বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারী ২০২৫, ১১:২০ অপরাহ্ন

জাস্টিন ট্রুডোকে যে কারণে কানাডার মনে রাখতে হবে

জাস্টিন ট্রুডোকে যে কারণে কানাডার মনে রাখতে হবে

সার্জ শমেম্যান:

রাজনীতির পেন্ডুলাম বা দোলক কখনো থেমে থাকে না। আজকে যা উদ্দীপনা ও উচ্ছ্বাস এনে দেয়, কাল সেটিই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। জাস্টিন ট্রুডোর এটি জানা উচিত ছিল। কারণ, তাঁর বাবা পিয়েরে ট্রুডো কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৫ বছর শাসন করার পর তাঁর ক্যারিশমা ও প্রগতিশীল নীতির প্রতি জনমনের ক্লান্তি দেখে ১৯৮৪ সালে পদত্যাগ করেছিলেন।

অনেক দিন ধরেই জাস্টিন ট্রুডোর কিছু সহকর্মী তাঁকে একটু ‘তুষারের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করে আসার’ পরামর্শ দিচ্ছিলেন। তুষারের মধ্যে হাঁটার কথাটি প্রতীকী। জাস্টিন একবার বলেছিলেন, তাঁর বাবা পিয়েরে ট্রুডো তাঁকে বলেছিলেন, তিনি (পিয়েরে ট্রুডো) একবার তুষারঢাকা পথে হাঁটতে হাঁটতে গভীর চিন্তা করেছিলেন এবং সে সময়ই পদত্যাগ করবেন বলে ঠিক করেছিলেন।

এ ইঙ্গিত দিয়ে জাস্টিন ট্রুডোর সহকর্মীরা আসলে তাঁকে বলতে চাইছিলেন, তিনি যেন নিজের অবস্থান মূল্যায়ন করেন এবং তাঁর জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করার মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নেন।

২০১৫ সালের নির্বাচনে জাস্টিন ট্রুডো প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পারের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। হার্পার ছিলেন এক কঠোর রক্ষণশীল নেতা। সেই নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না; সেটি ছিল কানাডার জাতীয় পরিচয়ের ওপর একটি গভীর বিতর্ক।

জাস্টিন ট্রুডো যখন কানাডার রাজনীতিতে প্রবেশ করেন, তখন তিনি তরুণ (৪৩ বছর বয়স), আকর্ষণীয় এবং নতুন উদ্দীপনায় ভরপুর ছিলেন। রাজনীতিতে তাঁর আগমন একধরনের আশার বাতাস নিয়ে এসেছিল, যেমনটি তাঁর বাবা পিয়েরে ট্রুডোর ক্ষেত্রে ঘটেছিল। তাঁর বাবা কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনগণের কাছে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।

জাস্টিন ট্রুডো তাঁর রাজনৈতিক মন্ত্র বা স্লোগান হিসেবে ‘সানি ওয়েজ’ বা ‘উজ্জ্বল পথ’ অনুসরণ করেছিলেন। এটি একটি ইতিবাচক ও আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিল। এর মধ্য দিয়ে তিনি কানাডার ভবিষ্যৎকে আরও প্রগতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

ট্রুডোর প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি আসলে সেই আদর্শের পুনর্জাগরণ ছিল, যা ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে লিবারেল পার্টি গ্রহণ করেছিল। এ দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে বহুসংস্কৃতিবাদ, দ্বিভাষিকতা, সমানাধিকার ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মতো বিষয় ছিল। কিন্তু তাঁর বাবার শাসনের পর লিবারেল পার্টির কিছু উত্তরসূরি সেই প্রগতিশীল নীতিগুলোকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল।

জাস্টিন ট্রুডো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি সেই হারিয়ে যাওয়া প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি আবার ফিরিয়ে আনবেন এবং কানাডাকে একটি অধিকতর উদার ও সমতাভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত করবেন। এটি তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল এবং তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল।

২০১৫ সালের নির্বাচনে জাস্টিন ট্রুডো প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পারের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। হার্পার ছিলেন এক কঠোর রক্ষণশীল নেতা। সেই নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না; সেটি ছিল কানাডার জাতীয় পরিচয়ের ওপর একটি গভীর বিতর্ক।

গাই লসন নিউইয়র্ক টাইমস–এ লিখেছিলেন, ‘কানাডীয় হওয়ার মানে আসলে কী হওয়া উচিত’ তা বোঝানোই ট্রুডোর সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল। ট্রুডো তাঁর প্রচারে একটি প্রগতিশীল কানাডার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি কানাডাকে একটি আন্তর্জাতিকতাবাদী, দ্বিভাষিক ও বহুসংস্কৃতিবাদী দেশ হিসেবে পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

শুরুতে জাস্টিন ট্রুডোকে খুবই জনপ্রিয় ও প্রগতিশীল নেতা হিসেবে দেখা হচ্ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শাসনধারা নিয়ে কানাডার জনগণের মনোভাব বদলে যেতে শুরু করল। জনগণ তাঁকে ‘বামে’ বেশি ঝুঁকে পড়া নেতা হিসেবে দেখতে শুরু করল। বিশেষ করে, জীবনযাত্রার খরচ বৃদ্ধি ও বাসস্থানের সংকটের জন্য তারা ট্রুডোকে দায়ী করতে শুরু করল।

অনেকের মতে, জাস্টিন ট্রুডোর শিথিল অভিবাসননীতির কারণে দেশে জনসংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল, যার প্রভাব অর্থনৈতিক ও বাসস্থানসংকটের ওপর পড়েছিল। কোভিড মহামারিও জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তার জন্য ক্ষতিকর ছিল। এ সময় তাঁর সরকারের করণীয় ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা বাড়ে। পাশাপাশি রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি ও ট্রুডোর ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যা (যেমন তাঁর স্ত্রী থেকে আলাদা হওয়া) তাঁর ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

যদিও জাস্টিন ট্রুডো ও তাঁর পরিবার ঘিরে অনেক সমালোচনা হয়েছে এবং তাঁর শাসনকালের শেষে জনপ্রিয়তা কমে গেছে; তবে তাঁর কাজগুলো ভুল ছিল না। বরং যে উদ্দেশ্য ও নীতি নিয়ে তিনি কাজ করেছিলেন, সেগুলো কানাডার পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ট্রুডো ও তাঁর বাবার সমর্থিত অনেক নীতি (যেমন প্রগতিশীল মূল্যবোধ, বহুসংস্কৃতিবাদ ও সামাজিক ন্যায়বিচার) এখন কানাডার মূল পরিচয় হিসেবে গণ্য হয়। সুতরাং ট্রুডোকে বিদায় জানানোর আগে তাঁর শাসনকালের সেরা মুহূর্তগুলো পুনরায় স্মরণ করা উচিত।

 সার্জ শমেম্যান নিউইয়র্ক টাইমস–এর সম্পাদকীয় পর্ষদের সদস্য

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877