মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন :
রেল যাবে পর্যটন নগরী কক্সবাজার। জোরেশোরে চলছে কক্সবাজার অংশের প্রকল্পের কাজ। এর মধ্যে ৬২ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আগামী বছরের শেষের দিকে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে দোহাজারী- কক্সবাজার রেললাইন স¤প্রসারণের কাজ। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত থাকছে ৯টি রেল স্টেশন। সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকোরিয়া, ডুলাহাজরা, রামু ঈদগাঁ হয়ে কক্সবাজার। স্টেশনগুলোর নির্মাণকাজও প্রায় শেষের পথে।
বস্তুত রেলের উন্নয়ন মানে রাষ্ট্রের উন্নয়ন, রাষ্ট্রের জনগণের উন্নয়ন। দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনো দরিদ্র। দরিদ্র মানুষগুলোর সাশ্রয়ী মূল্যে যোগাযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা জরুরি, যা সম্ভব রেলের মাধ্যমেই। তা ছাড়া পরিবহনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে কিছু সামাজিক দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয়, যা রেলওয়ে ছাড়া আর কোনো মাধ্যমে এত সহজে করা সম্ভব নয়। যেমন রেলওয়েকে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পণ্য এবং যাত্রীকে অতি স্বল্পমূল্যে পরিবহনে সাহায্য করতে হয়। অনেক সময় লাভজনক নয় এমন লাইন চালু রাখতে হয় দেশের জনগণের যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত করতে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোনসহ যে কোনো দুর্যোগকবলিত এলাকার মানুষের সাহায্যার্থে ত্রাণ ও পুনর্বাসন সামগ্রী নামমাত্র মূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হয়। কাজেই রেলের উন্নয়ন মানে রাষ্ট্রের উন্নয়ন, রাষ্ট্রের নাগরিকদের উন্নয়ন।
তবে অত্যন্ত আনন্দের খবর হলো, ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। এটি বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে। বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রাম ও পর্যটন নগরী কক্সবাজারের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পর্যটন শিল্পের বিকাশে রাখবে যুগান্তকারী ভ‚মিকা। এই নেটওয়ার্ক চীনের ইউনান প্রদেশ থেকে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার, বাংলাদেশ, ভারত হয়ে তুরস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত। পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলো, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, সিঙ্গাপুর, কোরিয়াও এ নেটওয়ার্কের আওতায়।
১৮৮০ সালে ব্রিটিশ রেলওয়ে চট্টগ্রাম থেকে রামু ও কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমার পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের জন্য সার্ভে করেছিল। সে পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৮-১৯০৯ সালের মধ্যে মিয়ানমার রেলওয়ে আরো বিশদ সার্ভে করে। ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সালে আবার সার্ভে করে চট্টগ্রাম-দোহাজারী মিটার গেজ রেললাইন স্থাপন করা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে কক্সবাজার থেকে রামু পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি।
১৯৫৮ সালে পূর্ববাংলা রেলওয়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণ দিক থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন স¤প্রসারণের জন্য সার্ভে পরিচালনা করে। এর উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলসংযোগ স্থাপন করা। জাপান রেলওয়ে টেকনিক্যাল সার্ভিস (জেআরটিএস) ১৯৯১ সালে রেলওয়ে লাইনটির ট্রাফিক সম্ভাবনা যাচাইয়ের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করে। পরে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে (জেআরটিএস) ১৯৭৬-৭৭ সালে ডাটা সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন করে। ১৯৯২ সালে ইকোনমিক অ্যান্ড সোস্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য পেসিফিক কমিশন অধিবেশনে সম্মতিপ্রাপ্ত এশিয়ান ল্যান্ড ট্রান্সপোর্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট নামের প্রকল্পের আওতায় ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের তিনটি ইউরো-এশিয়ার সংযোগ বোর্ডের মধ্যে সাউদার্ন করিডোর অন্যতম রুট। এ বিবেচনায় সর্বশেষ-দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুনধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন মিটার গেজ নির্মাণের জন্য এক হাজার ৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প ২০১০ সালের ৬ জুলাই অনুমোদন দেয় একনেক। কিন্তু পরে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা না পাওয়ায় প্রকল্পের বাস্তবায়ন আটকে ছিল। এ অবস্থায় ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর একনেক বৈঠকে সিঙ্গেল লাইন ট্র্যাককে মিটার গেজের পরিবর্তে ডুয়েল গেজ ট্র্যাকে নির্মাণের নির্দেশনা দেয়া হয়।
সে অনুযায়ী প্রকল্পটি সংশোধন করে ২০১৬ সালের ১৭ এপ্রিল অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্পের মাধ্যমে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত এবং রামু থেকে মিয়ানমারের নিকটবর্তী ঘুনধুম পর্যন্ত মোট ১২৯ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণের মাধ্যমে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সাথে বাংলাদেশ রেলওয়ের যোগাযোগ স্থাপনসহ ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সাথে সংযোগ স্থাপিত হবে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, নতুন এ প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত থাকছে ৯টি রেল স্টেশন। সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকোরিয়া, ডুলাহাজরা, রামু ঈদগাঁ হয়ে কক্সবাজার। রেল স্টেশনগুলোর ডিজাইন করা হয়েছে সেখানকার প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর ভিত্তি করে। এর মধ্যে কক্সবাজার রেলস্টেশনটির ডিজাইন করা হয়েছে সমুদ্রের ঝিনুক আদলে। আরো আনন্দের খবর হলো, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন যাবে কখনো পাহাড় ঘেঁষে, কখনো গভীর জঙ্গলের পাশ দিয়ে। ফলে ট্রেনের যাত্রীরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ট্রেনে ভ্রমণ করবেন।
তবে এসব সম্ভাবনা বাস্তব রূপ দিতে প্রয়োজন রেলের জন্য নতুন বগি ও ইঞ্জিন আমদানি করা। জানা যায়, বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ২৭০টি নতুন রেলবগি আনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ইন্দোনেশিয়া থেকে ১৫টি বগি এসে পৌঁছেছে। ইঞ্জিন আনার প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। তবে ইঞ্জিন আসতে বেশ কিছু দিন লেগে যেতে পারে। এ সময়ের মধ্যে বিভিন্ন রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইঞ্জিনের সঙ্কটে রেলের কোনো বিভাগেই কাক্সিক্ষত সংখ্যায় ট্রেন চলাচল করছে না। রেলের পূর্বাঞ্চলে প্রতিদিন প্রায় ৫০টি ইঞ্জিনের ঘাটতি রয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলে ঘাটতি ২০-২৫টি। যার কারণে রেলের সময়সূচিতে ঘটছে ব্যাঘাত। রেলের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে ২৯৪টি ইঞ্জিন রয়েছে। এর মধ্যে ২৭০টি চালানো হচ্ছে। সাধারণত ইঞ্জিনের মেয়াদকাল ২০ বছর। কিন্তু রেলবহরে ৫৫-৬০ বছরের পুরনো ইঞ্জিনও আছে। মেয়াদকাল শেষ হয়ে যাওয়ায় অনেক ইঞ্জিন মেরামতের জন্য দীর্ঘসময় কারখানায় ফেলে রাখতে হয়। ফলে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে রেলের ৩৪০টি ট্রেনের এক-তৃতীয়াংশই ঠিকমতো সময়সূচি মেনে চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
রেলওয়ে সূত্র মতে, রেলের ৭০টি ইঞ্জিন আমদানি করা হবে। পূর্বাঞ্চলীয় রেলে ৩০টি বিকল ইঞ্জিন কারখানায় পড়ে আছে। রেলে তিন বছর ধরে ইঞ্জিনের সঙ্কট চলছে। বগি এর আগেও আনা হয়েছে। ২০০৮ সালে চীন থেকে ৮০টি বগি আনা হয়। পূর্বাঞ্চল রেলের জন্য আরো ৭০টি মিটারগেজ বগি আমদানির জন্য দরপত্র আহŸান করা হয়েছে। পূর্বাঞ্চলের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১১টি ইঞ্জিন আমদানি করা হয়েছিল। এরপর আর ইঞ্জিন আনা হয়নি। সূত্র আরো জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটসহ বিভিন্ন রুটে পাঁচটি ট্রেন বাড়াতে চায় রেলওয়ে। এসব ট্রেন হবে ১৫ বগির। নতুন বগি আসার পর এগুলো চালু করা হবে।
আমাদের সীমিত সম্পদ, জনসংখার আধিক্য, নিম্ন আয় ও কৃষি নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থায় রেলের গুরুত্ব ব্যাপক। যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত করতে, বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান, পণ্য পরিবহনে, অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞের ব্যাপক প্রসার এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে রেলের আধুনিকায়ন অত্যন্ত জরুরি। শিল্পায়ন, নগরায়ন, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দেশের আর্থ-সামাজিক অচলায়তনের ধারা ভেঙে পুঁজি ও শিল্পনির্ভর সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণে রেলওয়ে পালন করছে অভ‚তপূর্ব ভ‚মিকা। কাজেই রেলের আধুনিকায়নের বিকল্প নেই।
ই-মেল: [email protected]