রবিবার, ০৫ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:০৫ অপরাহ্ন

মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবা

মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবা

শায়খ ড. সালেহ বিন আবদুল্লাহ বিন হুমাইদ: কলব মানে আত্মা-অন্তর। কোনো কিছুর খাঁটি ও সেরা অংশকে বলা হয় কলব বা আত্মা-প্রাণ। প্রাণ বা আত্মার নাম কলব রাখা হয়েছে, কারণ তা মানুষের উচ্চ ও উৎকৃষ্টতম অঙ্গ। অপর পক্ষে কলব এসেছে বদল, রূপান্তর ও পরিবর্তন থেকে। আর পরিবর্তনের একটি মর্মার্থ বিষয়ের পরিণামে দৃষ্টিপাত করা।
মুসলিম ভাইয়েরা, ভূমিকা ও দায়িত্ব বিবেচনায় আত্মা হলো আল্লাহর শ্রেষ্ঠ ও উৎকৃষ্টতর সৃষ্টি। এর ভূমিকা অনুভূতিতে প্রকাশ্য হয় না। এটি বরং রুহ, নফস, মস্তিষ্ক, হৃদয় ও জ্ঞানের মতো অদৃশ্য জগতের অংশ। এগুলো সব আল্লাহর দান, যা অনুভূতির জগৎকে উদ্ভাসিত করে। আল্লাহর অনুমতিতে তাকে দেয় সাহায্য, খোরাক ও আলো। যে আলো ও সহায়তা প্রভেদ সৃষ্টি করে সত্য ও মিথ্যার মাঝে, সৎ ও অসতের মাঝে, উপকারী ও অপকারীর মাঝে এবং বাস্তবতা ও কল্পনার মাঝে। নুমান বিন বাশির (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জেনে রেখো, নিশ্চয়ই মানবদেহে রয়েছে একটি মাংসপিন্ডÑসেটি সুস্থ থাকলে পুরো দেহ সুস্থ থাকে আর সেটি বিনষ্ট হলে পুরো দেহ নষ্ট। সেটি হলো কলব বা আত্মা।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
প্রিয় ভাইয়েরা, আত্মা সুস্থ থাকে ঈমান, বাস্তবতার পরিচয় ও অবস্থার অবগতির মাধ্যমে। আর শরীর সুস্থ থাকে আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য দ্বারা। হৃদয় যখন শিরক, কুফর এবং আত্মগর্ব, আত্মতুষ্টি, লৌকিকতা ও হিংসা প্রভৃতি হৃদয়ঘটিত অপকর্ম দিয়ে দূষিত হয়, দেহও তখন গোনাহ, অবাধ্যতা, সৃষ্টির প্রতি জুলুম ও পৃথিবীতে অনাচারের মাধ্যমে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
কলব মিলন ও গ্রহণের স্থান। এটি মানুষের অভ্যন্তর এবং বাইরের কর্ম ও আচরণের মাঝে সেতু। রাসুলুল্লাহ (সা.) বারবার এ দোয়া করতেন: ‘হে অন্তরগুলোর পরিবর্তনকারী?! আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের প্রতি অবিচল রাখ।’ সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি কি আমাদের ব্যাপারে ভয় করছেন অথচ আমরা আপনার ও আপনার আনীত দ্বীনের প্রতি ঈমান এনেছি? তিনি (সা.) বললেন, সব অন্তর আল্লাহ?র আঙুলগুলোর দুই আঙুলের মধ্যে অবস্থিত। তিনি নিজের আঙুল দিয়ে সেগুলো যেভাবে ইচ্ছা ঘুরিয়ে থাকেন।’ (বর্ণনায় আহমাদ)। নবী (সা.) কলব-অন্তর শব্দ দিয়ে এভাবে কসমও করতেন: ‘শপথ অন্তর পরিবর্তনকারীর।’ (বর্ণনায় বোখারি)।
কলব বা হৃদয় হলো সমূহ কল্যাণের আধার। কলবের সঙ্গে কল্যাণ শব্দটি যুক্ত হয়ে এসেছে আল্লাহর বাণীতেও: ‘আল্লাহ যদি তোমাদের অন্তরে কোনো রকম মঙ্গলচিন্তা রয়েছে বলে জানেন; তবে তোমাদের তার চেয়ে বহুগুণ বেশি দান করবেন, যা তোমাদের কাছ থেকে বিনিময়ে নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া তোমাদের তিনি ক্ষমা করে দেবেন। বস্তুত আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময়।’ (সূরা আনফাল: ৭০)। অতএব যে হৃদয়ে মঙ্গল রয়েছে, তা পরিমাণে যত কম হোক না কেন, সেটি ঈমানের জন্য উন্মুক্ত হবেই। আল্লাহ তায়ালার এ বাণীতে একটু লক্ষ করুন: ‘তাদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাদের শক্তিশালী করেছেন তাঁর অদৃশ্য শক্তি দ্বারা।’ (সূরা মুজাদালা: ২২)। আল্লাহ শানুহু আরও বলেন: ‘কিন্তু আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ঈমানের মহব্বত সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং তা হৃদয়গ্রাহী করে দিয়েছেন।’ (সূরা হুজুরাত: ৭)।
তেমনি মোনাফেকদের ব্যাপারে বিবৃত আল্লাহর বাণীও লক্ষ্য করুন: ‘হে রাসুল, তাদের জন্য দুঃখ করবেন না, যারা দৌড়ে গিয়ে কুফরে পতিত হয়; যারা মুখে বলে: আমরা মুসলমান, অথচ তাদের অন্তর মুসলমান নয়।’ (সূরা মায়েদা: ৪১)। অনুরূপ মরুবাসীদের ব্যাপারে আল্লাহ শানুহুর বাণী: ‘এখনও তোমাদের অন্তরে বিশ্বাস জন্মেনি।’ (সূরা হুজুরাত: ১৪)। বোঝা গেল, ঈমানই হৃদয় বা কলবের প্রাণ ও প্রাচুর্য।
মুসলিম ভাইয়েরা, কলবের রয়েছে কিছু বিশেষ আমল, যা ভাবনা-অনুভূতি ও অবস্থার রূপান্তরে প্রকাশ পায়। যথাÑভালোবাসা-আনন্দ, ভাবনা-চিন্তা, অস্থিরতা-ক্রোধ, হিংসা-বিদ্বেষ, অভিসার-চক্রান্ত, বুঝ, সজাগতা ও জ্ঞানের মতো বান্দার বিবিধ কর্মকা-। যেমনটি আল্লাহ শানুহু কিছু লোক সম্পর্কে বলেছেন: ‘তাদের অন্তর রয়েছে, তার দ্বারা বিবেচনা করে না।’ (সূরা আরাফ: ১৭৯)।
অন্তরের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্ববহ আমল নিয়ত বা সংকল্প। নিয়ত হলো হৃদয় যাতে স্থির হয় এবং যার সংকল্প করে। সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে: ‘নিশ্চয়ই কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক ব্যক্তির তাই প্রাপ্য, যার নিয়ত সে করে।’ (বর্ণনায় বোখারি ও মুসলিম)।
নিয়ত হলো ইবাদতের মজবুত ভিত। অভ্যাস থেকে ইবাদতকে আলাদা করে এ নিয়ত। ইবাদতের একটি থেকে আরেকটিকেও আলাদা করে নিয়ত। এটি বরং আদতকেও ইবাদত বানিয়ে দেয়। নিয়তের অশুদ্ধি ইবাদতকে অশুদ্ধ বানায়। আর ইখলাস হলো এ নিয়তের সততা ও আত্মার অপরিচ্ছন্নতা।
অন্তরের আরেকটি আমল অবিচলতা। এটি তৈরি করে ব্যক্তিত্ব ও স্থিরতা। বান্দাকে যখন অবিচলতা দান করা হয় এটি তাকে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা থেকে রক্ষা করে। তাকে এমন বানায় যে সে বাস্তবতা অনুধাবন করে এবং কাজ করে ভবিষ্যতের লক্ষ্যে। নবী (সা.) মুয়াজ (রা.) কে ইয়েমেনে প্রেরণকালে বলেন, ‘আল্লাহ তোমার অন্তরকে অবিচল করবেন এবং তোমার মননকে পথ দেখাবেন।’ (বর্ণনায় আহমাদ, আবু দাউদ ও তিরমিজি)।
মুসলিম ভাইয়েরা, আত্মার রয়েছে আরও কিছু মহৎ গুণ, যা ঈমানের অন্দর-বাহিরকে তুলে ধরে। এতে দীপ্ত হয় আত্মার প্রাণ ও দান এবং বান্দার অবিচলতা ও সুস্থতা। এসব বৈশিষ্ট্যের একটি সুস্থ আত্মা। যেমন আল্লাহ বলেছেন: ‘যেদিন ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি কোনো উপকারে আসবে না; কিন্তু যে সুস্থ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে।’ (সূরা শুআরা: ৮৮-৮৯)। অনুরূপ নবী (সা.) এর একটি দোয়া ছিল এমন: ‘হে আল্লাহ, আপনার কাছে চাই সুস্থ অন্তর।’ (বর্ণনায় আহমাদ, তিরমিজি ও নাসায়ি)।
সুস্থ অন্তর সেটিই, যা কপটতা, সংশয়, শিরক, মন্দ ও ভ্রষ্টতা থেকে মুক্ত। এর বাহ্যও তেমন, অভ্যন্তরও যেমন। এর ভেতরের কথাই বলে এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। সুস্থ আত্মা সমন্বয় ঘটায় মাবুদের জন্য নিষ্ঠা এবং ভক্তিসহ তার জন্য চেহারা সমর্পণের মাঝে। আল্লাহর শরিয়তের অনুসরণ করে খাঁটি ও সমর্পিত হয়ে। আল্লাহ বলেন: ‘হ্যাঁ, যে ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সমর্পণ করেছে এবং সে সৎকর্মশীলও বটে তার জন্য তার পালনকর্তার কাছে পুরস্কার বয়েছে। তাদের ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।’ (সূরা বাকারা: ১১২)।
প্রিয় ভাইয়েরা, আত্মার আরেক প্রধান গুণ আনুগত্য, যা মূলত মেনে নেওয়া এবং আল্লাহতে স্থির হওয়ার নাম। হাফেজ ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘জেনে রেখো, যখন বান্দার পা আনুগত্যের স্তরে স্থির ও অনড় হয়, তার হিম্মত হয় উচ্চ। ব্যক্তিত্ব হয় সমুচ্চ। ফলে সে কোনো প্রশংসায় ভেজে না। কোনো নিন্দায় ভেঙে পড়ে না। সে নিজেকে ছাড়িয়ে যায়। তার হৃদয় আস্বাদন করে ঈমান ও একিনের স্বাদ। বিশ্বাস ও আস্থার আস্বাদ। পড়ে দেখুন আল্লাহর বাণী: ‘আর এ জন্যও যে, যাদের জ্ঞান দেওয়া হয়েছে তারা যেন জানতে পারে যে, এটা তোমার প্রতিপালকের কাছ থেকে প্রেরিত সত্য; অতঃপর তারা যেন তাতে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর যেন তার প্রতি অনুগত হয়।’ (সূরা হজ: ৫৪)।
আত্মার আরেকটি গুণ নম্রতা ও কোমলতা। আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত বলেন: ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমানদার, তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম নেওয়া হয়, তখন ভীত হয়ে পড়ে তাদের অন্তর।’ (সূরা আনফাল: ২)। একইভাবে হাদিসে রয়েছে, ইরবাজ বিন সারিয়া (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) একদিন আমাদের এমন ওয়াজ-নসিহত করলেন যাতে হৃদয় বিগলিত হলো।’ (বর্ণনায় আবু দাউদ ও তিরমিজি)।
তাই তো প্রকৃত ঈমানদাররা সর্বদা যে নেক আমল করেন এবং পুণ্য প্রেরণ করেন, তা প্রত্যাখ্যান বা অগ্রহণযোগ্য হওয়ার ভয় ও অস্থিরতায় থাকেন। এ ভয়ের উৎস মূলত আল্লাহর বড়ত্ব, মহানত্ব, প্রতাপ ও রাজত্ব। ভীত আত্মা, যা এক পুণ্য থেকে আরেক পুণ্যে স্থানান্তরিত হয়। এমন দিনের ভয়ে, যেদিন অন্তর ও চোখগুলো স্থানান্তরিত ও ভীতকম্পিত হবে।
আল্লাহর বান্দারা, প্রশান্ত চিত্ত সম্পর্কে বিবৃত হয়েছে আল্লাহ জাল্লা শানুহুর বাণী: ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা প্রশান্তি লাভ করে; জেনে রেখো, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরগুলো প্রশান্তি পায়।’ (সূরা রাদ: ২৮)। আর প্রশান্তি হলো শান্তি, নিরাপত্তা ও আপনত্ব। আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী ও বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্বোধন করে বলেন: ‘বস্তুত এটা তো আল্লাহ তোমাদের সুসংবাদ দান করলেন, যাতে তোমাদের মনে এতে স্বস্তি ও প্রশান্তি আসতে পারে।’ (সূরা আলে ইমরান: ১২৬)।
আত্মার সবচেয়ে প্রত্যাশিত গুণ হলো দ্রবণ ও বিগলন। এরশাদ হয়েছে: ‘যারা মোমিন, তাদের জন্য কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে, তার কারণে হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি?’ (সূরা হাদিদ: ১৬)। তেমনি নবী (সা.) এমন হৃদয় থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চেয়েছেন, যা ভীত-বিগলিত নয়। (জায়েদ বিন আরকাম (রা.) কর্তৃক বর্ণনায় সহিহ মুসলিম)।
আল্লাহর বান্দারা, আত্মা তখনই সুস্থ হয়, যখন তা আল্লাহকে চেনে, তাঁর আনুগত্য করে, তাঁকে ভয় করে, তাঁর সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করে এবং খাদ্য, পানীয় ও পোশাক শুদ্ধ হয়। বস্তুত যার কাছে তার দ্বীনের বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, যে অলসতার নিদ্রা থেকে সজাগ এবং আখেরাতে মুক্তির প্রত্যাশী, সে প্রচ-ভাবে নিজের আত্মাকে সুস্থ রাখতে সচেষ্ট থাকে। বেঁচে থাকে নফসের পতন ও ধ্বংসের পথ-পন্থা থেকে। হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘জেনে রেখো, তুমি সত্যিকারার্থে আল্লাহকে ভালোই বাসলে না, যতক্ষণ না তাঁর আনুগত্যকে ভালোবাস।’
ভাইয়েরা, আত্মা সপ্রাণ-সজীব হয় সাধনা, সৎ পুণ্যাত্মাদের সঙ্গ অবলম্বন এবং আল্লাহর সঙ্গে সত্যিকার সম্পর্কের মাধ্যমে। অন্তরে যখন ভালোবাসা বাড়ে, তার ইবাদতও বৃদ্ধি পায়। যখন ইবাদত বৃদ্ধি পায়, ভালোবাসা আরও বাড়ে। তারপর সমূহ পথ ও দ্বার দিয়ে নেক আমল সম্পাদন হতে থাকে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877