২০১৬ সালের শেষ দিকে এসে বিশ্ববাসী পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথমবারের মতো একজন নারীকে দেখার পুরো প্রস্তুতিই নিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে যিনি ওই নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন তাকে দেশবাসী তো বটেই, প্রার্থী নিজেও বিশ্বাস করতে পারেননি, তিনি কোনো দিন প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন, তাও আবার আমেরিকার মতো দেশে। অনেকে আছেন দায়িত্ব পেলে নিজেকে শুধরে নেন। পাল্টে ফেলেন নিজেকে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প শোধরাননি। তার এ ধরনের ব্যক্তিত্বে যারা ক্ষুব্ধ, তারা বলেছিলেন, আমেরিকা বলেই সম্ভব হয়েছে ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসা এবং টিকে থাকা। অন্য কোনো সভ্য পশ্চিমা দেশে তা কস্মিনকালেও সম্ভব হতো না।
কিন্তু সেই কস্মিনকালও পেরিয়ে গেছে। ব্রেক্সিটের মারপ্যাঁচে ব্রিটেনের ক্ষমতার মসনদ থেকে একে একে বিদায় নিয়েছেন দুই দুইজন প্রধানমন্ত্রী। ক্ষমতার সেই ব্যাটনটা এখন বরিস জনসনের হাতে। একসাথে দাঁড়ালে যাকে অনেকটা ট্রাম্পের ভাই বলেই মনে হয়। ট্রাম্পের মতো তারও ট্রেডমার্ক জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, অন্যের বিদ্রƒপ, সমালোচনা ইত্যাদি। এমনকি ট্রাম্পের চারপাশে যেমন বিতর্কের হাজারো ইস্যু, বরিসের ক্ষেত্রেও তার কোনো কমতি নেই।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ব্রিটিশদের সামনে যে স্লোগান দিয়েছেন বরিস জনসন, তিন বছর আগে ট্রাম্পের মুখেও শোনা গিয়েছিল প্রায় সেই স্লোগান। ট্রাম্প বলেছিলেন, মেক অ্যামেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন, আর বরিসের স্লোগান, মেকিং ব্রিটেন গ্রেট অ্যাগেইন। প্রধানমন্ত্রিত্বের শপথ নেয়ার পর বরিস বলেন, ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ব্রেক্সিট কার্যকর করাই হবে আমাদের লক্ষ্য, যাতে আমাদের মহান এ দেশকে আমরা ঐক্যবদ্ধ করতে পারি, আবারো শক্তিশালী করে তুলতে পারি এবং এই দেশকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থানে পরিণত করতে পারি।
বরিস জনসন ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এ সময়ের মধ্যেই ইইউর সাথে সম্পর্কচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু করবেন। এ জন্য একটি চুক্তিতে উপনীত হতে পারলে ভালো, না হলে চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিট হবে। তবে ব্রিটেন ও বরিস উভয়ের মিলিত বাস্তবতা বলছে, তিনি এ প্রতিশ্রুতি রাখতে পারবেন না। ওই তারিখের মধ্যে যুক্তরাজ্য হয়তো ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি তার দায়বদ্ধতার বিষয়গুলো বাতিল করতে পারবে, কিন্তু ইইউ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হতে পারবে না। কারণ ব্রেক্সিট নিয়ে বরিসের ক্ষমতাসীন দল এবং পুরো ব্রিটিশ রাজনীতিতে যে বিভেদ, মতানৈক্য চলছে, তাতে অক্টোবরের মধ্যে তিনি তার দেশকে ইইউ থেকে বের করে আনতে পারবেন কি না- তা নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ রয়েছে। আর যদি তা না পারেন, বরিস জনসনের প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ খুবই সংক্ষিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২০০১ সাল থেকে তৎকালীন বিরোধী কনজারভেটিভ পার্টির টিকিটে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন বরিস জনসন। ২০০৮ সালে লন্ডনের মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৬ সালে বেক্সিট গণভোটে হেরে ডেভিড ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রিত্ব এবং দলের নেতৃত্ব ছাড়ার পর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রতিযোগিতায় যোগ দেন বরিস জনসন। তবে থেরেসা মের সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে সরে দাঁড়ান ওই প্রতিযোগিতা থেকে। অবশ্য কনজারভেটিভ পার্টির ব্রেক্সিটপন্থীদের চাপে বরিস জনসনকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করেন মে। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মে ইউরোপীয় কমিশনের সাথে ব্রেক্সিট চুক্তির জন্য যে মীমাংসা করছিলেন তাতে প্রচণ্ড নাখোশ বরিস জনসন ২০১৮ সালের জুলাইতে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু থেরেসা মে যখন ব্রেক্সিট ইস্যুতে দিশেহারা ছিলেন, তখন ৩১ অক্টোবরের মধ্যে প্রয়োজনে কোনো চুক্তি ছাড়াই তিনি ব্রিটেনকে ইইউ জোট থেকে বের করে আনবেন- এ প্রতিশ্রুতি দিয়ে কনজারভেটিভ পার্টির ব্রেক্সিটপন্থী শিবিরে প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন তিনি।
গত ২৩ জুলাইয়ের দলের নেতা নির্বাচনের ভোটের ফলে দেখা যায়, কনজারভেটিভ পার্টির ৬৭ শতাংশ সদস্যের সমর্থন পেয়ে দলের কাণ্ডারি নির্বাচিত হয়েছেন বরিস জনসন। চার দফা ভোটের পর দলের সদস্যরা তাকে নতুন নেতা হিসেবে নির্বাচিত করেন। বরিস জনসন পেয়েছিলেন ৯২ হাজার ১৫৩ ভোট। অন্য দিকে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্ট পেয়েছেন মাত্র ৪৬ হাজার ৬৫৬ ভোট। দেশটির সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতাই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। সেই নিয়ম অনুযায়ী দলের নেতা নির্বাচিত হওয়ার পরদিনই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন বরিস জনসন।
বরিস জনসন এরই মধ্যে বিভিন্নভাবে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। তিনি প্রকাশ্যেই মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভাষণ দেন এবং বর্ণবাদীদের যা ইচ্ছে তাই বলার লাইসেন্স দিয়েছেন। অভিবাসন বিরোধিতায় কট্টর অবস্থান বরিস জনসনের। সেই চিন্তাভাবনা থেকেই তিনি ব্রেক্সিটের পক্ষে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে সফল হলে যুক্তরাজ্য দীর্ঘ দিনের জন্য ট্রাম্পের মতোই একজন কট্টর নেতার নেতৃত্বে চলে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এর আগে টোরি পার্টির যেসব মন্ত্রী বরিস জনসনকে খুব কাছ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে দেখেছেন। তারা মনে করেন, জনসনের আমলে ডাউনিং স্ট্রিটে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে এবং জাতীয় অস্বস্তিতে পড়তে পারে যুক্তরাজ্য।
বিতর্ককে সাথে করে চলা বরিসের ক্যারিয়ারের শুরুটা সাংবাদিক হিসেবে। কিন্তু খবর লিখতে গিয়ে বানিয়ে উদ্ধৃতি দেয়ার অপরাধে বহিষ্কার করা হয় তাকে। রাজনীতিতে আসার আগে থেকেই বহু সম্পর্কে জড়িয়েছেন তিনি। রয়েছে একাধিক অবৈধ সন্তানও। আবার ট্রাম্পের মতো বরিস জনসনও একজন বিভেদ সৃষ্টিকারী বলেই পরিচিত। বিভিন্ন সময় উদ্ভট মন্তব্য করে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে পছন্দ করেন তিনি। ২০০২ সালে ব্রিটেনের পার্লামেন্ট সদস্য থাকাকালে তিনি তার বক্তব্যে কৃষ্ণাঙ্গদের অভিহিত করতে ‘তরমুজের মতো হাসি’, ‘পিক্কান্নিস’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করতেন।
২০১৩ সালে মালয়েশিয়া সফরে গিয়ে দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া ছাত্রীদের ব্যাপারে বলেন, মালয়েশিয়ার নারীরা ভালো স্বামী পাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। ২০১৫ সালে এক বক্তৃতায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে ‘নির্মম ও চিত্তাকর্ষক দৈত্য’ বলে অভিহিত করেন বরিস জনসন। এর আগে যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ায় ব্যবসায়ীদের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, লিবিয়ার সির্তে শহরকে আমি দুবাইয়ের মতো বানাতে পারব। তবে লিবিয়ার প্রশাসনকে শুধু লাশগুলো পরিষ্কার করতে হবে।
তার লেখা দ্য ড্রিম অব রোম বইয়ে ইসলাম সম্পর্কে তিনি বলেন, ইসলামে এমন কিছু ছিল, যা পৃথিবীর কিছু অংশের বিকাশে বাধা দিয়েছে এবং ফলস্বরূপ, প্রায় প্রতিটি দ্বন্দ্বের পেছনেই ‘মুসলিম বিক্ষোভ’ একটি ফ্যাক্টর ছিল। এ ছাড়া গত বছর জনসন টেলিগ্রাফে লেখা এক কলামে বোরকা পরিহিতা মুসলিম নারীদের ‘চিঠির বাক্স’ ও ‘ব্যাংক ডাকাতদের’ সাথে তুলনা করেছিলেন।
সব মিলিয়ে তার ব্যাপারে বিবিসির রাজনীতিবিষয়ক সম্পাদক লরা কুনসবার্গ বলছেন, বরিস জনসন এমন একজন রাজনীতিক যাকে অবজ্ঞা করা অসম্ভব, তার অহমিকামিশ্রিত ব্যক্তিত্বের সাথে পাল্লা দেয়া রাজনীতিকদের পক্ষে দুরূহ কাজ।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বরিস জনসন যেদিন জাতির উদ্দেশে যুক্তরাজ্যকে আবারো মহান করে গড়ে তোলার কথা বলছিলেন, প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন, স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন ওই দিনই লন্ডনের লর্ডসে ঘটে যায় একটি লজ্জাজনক ঘটনা। সদ্যসমাপ্ত ওয়ানডে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া ইংল্যান্ড টেস্ট ক্রিকেটে নবাগত আয়ারল্যান্ডের কাছে নাস্তানাবুদ হয় একেবারে লজ্জাজনকভাবে। ইংলিশদের প্রথম ইনিংস গুটিয়ে যায় মাত্র ৮৫ রানে। বিশ্বকাপ জেতা এবং বরিসের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া উভয়টিই সাম্প্রতিক বিষয় হওয়ায় মোটা দাগে বিষয়টি সবারই নজরে আসে। শুরু হয় তুমুল হাস্যরসের।
তবে এক দিন পরই ঘুরে দাঁড়িয়ে সেই ইংল্যান্ডই কিন্তু ১৪৩ রানের বড় ব্যবধানে আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়েছিল। বরিসও কি শেষ পর্যায়ে ব্রেক্সিটসহ যুক্তরাজ্যের সব সমস্যার সমাধান করে দেশবাসীর মুখে হাসি ফোটাবেন, নাকি ব্রেক্সিট ইস্যুতে ক্ষমতা থেকে নেমে যাওয়া ডেভিড ক্যামেরন ও থেরেসা মের পর তৃতীয়জন হবেন। এ খেলার ফল জানতে অবশ্য খুব বেশি অপেক্ষা করার দরকার নেই। আপাতত এ বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত অপেক্ষা করলেই মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যাবে বরিসের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে।