এবারের ঈদুল আজহা কেমন কেটেছে? এক কথায় এর জবাব দিতে গেলে বলতে হয়, হরিষে-বিষাদে কেটেছে। ঈদ উৎসবে যতটা অবিমিশ্র আনন্দ আমরা আশা করি, এবারের ঈদ এর ধারেকাছেও ছিল না।
তবে আনন্দের ভাগ বেশি ছিল, নাকি বিষাদের ভাগ বেশি ছিল, তা পরিমাপ করে বলা সম্ভব নয়। মন দিয়ে যা অনুভব করা যায় তার সংখ্যাবাচক বা পরিমাণবাচক কোনো রকমের হিসাব করা যায় না। বড়জোর বলা যায়, এবারের ঈদুল আজহা গতবারের ঈদুল আজহার চেয়ে বেশি আনন্দদায়ক ছিল কিংবা কম আনন্দদায়ক ছিল।
আনন্দ-দুঃখকে এভাবে গণিত শাস্ত্রবিদরা দেখতে শিখিয়েছেন তাদের Transitivity concept-এর মাধ্যমে। যুক্তিটা অনেকটা এ রকম : ক খ অপেক্ষা ভালো, খ গ অপেক্ষা ভালো। সুতরাং ক নিঃসন্দেহে খ ও গ-এর তুলনায় ভালো। যা হোক, ঈদের আনন্দ নিয়ে গণিত শাস্ত্রের বুজরুকি দেখানোর কোনো ইচ্ছা আমার নেই। তবে বিচার-বিশ্লেষণ করে বলা যায়, এবারের ঈদুল আজহা নানা দিক থেকে বিড়ম্বনাময় হয়ে উঠেছিল। প্রশ্ন হল, কীভাবে?
ঈদের বেশ আগে থেকেই ঢাকায় ব্যাপকভাবে ডেঙ্গুজ্বর ছড়িয়ে পড়েছিল। গত কয়েক বছর থেকে দেখছি, বর্ষা মৌসুম এলেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটে। বরাবরই চিকিৎসকরা বলে আসছেন, ডেঙ্গু কোনো ভয়াবহ রোগ নয়। সাধারণ প্যারাসিটামলের চিকিৎসায় ডেঙ্গু সেরে যায়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে রক্তক্ষরণের মতো লক্ষণ দেখা দিলে যত্নের সঙ্গে চিকিৎসা করতে হবে। এ বছর ডেঙ্গু এসেছে ভয়াল রূপ নিয়ে। ডেঙ্গু হয়েছে জানলে যে কেউ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। একটু জ্বর দেখা দিলেই সবাই ছুটে যান রক্ত পরীক্ষা করার জন্য।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, হাসপাতাল ও রোগ নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিল। এবারের ডেঙ্গু অতীতের যে কোনো বছরের ডেঙ্গুর তুলনায় ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বিশেষ করে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হলে রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। ঢাকাসহ সারা দেশে অনেক মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। মৃত্যু থেকে রেহাই পাননি নার্স ও ডাক্তাররাও।
ঈদ যখন এলো তখন আশঙ্কা করা হয়েছিল ঢাকা থেকে গ্রামাঞ্চলেও ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়তে পারে। সরকার স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির নামে যতই প্রচার-প্রচারণা চালাক না কেন, বাস্তব সত্য হল এখনও বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে, এমনকি উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে জটিল রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না। এবারের ডেঙ্গু নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা অনেকটা এ রকমই।
ঈদ শেষে মানুষ গ্রাম থেকে কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছে। এখনও বোঝার সময় হয়নি শহর থেকে যাওয়া মানুষ গ্রামে ডেঙ্গু ছড়ানোর জন্য কতটা দায়ী। কারণ এডিস মশা ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী মানুষকে দংশন করার পর অন্য মানুষকে যখন দংশন করে, তখন রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে ৮-১০ দিন সময় লাগে। এজন্যই বলছি, ঈদের সময় লাখ লাখ মানুষের শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার ফলে ডেঙ্গু কতটা ছড়িয়ে পড়ল সে সম্পর্কে মন্তব্য করার সময় এখনও হয়নি। তবে এ মাসের চতুর্থ সপ্তাহের দিকে আমরা বুঝতে পারব বিপদটা কত ভয়াবহ।
কথায় কথায় বলা হয়, রোগ নিরাময়ের চেয়ে রোগ প্রতিরোধই উত্তম। এবার গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে অনেক আগেই সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে সাবধান করা হয়েছিল। কিন্তু সময়মতো কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। এমনকি এডিস মশা নিধনের জন্য যে ওষুধ আমদানি করা হয়েছিল সেটাও অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। তারপর শুরু হল নানা কথার মারপ্যাঁচ। ওষুধ আনতে কত সময় লাগতে পারে ইত্যাদি হয়ে দাঁড়াল দায়িত্বশীলদের উক্তির বিষয়বস্তু। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে প্রবাস থেকে ওষুধ আমদানির ব্যাপারে নির্দেশ দিতে হল।
শুধু ডেঙ্গু মশা নিধনের ওষুধের ব্যাপারেই নয়, কিছু একটা হলেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকেন মন্ত্রী বাহাদুর ও আমলা প্রশাসকরা। এ কেমন কথা! দেশে কি সিস্টেম বলে কিছু নেই? সিস্টেম কাজ করলে বা প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর থাকলে প্রশাসন এক ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকত না। জানি না, কবে এ দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকরভাবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো মজবুত ভিতের ওপর দাঁড়াবে। দেশ থেকে জবাবদিহিতা ক্রমেই বিদায় নিচ্ছে- এসব তারই লক্ষণ। গণতন্ত্রের ঘাটতিও এসবের অন্যতম কারণ।
ঈদুল আজহার একটি বড় অনুষঙ্গ হল কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রয়। কোরবানি দেয়া পশুর চামড়া বিক্রয় থেকে যে অর্থ পাওয়া যায় তার পুরোটাই গরিবের হক। ইসলাম ধর্মে দরিদ্র মানুষের স্বার্থে অনেক অনুশাসন আছে। এর মধ্যে ফিতরা, জাকাত, পশুর চামড়া বিক্রির অর্থ বিতরণ এবং দান-খয়রাত ও সদকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে সঠিকভাবে জাকাত দেয়া হলে সমাজে আয় বৈষম্য অনেকটাই হ্রাস পেত। কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে এবার অত্যন্ত জঘন্যরূপে কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে।
ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে শুনলাম, গরুর চামড়ার দাম ২০০ টাকার বেশি ওঠেনি এবং ছাগলের চামড়ার দাম ১০-১২ টাকার বেশি হয়নি। যারা কোরবানি দেন তাদের অনেকে পশুর চামড়া এতিমখানায় ও মাদ্রাসাগুলোতে দান করেন। এর ফলে মাদ্রাসাগুলো চলছে এবং এগুলোর গরিব ও এতিম ছাত্ররা খাবারদাবার হিসেবে সাহায্য পাচ্ছে। যেসব মাদ্রাসা ও এতিমখানায় চামড়া দেয়া হয়েছিল সেগুলোর কোনো কোনোটি চামড়ার ন্যায্য দাম না পেয়ে তা মাটির নিচে পুঁতে ফেলেছে। কারণ, কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করতে হলে যে পরিমাণ লবণ ব্যবহার করতে হয় তার খরচও চামড়া বিক্রি থেকে উঠে আসছে না।
কোরবানির চামড়া বাজারের কেলেঙ্কারি নিয়ে নানা রকম তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রয়েছে। এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যে ব্যাংক থেকে ট্যানারি মালিকদের ঋণ না পাওয়া, ট্যানারি মালিকদের কাছে পাওনা বকেয়া থাকার ফলে আড়তদারদের পক্ষে চামড়া কিনতে অক্ষমতা এবং চামড়া ব্যবসাকে ঘিরে সিন্ডিকেটের তৎপরতা ইত্যাদিকেই এবারের চামড়া বাজারের বেহাল অবস্থার জন্য দায়ী করা হয়।
তবে কারা কীভাবে কারসাজি করেছে, লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে ঘুঁটির চাল দিয়েছে সেসব বিষয় উদ্ঘাটন করতে গেলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রয়োজন হবে। আশা করি সাংবাদিক ভাইয়েরা প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও খুঁজে বের করবেন কোথায় কারা কী ধরনের নষ্টামি ও ভ্রষ্টাচারের আশ্রয় নিয়েছে। যারা এই ভ্রষ্টাচারের সঙ্গে যুক্ত তারা যে পাপ করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। কারণ এই পাপাচার গরিব মানুষের হক কেড়ে নেয়ার সঙ্গে তুলনীয়। ইসলামে দুই ধরনের দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হল যথাক্রমে হক্কুল্লা ও হক্কুল এবাদ। অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি কর্তব্য এবং মানুষের প্রতি কর্তব্য। ধর্মীয় বিধান বলে, আল্লাহ ক্ষমাশীল বলে তিনি তার প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলাকেও চাইলে ক্ষমা করতে পারেন।
কিন্তু যারা মানুষের হক কেড়ে নেয় তাদের আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। এক্ষেত্রে ক্ষমা করার অধিকার একমাত্র মজলুম মানুষটিরই আছে, যে অধিকার আল্লাহ করায়ত্ত করতে চান না। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী হক্কুল্লা ও হক্কুল এবাদের কথা বলে মানুষকে মানুষের প্রতি কর্তব্য পালনে উৎসাহিত করতেন।
এজন্য তাকে কেউ কেউ ধর্মান্ধ বলার প্রয়াস পেয়েছে। অথচ তিনি ধর্মীয় বিধি-বিধানের কথা বলে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং গরিবের হক কেড়ে নেয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছেন। বাংলাদেশে লুটেরা ধনিকরা এতই আগ্রাসী হয়ে উঠেছে যে, পবিত্র ঈদুল আজহার পশু কোরবানির চামড়া নিয়ে দুরাচারে লিপ্ত হতে কুণ্ঠাবোধ করে না। জানি না, শেষ বিচারের দিনে তারা আল্লাহর দরবারে কীভাবে হাজির হবেন? কোরবানির পশুর চামড়া ব্যবসার সঙ্গে একশ্রেণির মৌসুমি ব্যবসায়ীও জড়িত হয়ে পড়ে। এদের অনেকেই যুবক বয়সের। এরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে চামড়া কেনার চেষ্টা করে এবং বেশকিছু চামড়া সংগ্রহ হওয়ার পর এগুলো পাইকারি ব্যবসায়ী অথবা ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রয় করে। এতে তাদের কিছু আয়-রোজগার হয়। এভাবে ঈদুল আজহার সময় বেকার যুবকরা কিছু অর্থ রোজগারের সুযোগ পায়। এবার তাদের দেখা যায়নি। বোধহয় তারা বুঝতে পেরেছিল বাজারের হালচাল। এরাও শেষ পর্যন্ত বঞ্চিত হল।
কোরবানির চামড়া নিয়ে যে নয়-ছয় করা হল তার কিছুটা প্রতিকারের লক্ষ্যে সরকার কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এখনও বাজারে এই সিদ্ধান্তের সুফল পরিলক্ষিত হচ্ছে না। রফতানির ফলে চামড়ার দাম কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও এর সুফল গরিব মানুষ কতটা পাবে? শেষ পর্যন্ত গরিবদের হক নিয়ে সংশয় কিন্তু থেকেই গেল। আরও পরিতাপের বিষয় হল, এবারের ঈদযাত্রাতেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং যাত্রীদের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। মন্ত্রী সাহেবদের কথা অনুযায়ী ঈদযাত্রা কতটুকু স্বস্তিদায়ক হয়েছে?
পুনশ্চ : ঈদের দিনে ইন্তেকাল করলেন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী এবং সাবেক আমলা ড. মীজানুর রহমান শেলী। তিনি কিডনি রোগে ভুগছিলেন। ছাত্রজীবনে তার মেধার কাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় কিংবদন্তির মতো শোনা যেত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের ওপর তার ছিল ঈর্ষণীয় দখল। তিনি খুব চমৎকারভাবে রস-রসিকতা ও যুক্তি সহকারে কথা বলতেন। তিনি গবেষকও ছিলেন।
এক অর্থে বলা যায়, একটু আগেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আল্লাহ তার রুহের মাগফিরাত দান করুন। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন। ঈদের সময় পত্রপত্রিকা বন্ধ থাকায় এবং সাংবাদিকরা ছুটিতে থাকায় তার মৃত্যুর সংবাদ কাঙ্ক্ষিতভাবে প্রচার লাভ করেনি। এমনকি অনেকে তার জানাজায় শরিক হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেও ঠিকমতো খবর না পাওয়ার ফলে জানাজাতেও শরিক হতে পারেননি। ঈদের আনন্দের মধ্যে ড. মীজানুর রহমান শেলীর মৃত্যু ছিল খুবই বেদনাদায়ক। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ঈদের দিনটিতেই।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ