শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৫১ অপরাহ্ন

ক্রেতাশূন্য শেয়ারবাজারে লেনদেন তলানিতে

ক্রেতাশূন্য শেয়ারবাজারে লেনদেন তলানিতে

স্বদেশ ডেস্ক:

২০১০ সালে ধসের এক যুগ পরও বিনিয়োগকারীর কাছে এখনো আস্থাহীন দেশের শেয়ারবাজার। এখনো এটি পুঁজি হারানোর বাজার। ভালো-মন্দ বেশিরভাগ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেও লাভের দেখা মিলছে না। তাই বাজারে আসতে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে না বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। বেশ কিছুদিন ধরেই বাজারে ক্রেতার সংকট। শেয়ার বিক্রি করেও লাভ না পাওয়াই এ সংকটের প্রধান কারণ। ফলে লোকসানে শেয়ার বিক্রি করছেন না কেউ, নতুন করে কিনছেনও না। এ কারণেই ক্রেতা-সংকট দেখা দিয়েছে। সোমবার শেয়ারবাজারে ১০৮টি শেয়ার ও প্রতিষ্ঠানের কোনো ক্রেতা ছিল না। বাজারের এমন পরিস্থিতিকে অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাজারসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীদের নিষ্ক্রিয়তায় দেশের শেয়ারবাজারে লেনদেনে খরা দেখা দিয়েছে। গত এক বছর আগে যেখানে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ছুঁয়েছিল সেখানে তা কমে চারশ কোটির নিচে নেমেছে।

কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই গুজব ছড়িয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ার কিনতে বিক্রির কৃত্রিম চাপ দিচ্ছেন। সেই তুলনায় মিলছে না ক্রেতা। অল্প দামে শেয়ার কিনতে এক গোষ্ঠীর অপচেষ্টায় জিম্মি হয়ে পড়ছে পুরো বাজার।

যদিও বাজারকে গতিশীল রাখতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কিন্তু তাতে সাড়া মিলছে না। শেয়ারবাজারে তারল্য বাড়ানো এবং দরপতন ঠেকানোর লক্ষ্যে ‘ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড’ বা ‘শেয়ারবাজার স্থিতিশীল তহবিল’ থেকে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। সরকারি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) মাধ্যমে গত সপ্তাহে এই বিনিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়াতে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সঙ্গে টানা বৈঠক করে যাচ্ছে বিএসইসি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানা উদ্যোগের তাৎক্ষণিক সুফল মিলছে না।

অন্যদিকে শেয়ারদরের নিম্নসার্কিট ব্রেকার ২ শতাংশে বেঁধে দেওয়াকে লেনদেন পতনের বড় কারণ বলে মনে করেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, সার্কিট ব্রেকারের নিম্নসীমা মাত্র ২ শতাংশ হওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই দেড়শ থেকে দুইশ শেয়ার এমন দরে কেনাবেচা হচ্ছে। সর্বনিম্ন দরে নামার পর সিংহভাগ শেয়ার ক্রেতা হারাচ্ছে।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঢাকার শেয়ারবাজারে লেনদেনে অংশ নেওয়া ৯০ শতাংশের বেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ সময়ে দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠানের ক্রেতা ছিল না। লেনদেনে অংশ নেওয়া ৩৮০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দাম কমেছে ৩৪৭টির, বেড়েছে ১৪টির আর অপরিবর্তিত ছিল ১৯টির। ডিএসইতে দরপতনের মধ্য দিয়ে লেনদেন শুরু হয়। লেনদেনের সময় ৩০ মিনিট পার না হতেই ধসে রূপ নেয় শেয়ারবাজার। লেনদেনের প্রথম আধঘণ্টার মধ্যেই অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ক্রয় আদেশের ঘর শূন্য হয়ে পড়ে। লেনদেনের শুরুতে এমন পরিস্থিতি দেখা দেওয়ায় এক শ্রেণির বিনিয়োগকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ায়। ক্রেতা না পাওয়ায় বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে একের পর এক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম দিনের সর্বনিম্ন দামে বিক্রির আদেশ আসতে থাকে। কিন্তু এ দামেও হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করতে পারেননি বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী।

লেনদেনের শেষদিকে এসে ১৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠানের ক্রয় আদেশের ঘর শূন্য হয়ে পড়ে। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ দিনের সর্বনিম্ন দামে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করতে চাইলেও তারা ক্রেতা খুঁজে পাননি। দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠানের ক্রেতা না থাকায় লেনদেনও আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। দিনভর ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৩৯০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এর মাধ্যমে ২০২১ সালের ৫ এপ্রিলের পর ডিএসইতে সর্বনিম্ন লেনদেনের ঘটনা ঘটল।

ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৭২ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ৪৮২ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। অপর দুই সূচকের মধ্যে বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক ২৫ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ৪০৯ পয়েন্টে অবস্থান করছে। ডিএসই শরিয়াহ্ আগের দিনের তুলনায় ১৩ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৪২৮ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

ফার্স্ট ক্যাপিটাল সিকিউরিটিজ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাওছার আল মামুন আমাদের সময়কে বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের শুরুতে এবং দুবাইয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ রোডশোর প্রাক্কালে দরপতন রোধে সার্কিট ব্রেকারের ২ শতাংশের নিয়ম জারি করা হয়। এতে কোম্পানির শেয়ারের দাম ২ শতাংশ কমলেই বামে হলটেড হচ্ছে। এতে মানুষের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক অবস্থান তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া নতুন করে শ্রীলংকা ইস্যুতেও নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে বিনিয়োগকারীদের। তবে বাজার ২ হাজার পয়েন্ট বৃদ্ধির পর সংশোধন হবে এটাই স্বাভাবিক। এজন্য তিনি বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি না করার পরামর্শ দেন।

ডিএসইর এক সিনিয়র সদস্য আমাদের সময়কে বলেন, আগে সার্কিট ব্রেকার ১০ শতাংশ ছিল। এটি বর্তমানে ২ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে অল্প দাম কমলেই সার্কিট ব্রেকার টাচ করছে। ফলে ক্রেতাদের মধ্যে এক ধরনের স্নায়ুচাপ তৈরি হয়। এতে সমস্যা হচ্ছে, ক্রেতা যখন দেখেন সার্কিট ব্রেকার টাচ করেছে, তখন তিনি মনে করেন আরও কমবে। এজন্য তারা বাজার পর্যবেক্ষণে চলে যায়। অন্যদিকে বিক্রেতাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। তখন তারা মন্দ শেয়ার বিক্রি করতে পারেন না। ফলে তারা ভালো শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেন। বাজারে বড় ধরনের দরপতন হয়।

এ ছাড়া ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত বাজারে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পয়েন্ট বৃদ্ধি পায়। এই সময়ে লকডাউন থাকায় অনেক শিল্পপতি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন। সেখান থেকে ভালো মুনাফা হয় তাদের। এর মধ্যে লকডাউন উঠে যায়, তখন তারা বাজার থেকে স্মার্ট ফান্ড তুলে নিয়ে গেছেন। ফলে বাজারে এক ধরনের ভ্যাকুয়াম তৈরি হয়েছে।

সম্প্রতি বাজার পরিস্থিতি নিয়ে ডিএসইর সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আহমেদ রশিদ লালী বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারী এখন সাইড লাইনে রয়েছে। গত কিছুদিন ধরেই বাজার নিম্নমুখী রয়েছে। শেয়ারে বিনিয়োগ করলেই দাম কমছে। তিনি বলেন, ২ শতাংশ সার্কিট ব্রেকার তুলে নেওয়া উচিত। তা না হলেও অন্তত ৫ শতাংশ করা উচিত।

এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পরামর্শ দিয়ে শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, নিচের দিকে সার্কিট ব্রেকার ২ শতাংশ আরোপের কারণে বাজার ড্রাই হয়ে গেছে। কারণ আগে একদিনে বাজারের যে সংশোধন হতো এখন সেটি ৭ দিন লাগছে। এজন্য বাজারকে বাজারের গতিতেই চলতে দিতে হবে। এটি তুলে নিতে হবে। তা হলেই বাজার প্রাণ ফিরে পাবে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877