আসন পায়।

সূত্রে জানা যায়, গত প্রায় তিন বছর ধরে সরকারের কঠোর সমালোচনা করে আসছিলেন জি এম কাদের। নির্বাচনের পরিবেশ নেই বলে সর্বশেষ গত ১১ নভেম্বর এক সভায় বক্তব্য রাখেন তিনি। গত ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তফসিল অনুযায়ী আগামী ৭ জানুয়ারি ভোট। আগামী ১৭ ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। জাতীয় পার্টি মোট ২৯৪টি আসনে প্রার্থী দেয়। তবে ২৭২টি আসনে তাদের প্রার্থিতা রয়েছে।
বিএনপি-জামায়াতবিহীন নির্বাচনে আগের মতোই আসন সমঝোতার জন্য প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতাদের মধ্যে একাধিক বৈঠক হয়েছে। কিন্তু জাপাকে কতটি আসন ছেড়ে দেয়া হবে; তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। এরই মধ্যে গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনানুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রীদের প্রশ্নের আলোকে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবে কি না- এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জাতীয় পার্টিকে বিশ্বাস করা যায় না। একাধিক গণমাধ্যমে মন্ত্রীদের বরাত দিয়ে এ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

সূত্র জানায়, গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ নিয়ে কয়েকজন মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তারা আওয়ামী লীগের ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থীদের বিষয়েও কথা বলেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে যেতে ব্যবস্থা নিতেও তারা প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী উল্লিখিত সন্দেহ-সংশয়ের কথা জানান।
প্রধানমন্ত্রীর সাথে রওশনের সাক্ষাৎ : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জি এম কাদের রওশনপন্থীদের বাদ দিয়েই নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছেন। যেখানে রওশন এরশাদ, তার ছেলে সাদ এরশাদও নেই। রওশনপন্থীরা এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে একাধিকবার সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও সুযোগ পাননি। তবে গত সোমবার রাতে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, তার ছেলে সাদ এরশাদ, এরশাদ, বিরোধীদলীয় নেতার মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশিদ, রওশনারা মান্নান এমপি এবং বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা হঠাৎই প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ পান। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে গণভবনে এই সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়। গণভবন থেকে বের হওয়ার সময় রওশন সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে নির্বাচন নিয়ে কথা হয়েছে। আপনি যে ভোটে অংশ নিচ্ছেন না সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কিছু বলেছেন কি না- এমন প্রশ্নে এরশাদপতœী বলেন, এখন তো আর সময় নেই, আর কী বলবেন। তিনি বলেন, জি এম কাদের আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করেননি। তিনি আমার ছেলে সাদ এরশাদের আসনে নির্বাচন করছেন।

দলের একটি অংশ আপনাকে ছাড়াই নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, এতে আপনার সমর্থন আছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তো ইচ্ছে করেই নির্বাচনে যাচ্ছি না। তাদের প্রতি আমার কেন সমর্থন থাকবে। ৭ জানুয়ারি ভোটের প্রতি সমর্থন আছে কি না জানতে চাইলে রওশন বলেন, আমি চাই ৭ জানুয়ারি ভোট হোক।

জাপাকে জোটে না নিতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ রওশনের : গতকাল গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের পর রওশন এরশাদের একটি লিখিত বক্তব্য সাংবাদিকদের সরবরাহ করেন তার অনুসারীরা। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কী আলোচনা হয়েছে, তা জানানো হয়।
লিখিত বক্তব্যে ‘খণ্ডিত জাতীয় পার্টি’ ও জি এম কাদেরের সাথে কোনো নির্বাচনী জোট না করার জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন রওশন। তিনি অভিযোগ করেন, জি এম কাদের অবৈধভাবে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব দখল করেছেন।
বিরোধীদলীয় নেতার মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, আজ প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, অবৈধভাবে জি এম কাদের জাতীয় পার্টির দায়িত্ব নিয়েছেন। জাতীয় পার্টির একটা খণ্ডিত অংশ নির্বাচনে যাচ্ছে। জি এম কাদের অবৈধভাবে ক্যু করে পার্টি দখল করেছেন। দলের শত শত নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছেন। তাদের মনোনয়নবঞ্চিত করেছেন। এ কারণে নির্বাচন বর্জন করেছেন রওশন এরশাদ। এ জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন, জাতীয় পার্টির সাথে জোট বা কোনো ধরনের সমঝোতা যেন না করা হয়। জাতীয় পার্টির সাথে সমঝোতা করতে চাইলে যেন আমাদের সাথে আগে আলোচনা করা হয়।

এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কি বলেছেন জানতে চাইলে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি বিষয়টি দেখবেন। রাঙ্গা বলেন, দলের আড়াই থেকে তিন শ’ নেতাকর্মীকে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। যোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন না দিয়ে অপমান করা হয়েছে। জাতীয় পার্টির সাথে যেন জোট না হয় সে অনুরোধ জানিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন উনি দলীয় পরিষদে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন।
অন্ধকারে জি এম কাদের : নির্বাচনী ট্রেন থেকে ছিটকে পড়েছেন জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ও তার অনুসারীরা। অসুস্থ শরীর নিয়েও গত ২৯ নভেম্বর সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেছেন রওশন। একইভাবে গতকাল গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের পরও কথা বলেছেন গণমাধ্যমের সাথে। কিন্তু রহস্যজনক নীরবতায় রয়েছেন পার্টি চেয়ারম্যান জি এম কাদের। গত ১১ নভেম্বর এক যোগদান অনুষ্ঠানে প্রকাশ্য বক্তব্য রেখেছিলেন তিনি। তার পর থেকে রহস্যজনকভাবে আর মিডিয়ার সামনে আসছেন না তিনি। গতকালও নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে ফোন দেয়া হয়। কিন্তু সাড়া দেননি জি এম কাদের।

সর্বশেষ গত ১৪ নভেম্বর আইডিইবি ভবনে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ও জেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের যৌথসভায় বক্তব্য রেখেছিলেন। তবে সেই সভায় মিডিয়ার প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। সে হিসেবে মুখবন্ধ রাখার এক মাস পূর্তি করলেন জি এম কাদের। এমনকি সাংবাদিকদের ফোনও এড়িয়ে চলছেন। কেন তার এই নীরবতা এমন প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, পার্টির মুখপাত্র হিসেবে আমি কথা বলছি। এসব কথা তার নির্দেশনা অনুযায়ী বলছি। কী বলতে হবে তার কাছ থেকে নির্দেশনা নিচ্ছি। পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, আওয়ামী লীগের সভাপতি কি সব সময় কথা বলেন?

নির্বাচন থেকে চলে যাওয়ার জন্য জাতীয় পার্টি আসেনি : চুন্নু
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর বনানীতে জাপা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে জাতীয় পার্টি মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, বিদেশীদের হস্তক্ষেপ কাম্য হতে পারে না। পশ্চিমারা চান সুষ্ঠু ভোট, আমাদের জনগণও সুষ্ঠু ভোট চায়। জাতীয় পার্টিও তাই চায়।
‘জাতীয় পার্টিকে বিশ্বাস করা যায় না, এমনকি জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারে’ বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর প্রসঙ্গে চুন্নু বলেন, এ বিষয়ে আমার কোনো কথা বলার সুযোগ নেই। আমাদের বিশ্বাস করবেন কি না, করেন কি না, সেটি উনার বিষয়। এ বিষয়ে আমাদের কোনো কমেন্টস নেই। জাপা মহাসচিব বলেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচন করার জন্য আসছে। নির্বাচন থেকে চলে যাওয়ার জন্য আসেনি। জাতীয় পার্টি ইসি ও সরকারের কাছে শুধু ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ চেয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটিই আমাদের মেইন দাবি। এটুকু হলেই নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877