শুক্রবার, ২৪ মে ২০২৪, ১১:৩৫ অপরাহ্ন

ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ৪০ বছর

ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ৪০ বছর

মো: মাঈনউদ্দীন:

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের পথচলা শুরু হয় ১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ১৩ মার্চ ১৯৮৩ সালে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রথম ইসলামী ব্যাংকরূপে এ ব্যাংকটি নিবন্ধিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স পায় ২৭ মার্চ ১৯৮৩। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় মূলত ১২ আগস্ট ১৯৮৩ থেকে। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় ওআইসি সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যোগ দেন। সম্মেলনে মুসলিম দেশগুলোয় আন্তর্জাতিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। ওই বছরেই ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনে সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আইডিবি সনদ স্বাক্ষর করেন। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিংয়ের লাইসেন্স প্রদান করে।

পূবালী ব্যাংকের প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম খালেদ, সোনালী ব্যাংকের স্টাফ কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল এম আযীযুল হক, বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর নূরুল ইসলাম, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব আব্দুর রাজ্জাক লস্কর, তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ খালিদ খান, চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফের পীর সাহেব মাওলানা আব্দুল জব্বার ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইউনুছসহ কিছুসংখ্যক উদ্যোগী ব্যক্তিত্ব, চারটি প্রতিষ্ঠান, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের ১১টি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও দু’জন বিদেশী ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক শুধু দেশে নয়; দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। দেশের মোট আমানতের ২৭.৫৪ শতাংশ ইসলামী ব্যাংকগুলোতে রয়েছে। মোট ব্যাংকিং খাতের ২৫ শতাংশ এবং এর বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ১৪ শতাংশ ইসলামী ব্যাংকের।

এ ছাড়া প্রচলিত ব্যাংকিং খাতের তুলনায় ইসলামী অর্থায়নে বিনিয়োগে মূলধনে মুনাফার হার বেশি এবং খেলাপির ঋণের পরিমাণ তুলনামূলক ইসলামী ব্যাংকিংয়ে কম। সম্পদের দিক থেকে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যাংকিং র‌্যাংকিংয়ে ১১তম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড বিশ্বের ১০০০ সেরা ব্যাংকের একটি। বাংদেশের ইসলামী অর্থায়ন, সামগ্রিক আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কার্যক্রমে গোটা বিশ্বের কাছে এটি একটি রোল মডেল। বিশ্বে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমের ৩৫ শতাংশ গ্রাহক এবং বৈশ্বিক ক্ষুদ্র ঋণের ৫০ শতাংশ নিয়ে বাংলাদেশ গোটা বিশ্বের ইসলামী অর্থায়নে উল্লেখযোগ্য অংশীদার।

ইসলামী ব্যাংকিংয়ের অব্যাহত সাফল্য ও অগ্রগতি দেখে দুই দশকের পুরনো ব্যাংকও প্রচলিত ব্যাংকিং ছেড়ে ইসলামী ব্যাংকিং শুরু করেছে। চাহিদা তৈরি হওয়ায় দেশের ৬২টি ব্যাংকের ১০টি পূর্ণাঙ্গভাবে এবং ৩৪টি বিভিন্নভাবে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ ২০২১ শেষে দেশের ব্যাংক খাতের মোট আমানত ছিল ১২ লাখ ৯৮ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকগুলোতে রয়েছে তিন লাখ ৫৭ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা, যা আমানতের ২৭.৫৪ শতাংশ।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতের আমানতে ইসলামী ব্যাংকগুলোর হিস্যা ছিল ২৫.৩৩ শতাংশ মার্চ ২০২১ শেষে ব্যাংক খাতের ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৬৩ হাজার ২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ছিল তিন লাখ ২২ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, প্রবাসী আয়ের ৩৩ শতাংশ আসে ইসলামী ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। গতানুগতিক ব্যাংকগুলোর চেয়ে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ব্যবসা দ্রুত বড় হচ্ছে। বর্তমানে দেশে মোট ১০ হাজার ৭৬৭টি ব্যাংক শাখার মধ্যে এক হাজার ৭৫৫টি ইসলামী ব্যাংকিংয়ের শাখা রয়েছে। ব্যাংকিংয়ের শাখা দিন দিন বেড়েই চলেছে। জনবল রয়েছে ৪৩ হাজার ২৮৮ জন। ইসলামী ব্যাংকগুলো শাখা কার্যক্রমের পাশাপাশি এজেন্ট ও উপ শাখার মাধ্যমেও বিস্তৃতি লাভ করছে। এ ছাড়া এটিএম, সিআরএম-সহ ডিজিটাল ব্যাংকিংয়েও ইসলামী ব্যাংকগুলো এগিয়ে যাচ্ছে।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের পথ ধরে ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আল-বারাকা ব্যাংক, যা বর্তমানে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক নামে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর পর ১৯৯৫ সালে আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। দেশের প্রচলিত ব্যাংকিং ধারা ছেড়ে ২০০৪ সালে ১ জুলাই ইসলামী ব্যাংকিংয়ে আসে এক্সিম ব্যাংক। ২০০৯ সালে ১ জানুয়ারি ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক সুদভিত্তিক ব্যাংক পরিহার করে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক নাম ধারণ করে। এরপরে ২০১৩ সালে আসে ইউনিয়ন ব্যাংক। ২০২১ সালে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে। তা ছাড়া বহুজাতিক এইচএসবিসি ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডও ইসলামী ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাই মুরাবাহা পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। মোট বিনিয়োগের ৪৫ শতাংশ রয়েছে এই পদ্ধতিতে। এর বাইরে রয়েছে বাই মুয়াজ্জাল পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ১৪.৫৮ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে। এ ছাড়া বাই সালাম ইজারা, বাই ইসতিসনা, মুশারাকাসহ অন্যান্য পদ্ধতিও রয়েছে। ক্ষুদ্র মাঝারি খাত, আবাসিক খাত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ কৃষি খাতে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় আমানত সংগ্রহে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ব্যাংকটির বর্তমান আমানতের পরিমাণ এক লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট আমানতের ১০ ভাগেরও বেশি। ব্যাংকটির বিনিয়োগের পরিমাণ এক লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট ব্যাংকিং ঋণ বা বিনিয়োগের ৯ শতাংশ। আমানত ও বিনিয়োগে ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান সর্বোচ্চ চূড়ায়।

দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যেও শীর্ষে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। আমদানি-রফতানি খাতে ইসলামী ব্যাংকের অবদান উল্লেখযোগ্য। ২০২১ সালে ইসলামী ব্যাংক আমদানি-রফতানি করেছে যথাক্রমে ৬৪ হাজার কোটি ও ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এতে ইসলামী ব্যাংকের মার্কেট শেয়ার যথাক্রমে ১১.০৪% ও ৮%। অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ এর স্থানীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। রেমিট্যান্সেও এ ব্যাংকটির অবস্থান শীর্ষে। ২০২১ সালে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে ৫১ হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স আহরিত হয়েছে। দেশের ব্যবসাবাণিজ্যে, কলকারখানায়, শিল্পায়নেও ইসলামী ব্যাংক অবদান রেখে যাচ্ছে। চার দশকে উপনীত এই ব্যাংকটি ছয় হাজারেরও বেশি শিল্পকারখানায় অর্থায়ন করেছে। গার্মেন্ট, টেক্সটাইল, স্পিনিং মিল, স্টিল রি-রোলিং, লোহা ও ইস্পাত শিল্প, বিদ্যুৎসহ নানাবিধ ভারী শিল্পকারখানায় ও ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ রয়েছে। দেশের প্রায় এক হাজারেরও বেশি গার্মেন্ট শিল্প পরিচালিত হচ্ছে এই ব্যাংকের অর্থায়নে।
কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান, পাটশিল্প, চামড়াশিল্পেও এ ব্যাংকের বড় ধরনের অবদান বিনিয়োগ রয়েছে। ২০২১ সালে কৃষি খাতে প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার গ্রাহকের মধ্যে বিনিয়োগ প্রদান করে এ ব্যাংক। এসএমই খাতে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিনিয়োগের পরিমাণ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট এসএমই বিনিয়োগের ১১ শতাংশ। সড়ক পরিবহন, বিমান, নৌপথেও ইসলামী ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ রয়েছে। বর্তমানে দেশব্যাপী প্রায় পাঁচ শতাধিক শাখা ও উপ শাখা রয়েছে। ২৭০০ এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট রয়েছে। বর্তমানে এক কোটি ৬০ লাখ গ্রাহককে সেবা দিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকের প্রায় ২০ হাজার জনশক্তি। পল্লী উন্নয়ন কার্যক্রমেও ব্যাংকটি বিরাট ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। দেশের ২৮ হাজার ৯২১টি গ্রামে পল্লী উন্নয়ন কার্যক্রম (RDS) সম্প্রসারণ করেছে। যেখানে গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ, যার ৯২% নারী।

চার দশকের পদার্পণে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের শরিয়াহ পরিপালন ও পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগে কতটুকু অবদান রাখছে তা মূল্যায়ন করা উচিত। এখনো দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়েছে। তাদেরকে ইসলামী ব্যাংকিংয়ে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। ব্যাংকার ও গবেষকদের মতে, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ও অর্থব্যবস্থার ওপর শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকিং অর্থায়নে পদ্ধতি ও লেনদেনে শরিয়াহ পরিপালনের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জ্ঞানসম্পন্ন ও অভিজ্ঞ ব্যাংকার ও কর্মকর্তার এখনো ঘাটতি রয়েছে।

ইসলামী ব্যাংকিং চার দশকে পদার্পণ করলেও ইসলামী ব্যাংকিংয়ের পরিপূর্ণ বিকাশে পৃথক পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকিং আইন এখনো করা যায়নি। গ্রাহক পর্যায়ে মুদারাবা আমানতকারী ও বিনিয়োগ গ্রহীতা উভয়েরই ইসলামী ব্যাংকিং নীতিমালার মৌলিক বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারণার অভাব রয়েছে। দেশের বিশিষ্টজনের মতে, ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সফলতা ও অগ্রগতিকে সামনে রেখে গ্রাহকদের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতি সম্মান দেখিয়ে পরিপূর্ণ ইসলামী ব্যাংকিং আইন প্রণয়ন করা উচিত। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ভিত্তি হলো শরিয়াহ পরিপালন ও সুদমুক্তভাবে ব্যবসা পরিচালনা করা। ইসলামী ব্যাংকগুলো আশা করি আগামীতেও গ্রাহকের আস্থা ও ভালোবাসা নিয়ে জনগণকে ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাবে।

লেখক : ব্যাংকার

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877