মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৫১ অপরাহ্ন

ডেঙ্গু ভাইরাসের পরিবর্তন নিয়ে দেশে গবেষণা শুরু

ডেঙ্গু ভাইরাসের পরিবর্তন নিয়ে দেশে গবেষণা শুরু

স্বদেশ ডেস্ক:

রাজধানীসহ দেশের ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় প্রতিদিনই ভর্তি হচ্ছে হাজার হাজার ডেঙ্গু রোগী। গত ২৪ ঘণ্টায়ও ভর্তি হয় এক হাজার ৬১৫ জন। এ বছর ৯৯ শতাংশ রোগীই সেরোটাইপ-৩ দিয়ে আক্রান্ত হয়, যা অতীতে কখনো ঘটেনি।

রোগতত্ত্ব ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, চলতি বছর ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণে দেখা গেছে বেশ কিছু পরিবর্তন। এ কারণে অনেক রোগীর জটিলতা তৈরি হয়েছে। অনেকের জ্বর হওয়ার ২-৩ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু হেমরেজিক ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের দিকে চলে গেছেন। তাই জ্বর হলেই রোগীদের চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলা হয়েছে।

জানা গেছে, ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশা ও ডেঙ্গুর ক্লিনিক্যাল কন্ডিশন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানার্জনে গবেষণা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। এ ছাড়া চলতি বছর ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণে যেসব পরিবর্তন দেখা গেছে এবং ভাইরাসে কোনো পরিবর্তন এসেছে কিনা, তা নিয়েও গবেষণা শুরু করেছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইডিসিআর)।

বিএসএমএমইউর উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার আমাদের সময়কে বলেন, ‘বাংলাদেশে সম্প্রতি যে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব, এত বিশালসংখ্যক রোগী একসঙ্গে পাওয়া কঠিন। আমরা সেটি বিবেচনায় রেখে এর ভাইরাস ও তার বাহক এডিস মশা এবং ক্লিনিক্যাল কন্ডিশন অর্থাৎ রোগের প্যাটার্ন, রোগ নির্ণয়ের সেরোলজিক্যাল ফাইন্ডিংস, জেনোমিক আইডেন্টিফিকেশন, সম্ভাব্য চিকিৎসা ও ওষুধসহ অন্যান্য সাপোর্টিং চিকিৎসাসংক্রান্ত যে বিষয়গুলো আছে, সেগুলো সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান লাভের জন্য একটি গবেষণা কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। সেখানে আমাদের ল্যাবরেটরি ফাইন্ডিংস, ক্লিনিক্যাল কন্ডিশন ও এপিডেমিওলেক্যাল অর্থাৎ রোগের কারণ তার পারিপার্শ্বিক অবস্থায় কী কী ফ্যাক্টর কাজ করে এবং সেগুলো বাংলাদেশে চিকিৎসার জন্য, প্রিভেনশনের জন্য, রোগ হলে কী চিকিৎসা দেওয়া যায়; ভবিষ্যতের জন্য কী ব্যবস্থা নিলে ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে পারি, এ রকম গবেষণালব্ধ জ্ঞান অর্জন করতে পারব। গবেষণা থেকে কিছু তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে আসবে। এ কথা মনে রেখে আমাদের মেডিসিন, ভাইরোলজি, চর্মরোগ, পাবলিক হেলথ, শিশু বিভাগ এবং গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজিসহ অন্যান্য সহযোগী বিভাগের শিক্ষক ও চিকিৎসকদের নিয়ে আমরা কমপ্রিহেন্সিভ গবেষণা কাজ হাতে নিয়েছি। আশা করি কিছু দিনের মধ্যে গবেষণার ফল জনসম্মুখে প্রকাশ করতে সক্ষম হব।’

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরাজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগের সিনড্রোম নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। এখনো পর্যন্ত আমরা দেখেছি যেসব সিনড্রোম পরিবর্তন হয়েছে, সেগুলো শুধু হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু, হেমরেজিক ও শক সিনড্রোমÑ এ তিন ধরনের ডেঙ্গু রয়েছে। ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো ঠিকই আছে, হয়তো জ্বরের মাত্রা অনেকের কম হচ্ছে। যাদের দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু হচ্ছে তাদের স্বল্প সময়ে জটিলতা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। ভাইরাস নিয়ে আমরা কাজ করছি। সেরোটাইপিং সম্পন্ন করেছি। ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সেরোটাইপ-৩ দেখা যেত না। ২০১৭ সাল থেকে সেরোটাইপ-৩ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০১৮ সালে আরেকটু বেড়েছিল। এবার অর্থাৎ ২০১৯ সালে এসে ৯৯ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই সেরোটাইপ-৩ দেখা যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভাইরাসের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা, তা নিয়ে গবেষণা চলছে। এটির ফল এখানো পাওয়া যায়নি। ফল পাওয়ার পরই তা প্রকাশ করা হবে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা জানান, দেশের হাসপাতালগুলোতে নতুন ভর্তি হওয়ায় রোগীর তুলনায় চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় (রবিবার সকাল ৮টা থেকে সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) হাসপাতালগুলোতে নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে এক হাজার ৬১৫ জন। এর মধ্যে রাজধানীর ৭৫৭ জন এবং রাজধানীর বাইরে ৮৫৮ জন রয়েছে। এ ছাড়া হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে দুই হাজার ৫০ জন। আগের তুলনায় সারাদেশের হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৬ শতাংশ কমেছে। গতকাল সকাল পর্যন্ত ৮৮ শতাংশ রোগী চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঢাকার ১১টি সরকারি ও ৩০টি বেসরকারি হাসপাতালসহ মোট ৪১ প্রতিষ্ঠান থেকে ডেঙ্গু রোগীর তথ্য সংগ্রহ করে। এসব হাসপাতালের বাইরে সারাদেশের ৬৪ জেলা সিভিল সার্জনদের অফিস থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ৫৪ হাজার ৭৯৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৩৮, ফেব্রুয়ারিতে ১৮, মার্চে ১৭, এপ্রিলে ৫৮, মে মাসে ১৯৩ জন, জুন মাসে ১ হাজার ৮৮৪ জন, জুলাই মাসে ১৬ হাজার ২৫৩ জন ও আগস্টে ৩৬ হাজার ৩৩৬ জন। এসব রোগীর ৪৮ হাজার ২৪ জন চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন এবং বাকি ৬ হাজার ৭৩৩ জন এখনো চিকিৎসাধীন। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত ৪০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এর মধ্যে এপ্রিলে দুজন, জুনে চারজন, জুলাইয়ে ২৪ জন এবং আগস্টে ১০ জন। তবে হাসপাতালগুলোর মৃত্যুর তথ্যমতে এ সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি, যা প্রকাশ করছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

কন্ট্রোলরুমের তথ্যানুযায়ী, রাজধানীর বাইরে আটটি বিভাগের ৬৪ জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ৮৫৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর ঢাকা বিভাগে ২১৯ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৫২ জন, খুলনা বিভাগে ১৪৫ জন, রংপুর বিভাগে ৩১ জন, রাজশাহী বিভাগে ৯৫ জন, বরিশাল বিভাগে ১৫৫ জন, সিলেট বিভাগে ১৫ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৬ জন। রাজধানীর বাইরের জেলাগুলোতে এ পর্যন্ত ২১ হাজার ২৭৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে চিকিৎসা শেষে ১৭ হাজার ৯৫৮ জন বাড়ি ফিরেছে এবং বর্তমানে ৩ হাজার ৩১৪ জন চিকিৎসাধীন।
পাঁচ জেলায় আরও ৬ জনের মৃত্যু

মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপতালে আরও ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। রবিবার রাত থেকে সোমবার বিকাল পর্যন্ত ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল এবং খুলনা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাদের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
ফরিদপুর : ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দেলোয়ার হোসেন (৪৫) নামে এক ব্যক্তি মারা গেছেন। গতকাল বেলা সাড়ে ১০টার দিকে তার মৃত্যু হয়। সদর উপজেলার নর্থচ্যানেল ইউনিয়নের গোলডাঙ্গী গ্রামে তার বাড়ি। তিনি ফরিদপুর শহরের পূর্বখাবাসপুরস্থ লঞ্চঘাট জামে মসজিদের খাদেম ছিলেন।

খুলনা : খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মিজানুর রহমান (৪০) নামে এক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকাল ৭টার দিকে তার মৃত্যু হয়। সবজি বিক্রেতা মিজানুর রহমানের বাড়ি রূপসা উপজেলার খাজাডাঙ্গা গ্রামে। খুমেক হাসপাতালের আবাসিক ফিজিসিয়ান (আরপি) ডা. শৈলেন্দ্রনাথ বিশ্বাস জানান, ১৫ আগস্ট মিজানুর রহমান ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছিলেন। এ নিয়ে খুলনায় ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মোট পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।

ময়মনসিংহ : ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক লক্ষ্মী নারায়ণ মজুমদার জানান, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আনোয়ার গতকাল ভোরে মারা যান। তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া। একই জেলার দুর্গাপুরের আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে সেলিম হোসেন (২৭) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

বরিশাল : বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতালে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে সুমাইয়া আক্তার (১৮) নামে এক কলেজছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দুপুর ২টার দিকে হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন তার মৃত্যু হয়। সুমাইয়া পটুয়াখালীর দুমকি জনতা কলেজের অধ্যাপক ফজলুল হকের মেয়ে এবং ওই কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন।

হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. বাকির হোসেন জানান, সুমাইয়া আক্তার নিজ বাড়িতে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হন। পরে গত ১৬ আগস্ট তাকে শেবাচিম হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করা হয়। এ ছাড়া ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকার ডেঙ্গু রোগী ফাতেমা আক্তারের (২১)।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877