স্বদেশ ডেস্ক: ভারতের আসাম রাজ্যের জাতীয় নাগরিকপঞ্জিতে (এনআরসি) ঠাঁই মেলেনি ১৯ লাখ ৭ হাজার বাসিন্দার। গতকাল শনিবার সকালে বহুল আলোচিত এই নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়। মূলত কয়েক দশকের বাঙালিবিরোধিতা থেকেই এ নাগরিকপঞ্জি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফলে বাদ পড়াদের বেশিরভাগই বাঙালি মুসলমান ও হিন্দু বলে ধারণা করা হচ্ছে। তালিকায় নাম ওঠাতে ব্যর্থ মানুষগুলো এখনই ভারতীয় নাগরিকত্ব না হারালেও অদূর ভবিষ্যতে তাদের অনেকেরই দেশহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভারত প্রক্রিয়াটিকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় বললেও বাদ পড়ারা কোথায় যাবেন তা স্পষ্ট করেনি। তাদের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশেই পাঠানো হয় কিনা এ নিয়ে উৎকণ্ঠা রয়েছে বাংলাদেশিদের মধ্যেও। এনআরসি প্রকাশের পরই আসাম লাগোয়া সিলেটের সীমান্তে টহল জোরদার করেছে বিজিবি।
এই তালিকা প্রকাশকে কেন্দ্র করে কয়েকদিন ধরেই ব্যাপক উৎকণ্ঠা রয়েছে আসামে। যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে বাড়তি নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করে। রাজধানী গুয়াহাটিসহ কিছু এলাকায় ১৪৪ ধারাও জারি করা হয়। তবে বিপুলসংখ্যক মানুষ বাদ গেলেও সন্তুষ্ট নয় রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি। দলটির রাজ্য সভাপতি রণজিত কুমার দাস আগের তালিকাগুলোর তুলনায় এবার কমসংখ্যক বাদ পড়ায় অসন্তোষ জানিয়েছেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে রাজ্য অর্থমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন, এনআরসি নিয়ে বিজেপি সন্তুষ্ট নয়। তিনি দাবি করেছেন, আরও বেশি অবৈধ অভিবাসীর তালিকা থেকে বাদ পড়ার কথা। রাজ্য থেকে সব বিদেশিকে তাড়িয়ে দিতে তাদের দল কাজ করে যাবে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর নাগরিক তালিকা পুনরায় যাচাইয়ের বিজেপি ও রাজ্য সরকার সুপ্রিমকোর্টে যাবে বলে জানান তিনি।
ভারতীয় দৈনিক এনডিটিভি জানিয়েছে অবৈধ অভিবাসী ঘোষিত হওয়া লোকজনকে বিতাড়ন করা না হলেও তারা নিজেদের সম্পত্তির দখল পাবে কিনা বা একজন নাগরিক যেসব সুবিধা পান সেগুলো পাবেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। হতে পারে বন্দিশিবির থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তাদের মৌলিক কিছু সুযোগ-সুবিধাসহ কাজ করার অনুমতি দেওয়া হবে। কিন্তু তারা আর ভোট দিতে পারবেন না।
এনআরসির রাজ্য সমন্বয়ক প্রতীক হাজেলা বলেছেন, যাদের নাম তালিকায় উঠেনি তারা ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে ১২০ দিনের মধ্যে আপিল করতে পারবেন। যেতে পারবেন সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত। রাজ্য সরকার বলছে, চূড়ান্ত আইনি প্রক্রিয়া শেষের আগ পর্যন্ত কাউকে বিদেশি বলে চিহ্নিত করা হবে না বা আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। রাজ্যে ইতোমধ্যেই ১০০টি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয়েছে। শিগগিরই আরও ২০০টি স্থাপন করা হবে। এসব ট্রাইব্যুনাল আপিলগুলো ৬ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করবেন। ট্রাইব্যুনালে নাগরিকত্ব ফিরে পেতে ব্যর্থ হলে হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টে যাওয়ার সুযোগ থাকবে। আসাম সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এনআরসির চূড়ান্ত তালিকায় যেসব দরিদ্র মানুষের নাম বাদ পড়বে, তাদের বিনা খরচে আইনি সহায়তা দেওয়ার সবরকম ব্যবস্থা করবে।
গতকাল প্রকাশিত তালিকায় দেখা যায়, আসামের বিরোধীদলীয় আইনপ্রণেতা অনন্ত কুমার মালোর নামও বাদ পড়েছে। বাদ পড়েছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ সানাউল্লাহ। কয়েক মাস আগে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে তাকে গ্রেপ্তারও করেছিল রাজ্য পুলিশ। এবারও অনেক পরিবারের একজন-দুজন সদস্যের নাম বাদ পড়েছে।
ভারতের দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, এনআরসিতে নাম ওঠাতে আবেদন করেছিলেন রাজ্যের তিন কোটি ৩০ লাখ ২৭ হাজার ৬৬১ জন। তালিকায় নাম উঠেছে তিন কোটি ১১ লাখ ২১ হাজার ৪ জনের। বাদ পড়েছেন ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন। গতবছর প্রকাশিত খসড়া এনআরসি তালিকায় প্রায় ৪১ লাখের নাম বাদ পড়েছিল। তাদের প্রায় ৪ লাখ তালিকায় নাম তোলার জন্য পুনর্বিবেচনার আবেদন করেননি। এবার বাদ পড়া ১৯ লাখের মধ্যে ওই ৪ লাখও রয়েছেন। সকালে তালিকাটি প্রকাশের পরপরই নাগরিকরা ভিড় জমান এনআরসি সেবাকেন্দ্রসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে। এনআরসির ওয়েবসাইটেও তালিকাটি প্রকাশ করা হয়।
আসামের এই এনআরসি একইসঙ্গে বহুল প্রত্যাশিত ও বিতর্কিত। এর আগে এর খসড়া তালিকা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক দেখা দেয়। গত বছরের জুলাইয়ে প্রকাশিত খসড়ায় বাদ পড়েছিলেন ৪১ লাখ। রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার এই তালিকার মাধ্যমে আসামে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের চিহ্নিত করে রাজ্যছাড়া করতে চায়। কয়েক দশক ধরেই রাজ্যটিতে ‘বাঙালি খেদাও’ নামে একটি আন্দোলন সক্রিয় রয়েছে। আন্দোলনকারীদের ধারণা, রাজ্যের বাঙালিরা পাশের বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসামে গিয়ে থিতু হয়েছেন। তাদের স্বদেশে ফেরানোই এই আন্দোলনের লক্ষ্য। ১৯৫১ সালে এনআরসির প্রথম তালিকাটি হয়েছিল। আসামে এবং ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশে ২০১৩ সালে এনআরসি হালনাগাদের কাজ শুরু হয়। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি দলীয় শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সময় জোর দিয়েই ‘অবৈধ মুসলমান অভিবাসীদের’ বাংলাদেশে বিতাড়নের কথা বলেছেন। তবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তার সাম্প্রতিক ঢাকা সফরে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘এটা একান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’ ২০১৭ সালে ও এর আগে কয়েক দফায় আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমারও তাদের রাখাইন রাজ্য থেকে বাঙালি আখ্যা দিয়ে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের জন্য এনআরসি নতুন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
ভারতের আরেক দৈনিক দ্য হিন্দু বলছে, পাঁচ বছর ধরে চলা এ প্রক্রিয়ায় ব্যয় হয়েছে এক হাজার ২২০ কোটি রুপি। গোটা প্রক্রিয়া ভারতের সুপ্রিমকোর্ট তত্ত্বাবধান করেছেন। আসামের মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, নিজেদের নাগরিক প্রমাণে কর্তৃপক্ষের শুনানিতে দৌড়ঝাঁপে রাজ্যের মানুষের ব্যয় হয়েছে অন্তত ৭ হাজার ৮০০ কোটি রুপি। বিভিন্ন সময় সংঘাতে প্রাণ গেছে ৬ জনের।
শেষ পর্যন্ত বাদ যাবে ৬-৭ লাখ : হিমন্ত শর্মা
তালিকা প্রকাশের পর আসামের অর্থমন্ত্রী হিমন্ত শর্মা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, আসামের জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি এনআরসি। কারণ পুরো প্রক্রিয়ায় মাত্র ১৯ লাখ মানুষ বাদ পড়েছে। যাদের মধ্যে ৩ লাখ ৮০ হাজার আপিল করার প্রয়োজন বোধ করেনি এবং মারা গেছে। ফলে সত্যিকার অর্থে বাদ পড়েছে ১৫ লাখ। এদের মধ্যে ৫-৬ লাখ মানুষ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে আসামে এসেছে। তিনি আরও বলেন, এনআরসি ১৯৭১ সালের শরণার্থী সনদপত্র আমলে নেয়নি। কিন্তু ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আপিলে তা আমলে নেওয়া হবে। ফলে তালিকা থেকে বাদ পড়াদের সংখ্যা দাঁড়াবে ১১ লাখ। এদের মধ্যে যাদের বাবা-মা তালিকায় স্থান পেয়েছেন তারাও অন্তর্ভুক্ত হবে। পুরো প্রক্রিয়া যখন শেষ হবে তখন বাদ পড়াদের সংখ্যা ৬-৭ লাখে দাঁড়াবে। যা খুব কম।
দিল্লিতেও নাগরিকপঞ্জি করার ঘোষণা
ভারতের রাজধানী দিল্লির অবস্থাকে ‘ভয়াবহ’ আখ্যায়িত করেছেন দিল্লি বিজেপির প্রধান ও এমপি মনোজ তিওয়ারি। তিনি বলেছেন, অবৈধ অভিবাসীতে ভরে গেছে দিল্লি। তাই এখানেও এনআরসি বাস্তবায়ন করা হবে। গতকাল তিনি ওই ঘোষণা দেন।
সিলেট সীমান্তে নজরদারি বৃদ্ধি
সিলেট ব্যুরো জানায়, এনআরসি প্রকাশের পর সিলেটের কয়েকটি সীমান্তে নজরদারি বাড়িয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি)। এ ছাড়া সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশও। নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়া ভারতীয়রা যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে তাই নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানা গেছে। সিলেটের গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ ও কানাইঘাট উপজেলার অবস্থান ভারতের সীমান্ত এলাকায়। এর মধ্যে জকিগঞ্জের সঙ্গে আসামের সংযোগ রয়েছে। ফলে জকিগঞ্জ সীমান্তে নজরদারি সবচেয়ে বেশি বাড়িয়েছে বিজিবি।
বাহিনীর ১৯ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল সাঈদ হোসেন বলেন, আসাম ইস্যুতে আমাদের সীমান্তে ওই রকমভাবে নিরাপত্তা জোরদার করার কোনো নির্দেশনা আসেনি। তবে স্বাভাবিকভাবেই সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
বিজিবি সিলেট সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল এএম খায়রুল জানান, জেলার সব সীমান্তবর্তী থানা এলাকাগুলোতে বিজিবি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। এ ছাড়া সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে বসবাসকারীদের বিজিবির পক্ষ থেকে সতর্কতামূলক বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট থানার ওসি আবদুল আহাদ ও জকিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মো. আবু নাসের জানান, আসামের বিষয় নিয়ে এখনো কোনো বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তবে সীমান্ত এলাকায় সবসময়ই পুলিশের সতর্কতা থাকে।
এ বিষয়ে সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মো. কামরুল আহসান বলেন, আসাম ইস্যু ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটি নিয়ে আমাদের বলার বা করার কিছু নেই। তবে ভারত ও বাংলাদেশ দুই সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গাদের পাচার, মাদক পাচার, চোরাচালান ঠেকাতে সবসময়ই আমাদের সতর্ক থাকতে হয়। আসামের বিষয়টা আমাদের নজরে রয়েছে। সেই অনুযায়ী আমাদের প্রাথমিক প্রস্তুতিও রয়েছে।
সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় এ বিষয়ে সিলেটের প্রশাসন সতর্ক রয়েছে।