স্বদেশ ডেস্ক:
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, বিদেশিদের কূটনৈতিক তৎপরতা তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানরা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছেন। এ নিয়ে তাদের বক্তব্য-বিবৃতি অনেক সময় সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলছে। কূটনীতিকদের কিছু বিবৃতি ও তৎপরতাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে সরকার।
পাশাপাশি এটাকে ভিয়েনা কনভেনশন (কূটনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক চুক্তি) অনুযায়ী কূটনৈতিক শিষ্টাচারের লঙ্ঘন মনে করছে। এ নিয়ে ইতোমধ্যে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সরকারের একাধিক মন্ত্রী। তারা বিদেশিদের ভিয়েনা কনভেনশন অনুসরণ করার তাগিদ দিয়েছেন। এর আগে গত বছরের জুলাই মাসে ঢাকায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানদের চিঠি দিয়ে কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছিল সরকার।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন আমাদের সময়কে বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কূটনীতিকরা মন্তব্য করতে পারেন না। বাংলাদেশে কিছু একটা হলেই তারা মন্তব্য করে থাকেন। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি আমাদের নির্বাচন নিয়ে টুইট করেছেন। যেটি গ্রহণযোগ্য নয়। এটা ভিয়েনা কনভেনশনবিরোধী। কূটনীতিকদের কোনো মন্তব্য করার আগে তাদের হেড অফিসের অনুমোদন নিতে হয়। আমরা আশা করব কূটনীতিকরা শিষ্টাচার মেনে চলবেন। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকবেন। কূটনৈতিক শিষ্টাচার না মানলে অবশ্যই রাষ্ট্রদূতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুশিয়ারি দেন তিনি।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, বিভিন্ন ইস্যুতে বিদেশিরা প্রায়ই মন্তব্য করে থাকেন। নির্বাচন ইস্যুতে আমাদের বড় দুই দলের মধ্যে বিভাজন স্পষ্ট। এই বিভাজনের সুযোগে বিদেশিরা অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নাক গলানোর সুযোগ পান। আমাদের সমস্যা যদি আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে পারি, তাহলে বিদেশিরা এই সুযোগ পাবে না।
গতকাল শুক্রবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশের বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর অতি আগ্রহ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে কিছু ঘটনা ঘটে, কিন্তু সে রকম ঘটনা কি তাদের দেশে ঘটে না? তিনি বলেন, বিশ্বরাজনীতিতে গভীর সংকট চলছে। রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে নানা রকম মোড় নিচ্ছে বিশ্বরাজনীতি। এখন এই অবস্থায় দেখছি বিশ্বে নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর মাথাব্যথা বাংলাদেশ।
গত ১৭ জুলাই ভোটের দিন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্রপ্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম হামলার শিকার হন। এ হামলার ঘটনার পরের দিন ১৮ জুলাই উদ্বেগ জানান বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস। এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, কোনো ধরনের সহিংসতা ছাড়াই নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার। এই অধিকারের সুরক্ষা ও নিশ্চয়তা দেওয়া উচিত। এর আগে গত সোমবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ওই হামলার নিন্দা জানিয়ে বলে, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে সহিংসতার কোনো স্থান নেই।
গোয়েন লুইসের এই টুইটের পরের দিন বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে তলব করে। পরে টুইটের বিষয়ে ঢাকার অসন্তোষের বিষয়টি জানানো হয়। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মকা- থেকে বিরত থাকারও আহ্বান জানানো হয়।
অন্যদিকে হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) ও কানাডাসহ ঢাকায় ১৩ দূতাবাস ও হাইকমিশন। গত ১৯ জুলাই প্রকাশিত এক যৌথ বিবৃতিতে নিন্দা জানানোর পাশাপাশি বলা হয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সহিংসতার কোনো স্থান নেই। এ ঘটনায় পূর্ণ তদন্ত ও দোষীদের জবাবদিহিতার দাবি জানিয়ে আসন্ন নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়। কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ দূতাবাস ও হাইকমিশন এ বিবৃতি দেয়।
তবে ঢাকায় প?শ্চিমা দেশ ও আন্তর্জাতিক মিশনগু?লোর এই বিবৃতিকে ভালোভাবে নেয়নি সরকার। এর প্রতিক্রিয়ায় ওই দিনই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেন, বাংলাদেশ বলেই তারা একটা মগের মুল্লুক পেয়েছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, একটি দেশ সম্পর্কে আমি বলতে চাই, আমেরিকার নিউইয়র্কে যখন-তখন লোক মেরে ফেলা হয়। তারা কি স্টেটমেন্ট দেয় কখনো? জাতিসংঘ কখনো বলেছে আমেরিকাতে লোক মারা যায় কেন?
এর আগে গত জুনে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয় সদস্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধানের কাছে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে অবদান রাখার অনুরোধ করেন। এর পরপরই সরকারের মন্ত্রীরা এ ঘটনা এবং চিঠির বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানান।
ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি গত বছরের ১৪ নভেম্বর ঢাকার এক অনুষ্ঠানে ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ভোটের আগের রাতে পুলিশ ব্যালট বাক্স ভরে রেখেছিল বলে তিনি ‘শুনেছেন’। তার এমন বক্তব্যে সরকার বিব্রত হয়। পরে পররাষ্ট্র সচিব জাপানি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন। এর কয়েকদিন পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন এক অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশ উপনিবেশ নয়। প্রয়োজনে বিদেশি দূতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারি দেন। এ ছাড়া পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ইতো নাওকিকে ডেকে ভিয়েনা কনভেনশন মানলে বিদেশি কূটনীতিবিদরা যে একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে মন্তব্য করতে পারেন না, জাপানি রাষ্ট্রদূতকে সেটা মনে করিয়ে দেন। এক ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের অ্যাম্বাসেডরকে ডেকেছিলাম। তাকে যা যা বলা দরকার, আমরা বলেছি।’
গত ৬ ডিসেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত ১৫টি দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশন এক বিবৃতিতে ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনীয় ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেন। এর আগে বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকদের কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও রীতিনীতি মেনে চলার বিষয়টি চিঠি দিয়ে মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত বছরের ১৮ জুলাই চিঠিটি ঢাকার সব বিদেশি দূতাবাস, জাতিসংঘ কার্যালয়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে পাঠানো হয়। চিঠিতে ১৯৬১ সালের কূটনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশন এবং ১৯৬৩ সালের কনস্যুলার রিলেশন নীতি মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে।
কী আছে ভিয়েনা কনভেনশনে : ভিয়েনা কনভেশন হলো স্বাধীন দেশগুলোর কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক একটি চুক্তি, যা ‘ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশন ১৯৬১’ নামে পরিচিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভিয়েনা কনভেনশনের যে ধারার কথা বলা হচ্ছে, সেটি হলো চুক্তির ৪১ নম্বর অনুচ্ছেদ। এই অনুচ্ছেদের এক নম্বর ধারায় বলা আছে, যেসব ব্যক্তি অন্য কোনো দেশে কূটনীতিকের মর্যাদা ও সুবিধা ভোগ করেন তারা ওই দেশের আইন ও নীতি মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন। এ ছাড়া ওই দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা তাদের দায়িত্ব। জাপানের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করার পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাকে ভিয়েনা কনভেনশনের এই ধারাটি মেনে চলার কথাই বলা হয়েছিল।
এই অনুচ্ছেদের আরও দুটি ধারা রয়েছে। এর দুই নম্বর ধারায় বলা আছে, কূটনীতিকদের সব ধরনের দাপ্তরিক কাজ যা প্রেরক দেশ কূটনীতিক মিশনের ওপর ন্যস্ত করবে তা গ্রাহক দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা এ সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে হতে হবে। অনুচ্ছেদের তিন নম্বর ধারায় বলা আছে, কূটনীতিকরা তাদের মিশন অফিসের প্রাঙ্গণ মিশনের কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারবেন না।