রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৪:১৯ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
স্বেচ্ছাসেবক লীগের র‌্যালি থেকে ফেরার পথে ছুরিকাঘাতে কিশোর নিহত দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চরম তাপপ্রবাহ আসন্ন বিপদের ইঙ্গিত দ্বিতীয় ধাপে কোটিপতি প্রার্থী বেড়েছে ৩ গুণ, ঋণগ্রস্ত এক-চতুর্থাংশ: টিআইবি সাড়ে ৪ কোটি টাকার স্বর্ণসহ গ্রেপ্তার শহীদ ২ দিনের রিমান্ডে ‘গ্লোবাল ডিসরাপ্টর্স’ তালিকায় দীপিকা, স্ত্রীর সাফল্যে উচ্ছ্বসিত রণবীর খরচ বাঁচাতে গিয়ে দেশের ক্ষতি করবেন না: প্রধানমন্ত্রী জেরুসালেম-রিয়াদের মধ্যে স্বাভাবিককরণ চুক্তির মধ্যস্থতায় সৌদি বাইডেনের সহযোগী ‘ইসরাইলকে ফিলিস্তিন থেকে বের করে দাও’ এসএমই মেলার উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী ইরান ২ সপ্তাহের মধ্যে পরমাণু অস্ত্র বানাতে পারবে!
‘ইকোনমিস্টের’ খায়েশ অপূর্ণ থাকবে

‘ইকোনমিস্টের’ খায়েশ অপূর্ণ থাকবে

অরিজিনালি এর পরিচয় ছিল ‘সাপ্তাহিক লন্ডন ইকোনমিস্ট’ বলে। ১৮৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ‘ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা একালে এসে তা আমেরিকাতেও নিজের বিস্তার ঘটিয়েছে- এমনকি ‘কোর এডিটরিয়াল অফিসটা’ এই আমেরিকা থেকেই পরিচালিত। আবার ওয়েব ভার্সন বের করেছে যাতে সে যেন এক দৈনিক পত্রিকাও হয়ে গেছে। কারণ, কী আর করা! শক্ত প্রতিযোগিতার একালে মিডিয়া বলতে তা অনলাইনের দুনিয়া হয়ে গেছে। ফলে সাপ্তাহিক বলে কেউ এক সপ্তাহ হাতগুটিয়ে বসে থাকলে সেই মিডিয়ার বাজার তাতে প্রতিদ্বন্দ্বীর দখলে চলে যেতে পারে। অতএব অনলাইনে হলেও দৈনিক উপস্থিতি বা হাজির নিশ্চিত করতে হয়েছে।

অবশ্য এর অন্য আরো এক বড় কারণ আছে। সেটি আমেরিকার এক সরকারি সার্ভে রিপোর্টের ভাষায় বললে, ‘গ্লোবাল পুঁজিপ্রবাহের অভিমুখ’ প্রসঙ্গে, যা দুনিয়ার বাকি সবকিছুর প্রবাহ, এসবের অভিমুখ নির্ধারণ করে দিচ্ছে। ওই রিপোর্ট বলছে, গ্লোবাল বিনিয়োগপুঁজির প্রবাহের অভিমুখ একালে পশ্চিম থেকে পুবে মানে এশিয়ামুখী হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়; এই এশিয়ামুখী অভিমুখ আপাতত যেটি ফিক্সড বা স্থিরতা লাভ করে অবস্থান নিয়ে ফেলেছে। তাই আর আগামীতে আবার কখনোই তা পশ্চিমামুখী হবে না; তা ই-রিভার্সিভ্যাল; ঠিক যেভাবে লাগাতার গত ৪০০ বছর ধরে এটি পশ্চিমমুখী হয়ে কেন্দ্রীভূত ও সঞ্চিত হয়ে চলেছিল। সারা দুনিয়াকে কলোনি বানিয়ে লুট করে সব অর্থনৈতিক উদ্বৃত্ত পশ্চিমমুখী হয়ে কেন্দ্রীভূত ও সঞ্চিত করা হয়েছিল। যেন এখন এটা এক উল্টা এশিয়ামুখী হয়ে গেছে। আর এভাবেই উদ্বৃত্ত সঞ্চয়ের এক নয়া কাল হতে শুরু করে দিয়েছে। এশিয়ান এক চীনা উত্থানে সব উল্টে গেছে; যেটিকে অনেকে অবজেকটিভ বা প্রাকৃতিক প্রতিশোধের এক নয়াকাল বলতে শুরু করেছে।

আমেরিকান ওই সার্ভে রিপোর্টের মূল অর্থ-তাৎপর্যের আলোকে গ্লোবাল মিডিয়াকে ব্যাখ্যা করব। প্রায় ২০০ বছর আগের প্রতিষ্ঠিত পশ্চিমা মিডিয়াগুলো এই ‘অভিমুখ বদলের’ ব্যাপারটা তৎক্ষণাৎ বুঝে না ফেলার কোনো কারণ নেই। আর তারই প্রতিক্রিয়া সিদ্ধান্তে পশ্চিমের প্রতিটি মিডিয়া হাউজ দুনিয়া থেকে হারিয়ে যাওয়ার আগেই এশিয়ামুখী হয়ে নয়া অবস্থান সূচনা করে দিয়েছে। যেমন তাদের ফোকাস এখন এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রভাবশালী পাঠক কারা- দ্রুত তাদের খুঁজে বের করা আর তাদের নিজ নিজ মিডিয়া প্রডাক্ট এসব ব্যক্তির হাতে তুলে দিয়ে তাদের প্রভাবিত করতে না পারলে এশিয়ার নবউত্থিত বাজার ওসব পশ্চিমা মিডিয়ার হাতছাড়া হয়ে যাবে, প্রভাবশূন্য হয়ে যেতে পারে, তা বলাই বাহুল্য। ঠিক এটিই ঘটেছে। আমেরিকার বাইরে সিঙ্গাপুরকেন্দ্রিক নয়া পুঁজিবাজার শিফট হয়ে গেছে তাই না? সেই সাথে হংকং, সিঙ্গাপুরকেন্দ্রিক নয়া মিডিয়া হাউজগুলোরও দ্রুত উত্থান হচ্ছে। অতএব, ইকোনমিস্টও এখন অনলাইনে হলেও দৈনিক ভার্সনে হাজির!

ইকোনমিস্টের এমনই এক অনলাইন দৈনিকের ভার্সন আমার ই-মেল বক্সেও এসেছে। সেখানে এক প্রধান আর্টিকেলের ছোট শিরোনাম হলো- ‘ওয়েক আপ, ডেমোক্রাটস’! বাংলায় বললে, আমেরিকান ডেমোক্র্যাট দলের লোকেরা জেগে ওঠো! নিচে যার আবার বড় শিরোনাম হলো এমন, ‘ডেমোক্র্যাটদের জেগে ওঠা দরকার আর তাদের অ্যাক্টিভিস্টদের চরমপন্থী খায়েশে সব তছনছ হয়ে যাওয়া বন্ধ করা উচিত।’ আবার সার কথাটাও শেষে লিখে দিয়ে বলেছে, ‘আমেরিকার ভালোর জন্য শাসক দলের জরুরিভাবে নিজ দলের অ্যাক্টিভিস্টদের নিয়ন্ত্রণ নেয়া উচিত!’ কী সাংঘাতিক সব কথা! কিন্তু ইকোনমিস্ট কেন এত গরম কথা বলছে? দেখা যাক।

এরপর প্রথম কয়েকটি বাক্য আমি এখানে তুলে আনছি। লিখছে, আমেরিকার ‘প্রত্যেক প্রেসিডেন্টের আকাঙ্ক্ষা থাকে, তিনি এক ঐতিহাসিক কালের প্রেসিডেন্ট হবেন। কিন্তু সেটা যেন অবশ্যই জো বাইডেনের মতো ঐতিহাসিক প্রেসিডেন্ট নয়।’ পরের বাক্যে লিখেছে, ‘এ পর্যন্ত বাইডেনের প্রেসিডেন্টগিরি দেখে তার পাবলিক রেটিং বা গ্রহণযোগ্যতা ১৯৫০ সালের পরে সর্বনিম্ন।’ কেন এমন লিখল, কারণ রয়টার্সের ১৩ জুলাই প্রকাশিত এক সার্ভে বলছে- আগের দিন পর্যন্ত বাইডেনের গ্রণযোগ্যতা মাত্র ৩৯%। আর বাইডেন “সরাসরি ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে প্রকাশিত মতের” পাবলিক হলো ৫৫%।

এর পরে আরেকটা তথ্য যোগ করেছে ইকোনমিস্ট, যেটা আরো মারাত্মক! লিখছে, ‘এমনকি ডেমোক্র্যাট দল মানে বাইডেনের নিজ দলের ভেতরে তার গ্রহণযোগ্যতাবিষয়ক তথ্যে দেখা যাচ্ছে- ৬৭% দলীয় কর্মী মনে করেন বাইডেনের অর্থনীতির পারফরম্যান্স খুবই খারাপভাবে চলছে। এমনকি “৭৮% পাবলিক মনে করেন দেশ ‘ভুল পথে’ চলছে আর সে কারণে, ৬৪% মনে করেন ২০২৪ সালের নির্বাচনে বাইডেন নয় ভিন্ন প্রার্থী খোঁজা দরকার।”

ক্ষমতাসীন হওয়ার সময় ‘১৮ মাস আগে বাইডেন জনগণকে একটু শান্তি দেবেন, ভালো দিন দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ঘটেছে উল্টা। তাদের সব সুখ ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। চরমতম মুদ্রাস্ফীতি, সব সদিচ্ছা সু-বোধ সব হারিয়ে গেছে। এক মুদ্রাস্ফীতি সবকিছু খেয়ে ফেলেছে। আমেরিকার মুদ্রাস্ফীতি এখন ৯.১% যেখানে কোনো দেশে ৫-৬% এর উপরে যেকোনো মুদ্রাস্ফীতি হলে- ব্যবসা নয়, চাকরি করেন যারা, এমন সব নিম্নআয়ের মানুষের কাছে এমন মুদ্রাস্ফীতি খুবই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। কারণ, এটা তাদের ছোট ছোট সঞ্চয়ের ওপর তারা সাধারণত যে ব্যাংক ইন্টারেস্ট পান, মুদ্রাস্ফীতি তাকেই ছাপিয়ে যায়, নেগেটিভ হয়ে যায়। এতে এক কথায় সঞ্চয়ের মূল্য নেগেটিভ হয়ে যায় মানে, যেন সঞ্চয় ক্ষয়ে যায়।

কাজেই আগামী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আসন্ন মিড-টার্ম নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা গো-হারা হারবে তা নিয়ে তাদের আর কোনো সন্দেহ নেই। আসলে মিড-টার্ম নির্বাচন মানে হলো, চার বছরের প্রেসিডেন্ট টার্মের ঠিক প্রথম দু’বছর পূর্তিতে যে নির্বাচন। না, তাই বলে মিড-টার্ম এটা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কিছুই নয়। এখানে এবার ডেমোক্র্যাটরা হেরে গেলে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে পদত্যাগ করতে হবে না। তিনি বরং ২০২৪ সাল পর্যন্ত আগের মতোই প্রেসিডেন্ট থেকে যেতে পারবেন। আসলে এই নির্বাচন হলো, কংগ্রেস (আমাদের তুলনীয় ভাষায় বললে সংসদ) ও সিনেট (বা দ্বিতীয় সংসদ) এই দুই জায়গাতেই সব আসনে নয়, কেবল এক-তৃতীয়াংশ আসনেই মিড-টার্মে নতুন নির্বাচন হবে। আর সার্ভে প্রেডিকশন বলছে, এবারের মিড-টার্ম নির্বাচনে বাইডেনের পাপে ডেমোক্র্যাট দল বেশির ভাগ আসনেই গো-হারা হেরে যাবে। আর এতে পরবর্তীতে ফল হবে এই যে, পরে বাইডেন সরকার চালাতে গিয়ে পদে পদে বাধা পাবে। কারণ, ন্যূনতম সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে না বলে কংগ্রেস বা সিনেটের অনুমোদন না পেয়ে এর জ্বালায় প্রেসিডেন্টকে ভুগতে হবে।

এরপর এক কড়া নেতিমানের মন্তব্য জুড়ে দিয়েছে ইকোনমিস্ট। শব্দটা হলো জেরোন্টো-ক্রাট। একে খাস বাংলায় বললে- ‘বুইড়াদের’ শাসন বা সরকার। কেন এমন কথা? মানে ক্ষমতার শপথ নেয়ার পর থেকেই বাইডেন অনেক বয়স্ক ব্যক্তি এ কথাটা এর মধ্যে অনেকবারই মুখ্য হয়ে উঠতে দেখা গেছে। বিশেষত, এক অসুস্থতায় বাইডেনকে ল্যাবটেস্ট করাতে গিয়ে তাকে ‘আংশিক অচেতন’ হতে হতো। তাই ল্যাবে যাওয়ার আগেই ভাইস প্রেসিডেন্টের হাতে ক্ষমতা দিয়ে এরপর তিনি ল্যাবটেস্টে গিয়েছিলেন।

এই ব্যাপারটাতে ‘প্রেসিডেন্ট অনেক বুইড়া’ এই কথাটা যেন নগদ প্রমাণ হিসেবে পাবলিকলি হাজির হয়েছিল। আবার ওদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প তিনিও যথেষ্ট বুড়া সেটি সত্যিও বটে; আবার পাবলিক পারসেপশনেও তাই বটে। এ কারণেই ইকোনমিস্ট মন্তব্য করেছে, যেন বুইড়া বাইডেন আগামী দু’বছর খারাপ চালিয়ে শেষে সেই কারণেই আবার আরেক বুইড়া ট্রাম্পকেই না প্রেসিডেন্ট বানিয়ে নিয়ে হাজির করেন! অবশ্য মূল কথাটা এখানে আসলে হতাশা, এক গণহতাশা। মানে সামনে আমেরিকানদের ভাগ্য বদলের কোনো আশা নেই- এটিই হলো ইকোনমিস্টের মূল মেসেজ!

আবার ইকোনমিস্ট আগেই বলে নিচ্ছে, ‘রাজনৈতিক দলকে পরামর্শ দেয়া এই পত্রিকার কাজ বা দায়িত্ব নয়।’ এখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে তা হলে ইকোনমিস্টের এই আর্টিকেল ছাপানোর অর্থ কী? তাই এর উত্তরে আগাম তারা বলে রাখছে, ‘আমেরিকার অসুস্থ গণতন্ত্র এর জরুরি মেরামত দরকার’ তাই এ বিশেষ ব্যবস্থা।

তবে উপরে যে হতাশার কথা বলা হচ্ছে ওটা অবশ্যই রেগুলার বা সাধারণ হতাশা বলে বুঝলে ভুল হবে। কেন?

এর জবাব পাওয়া যাবে ইকোনমিস্টের কিছু আকার ইঙ্গিতের মন্তব্যে যা আসলে, আমেরিকান সমাজের অভ্যন্তরীণ গাঠনিক তন্তুতে দুর্বলতা, ঐক্যের অভাব যা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে এসব নিয়ে। ছোট ছোট শিরোনাম আকারে ইকোনমিস্ট তা উল্লেখ বা একটা তালিকা করে বলেছে- ১. ডি-ফান্ড দ্যা পুলিশ মুভমেন্ট; মানে হলো পুলিশ যদি সমাজের ঐক্য ধরে রাখতে কাক্সিক্ষত কর্তব্য পালন না করতে পারে তাহলে পুলিশ বাহিনীতে ফান্ড দেয়া বন্ধ করতে হবে বলে গড়া এক সামাজিক আন্দোলনের কথা বলা হচ্ছে এখানে। এ ধরনের, অনেক আন্দোলনের কথা তুলেছে ইকোনমিস্ট। যেমন আরো আছে- সীমান্তে ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা কার্যকর করা তুলে দেয়া বা ‘অ্যাবোলিশ ইমিগ্রেশন এনফোর্সমেন্ট’; অথবা মেয়েদের জন্মদাত্রী মানুষ হিসেবে তুলে ধরার আন্দোলন; অথবা ক্লাসরুম থেকেই ছাত্রদের অ্যান্টি-রেসিজম শেখানো (আসলে বলতে চাইছে সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী চিন্তায় সমাজ ছেয়ে গেছে তাই এর বিরোধিতার কথা) ইত্যাদি।

আসলে সার কথায় অপ্রত্যক্ষভাবে ইকোনমিস্ট বলতে চাইছে, রিপাবলিকানরা একালে সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী বিভিন্ন সামাজিক ঝোঁক বা তা থেকে ওঠা অসন্তোষকে উসকে দিচ্ছে। তাই ইকোনমিস্ট চাইছে ডেমোক্র্যাটদের এর বিরোধিতার পাল্টা এথিকস, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে কাজে উঠে আসতে হবে- এই হলো ইকোনমিস্টের বাসনা। যদিও সমস্যা হলো, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?

মূল কারণ, খোদ বাইডেনই আরেক ধরনের সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী- যাকে বলা যায় ‘গ্লোবাল সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী’; এখানেই তিনি কেবল ট্রাম্প থেকে আলাদা। তাহলে কে কাকে নৈতিকতা শেখাবেন?

তাছাড়া মূল সমস্যা তো এগুলোর একটাও নয়। আমেরিকান সমাজে অনৈক্য কেন?

কারণ, গত পঁচাত্তর বছর ধরে আমেরিকা গ্লোবাল নেতা হওয়া থেকে সমাজে আমেরিকানরা যেসব সুযোগ সুবিধার জীবনভর উপভোগ ও মাতব্বরি করে এসেছে- এক চীনা অর্থনৈতিক উত্থানেই তা এলোমেলো হয়ে গেছে। তবে এতে পুরনো আমেরিকান সমাজ যেন এর ধাক্কায় ধসে না পড়ে, যদি আমেরিকানরা বুদ্ধিমানের মতো চীনের সাথে প্রয়োজনীয় পজিটিভ ডিল করে রি-অ্যাডজাস্টমেন্ট করে, মেনে নিয়ে এগিয়ে যেত। গত ছয় বছরে, না ট্রাম্প না বাইডেন কেউ সেদিকে যাননি। বরং ঘুরেফিরে সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদই হয়ে উঠেছে। দুনিয়ার ওপর ছড়ি ঘুরাতে পারার ‘সীমাহীন লোভ’ তাদের চোখ-মুখে ঝিলিক দিয়ে গেছে, এখনো যাচ্ছে- বাস্তবে তা হারিয়ে যাচ্ছে এটা দেখার পরও।

ফলে আমেরিকান সমাজের সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদের প্রতি ‘সীমাহীন লোভ জাত’ অনৈক্য; এটি কে কাটাতে আসবে? কারণ, ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দুই রাজনৈতিক ধারাই সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী; কেবল, তাদের প্রকাশ ভিন্ন। এ অবস্থায় ইকোনমিস্ট প্রস্তাব করতে চাইছে ডেমোক্র্যাট দল কিছু এথিক্যাল দায়িত্ব পালন করুক।’ কিন্তু এটি কার্যত অসম্ভব!

সবচেয়ে বড় কথা, বাইডেন আসলে আরো বড় ধরনের ‘আমেরিকান গ্লোবাল ক্ষমতার অপব্যবহারকারী’। যেমন ধরতেন, তার অপছন্দ দেশের ওপর ‘ডলার অবরোধ আরোপ’ করা- এটি অপব্যবহার। আইএমএফ জন্মের সময় আমেরিকান ডলারভিত্তিক গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থা তৈরি করে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু আইএমএফ তো নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান। ফলে আইডিয়ালি আইএমএফের পূর্ব-অনুমোদন সাপেক্ষে আমেরিকার কোনো রাষ্ট্রের ওপর ডলার অবরোধ আরোপ করা সঠিক হতো।

কিন্তু আমেরিকান ডলার যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মুদ্রা, তা তো আসলে একই সাথে আমেরিকার-রাষ্ট্র এর ন্যাশনাল বা রাষ্ট্রীয় মুদ্রা। এই টেকনিক্যাল ফাঁক থেকে গেছে বলে এর সুযোগ নিয়ে আমেরিকা যেকোনো রাষ্ট্রের ওপর যা তার খেয়াল-ইচ্ছা, সে একে অবরোধ আরোপে হাতিয়ার বানিয়ে অপব্যবহার করে যাচ্ছে। কাজেই আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি, আগামীতে ডলারের বদলে অন্য যেকোনো মুদ্রা জায়গা নিলে এর ‘কাফফারা’ তখন আমেরিকান ডলারকে দিতে হবে। ভবিষ্যতে পুনর্গঠিত করে নেয়া আইএমএফ অবশ্যই নতুন গৃহীত যেকোনো আন্তর্জাতিক মুদ্রার ওপর এই খেয়ালি অপব্যবহার বন্ধে শর্ত আরোপ করবেই। কাজেই বাইডেন গং- এরা যতই অন্যান্য মুদ্রার রাষ্ট্রকে অসন্তুষ্ট করবে ততই তারা ডলারকে এড়িয়ে এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ার দিকে দ্রুত এগিয়ে যাবে।

বাইডেনের আরেক অপব্যবহারের হাতিয়ার : আমাদের সরকার লুটপাটের, জবাবদিহিতা নেই, জনপ্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা নেই; এগুলো সব ঠিক আছে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে যে গ্লোবাল মুদ্রাস্ফীতি ছড়িয়ে পড়েছে, তা থেকে এটি এক গ্লোবাল অর্থনৈতিক মহামন্দার দিকে ক্রমেই ঝুঁকছে। ফলে প্রত্যেক দেশই ফরেন কারেন্সি রিজার্ভের অস্থিরতা ও সঙ্কটে ঢুকে পড়ছে। আর তাতে আমরা আগেই ব্যবস্থা নিতে চাই বা বিপদে পড়ার পরে হলেও নিতে চাই, ভাবতে হচ্ছে। এমনটা হলে, আসলে আমাদের কেবল আইএমএফের তত্ত্বাবধান আর আইএমএফের ঋণের শরণাপন্ন হতেই হচ্ছে। বলা যায়, আমরা বাধ্য। কেন?

কথাটা এভাবে বলা যায়, ধরা যাক আমাদের যদি ১০ বিলিয়ন ডলার হলে সঙ্কট মোচন হয় আর সেই অর্থ যদি আইএমএফ নয়, একা চীন থেকেই এনে নেই, তাহলেও আমাদের সঙ্কটমুক্তি ঘটবে না। কেন?

এর মূল কারণ গ্লোবাল বাণিজ্য ও পুঁজিবাজারের অনাস্থা তাতে থেকেই যাবে, তাই। যেমন এমনিতে চীন এখনো কমিউনিস্ট চীন। তাই চীনের যেকোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হস্তক্ষেপ ঘটাতে কেবল চীনা সরকারের একটু ইশারাই যথেষ্ট বলে গ্লোবাল লেনদেনে বাণিজ্য বা পুঁজিবাজারের ধারণা। তবে এসব সাহায্য চীন ছাড়া অন্য অকমিউনিস্ট কোনো রাষ্ট্র দিলেও তাতে বাজারের আস্থা আসবে কিনা বলা মুশকিল। কারণ, গত পঁচাত্তর বছর ধরে বাজারে নিজের সম্পর্কে এই আস্থাটাই আইএমএফ গড়ে তুলেছে। কোনো বাজার-বিনিয়োগে নিয়োজিত অর্থ যার থাকে, তারই কেবল আস্থা আসতে হবে- এর কোনো বিকল্পও নেই।

এখন বড় মালিক শেয়ারহোল্ডার আমেরিকা বলে এর কর্তৃত্ব আইএমএফের ওপর অনেক বেশি। যেমন এখনকার বিশ্বব্যাংকের চেয়ারম্যান ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিয়োগ দেয়া, প্রায় তারই নিজ দোস্ত-জিগার যদিও কোনো দেশের রাজনীতিতে ন্যূনতম হস্তক্ষেপ ঘটানো আইএমএফের ম্যান্ডেট অনুসারে খুবই গর্হিত অপরাধ। কিন্তু এর পরেও বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট মেরে ফেলার পরিকল্পক আইএমএফ, এমন রেকর্ড আছে।

আর একালে আমরা ট্রাম্প-বাইডেনের আমলে দেখছি তারা (তাদের ভাষায় চীনের কর্তৃত্ব খর্ব করতে) আইএমএফকে দিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রে অ্যাবিউজ বা অপব্যবহার করছে। যেমন বর্তমানের কারেন্সি মজুদ সঙ্কটে কোনো দেশে আইএমএফ পুরনো সরকারের সাথেই সব আলাপ করছে, চুক্তির শর্তও ঠিক করছে, ইত্যাদি সবকিছু। কিন্তু উপস্থিত সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। এতে নয়া সরকার না এলে চুক্তি করা বা পরে অর্থ ট্রান্সফার, কোনোটাই আইএমএফ করছে না। এভাবেই বাইডেনের ইচ্ছার বরকন্দাজ সাজছে, আর এভাবেই বাইডেন আইএমএফের মুরুব্বি হওয়াকে অপব্যবহার করছেন।

মন্দের ভালো হিসেবে এদেশের মতো সরকারগুলোর প্রতি জনগণ অতিষ্ঠ থাকার কারণে এ অপব্যবহার বা হস্তক্ষেপের সুযোগটি বাইডেনের পক্ষে যাচ্ছে; তবে এটি বাইডেনের ক্ষমতার অপব্যবহার। তাই আজ বাদে কাল এই হস্তক্ষেপের ‘কাফফারা’ চুকাতে হবে হয়তো!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877