স্বদেশ ডেস্ক:
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগ ‘আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প’ এবং ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক’ নিয়ে অপতৎপরতা শুরু হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এর নেপথ্যে মদদ দিচ্ছেন ওই প্রকল্পের সাবেক এক পরিচালক। তিনি তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একের পর এক অপপ্রচার ও নেতিবাচক নানা ছবি পোস্ট করছেন।
পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. মিহির কান্তি মজুমদার জানান, ইতোমধ্যে তারা বিষয়টি ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাইবার অপরাধ দমন শাখাকে জানিয়েছেন। অবগত করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কেও।
ড. মিহির কান্তি মজুমদার বলেন, ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইনসহ নানাভাবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রকল্প ও ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে। তাদের ভুল বুঝিয়ে ও মিথ্যা বার্তা দিয়ে রাজধানীতে কর্মসূচিও পালন করানো হয়েছে। যদিও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ, প্রকল্প ও বিধি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এসব বিধান উপেক্ষা করে বাইরে থেকে এনজিওকর্মী ও অন্য ব্যাংক থেকে কর্মী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
এ প্রক্রিয়া বন্ধে উচ্চ আদালতের আদেশ থাকা সত্ত্বেও সম্প্রতি ব্যাংকটিতে প্রায় ১৪৯ জনকে অবৈধভাবে সিনিয়র অফিসার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এমনকি তড়িঘড়ি করে তাদের বিভিন্ন উপজেলায় পদায়নের চেষ্টাও করা হচ্ছে। এর ফলে প্রকল্পে দীর্ঘ আট বছর ধরে এবং পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে ৩ বছর ধরে কাজ করা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া পুরনো কর্মীদের বাদ দিয়ে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে ব্যাংকটিতে সম্প্রতি ৪৮৫ জন ক্যাশ সহকারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদেই তারা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন।
বিষয়টি নিয়ে আমার বাড়ি আমার প্রকল্প ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক কর্মকর্তা কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জসীম উদ্দীন বলেন, আমাদের সব দাবিই যৌক্তিক। আলটিমেটাম দেওয়া ছিল। দাবি যেহেতু মানা হয়নি শিগগিরই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পরবর্তী কর্মসূচি জানানো হবে। একপর্যায়ে তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে টেলিফোনে বক্তব্য নেওয়া নিয়ে চরম দুর্ব্যবহার করেন।
ব্যাংকের মহাপরিচালক আকবর হোসেন বলেন, যারা আন্দোলন করছেন তারা বিচ্ছিন্ন কেউ নয়। আমরা একই পরিবারের। তবে সরকারি চাকরি প্রবিধানের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা তাদের দাবি যথাসময়ে যথাস্থানে অবগত করেছি। ব্যক্তিগতভাবেও বুঝিয়ে বলেছি। তবে এটাও সত্য, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কার্যক্রম বিধি-বিধান এবং আদালতের ১২৯টি সিনিয়র অফিসারের পদ রিজার্ভ রাখার নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে। কিন্তু কে বা কারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে সেটা প্রতীয়মান। একটা মহতী উদ্যোগকে এভাবে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
এদিকে সার্বিক বিষয়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. মিহির কান্তি মজুমদার জানান, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প ৩০ জুন ২০১৬ পর্যন্ত গঠিত ৪০ হাজার ২১৬টি সমিতি ও সেই তহবিল নিয়ে কাজ করছে। প্রকল্প ও ব্যাংকের মধ্যে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী ৩০ জুন ২০১৬-এর আগে প্রকল্পে কর্মরত কর্মচারীদের ব্যাংকের উপযুক্ত পদে স্থানান্তর হওয়ার কথা। সে অনুযায়ী উপজেলা পর্যায়ের ৫ হাজার ৩৬৮ জন কর্মচারীর মধ্যে ৪ হাজার ৭৫৬ জনকে ব্যাংকের বিভিন্ন সমমানের পদে ২০১৮ সালের ১ আগস্ট তারিখ থেকে স্থানান্তর করা হয়েছে এবং এ বছরের ১ জুলাই একটি ইনক্রিমেন্ট মঞ্জুর করা হয়েছে। তাদের পদোন্নতির জন্য একটি নীতিমালাও সরকারের অনুমোদনের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো হয়েছে। নীতিমালাটি অনুমোদিত হলেই পদোন্নতির কার্যক্রম শুরু হবে। অথচ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কর্মীদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে আন্দোলনে উসকানি দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ৪৮৫টি শাখায় বিশিষ্ট পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদের সংখ্যা ৫৫০টি-যার ৫০ শতাংশ পদোন্নতির মাধ্যমে এবং বাকি ৫০ শতাংশ সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণযোগ্য। প্রবিধানের এ নিয়ম প্রশান্ত কুমার রায় যখন প্রকল্প পরিচালক ও ব্যাংকের এমডি ছিলেন তখনই প্রণীত। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি ২৭৬ প্রার্থীকে সিনিয়র অফিসার পদে নিয়োগের সুপারিশ করে। অথচ সাবেক এক কর্মকর্তা তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে এ নিয়োগ নিয়ে অসত্য তথ্য উপস্থাপন করে ব্যাংকের কর্মীদের উসকানি দিয়েছেন।
প্রকল্প থেকে ব্যাংকে স্থানান্তরিত ১২৯ জন উপজেলা সমন্বয়কারী (যারা ব্যাংকে সাধারণ অফিসার হিসেবে স্থানান্তর হয়েছেন) হাইকোর্ট বিভাগে সরাসরি সিনিয়র অফিসার পদে নিয়োগ চ্যালেঞ্জ করে ২টি রিট মামলা করেছেন। হাইকোর্ট বিভাগ সরাসরি নিয়োগযোগ্য সিনিয়র অফিসার পদের মধ্যে ১২৯টি পদ রিজার্ভ রাখার জন্য রুল ইস্যু করায় বাংলাদেশ ব্যাংক সুপারিশকৃত ২৭৮ প্রার্থীর মধ্য থেকে ১২৯টি পদ শূন্য রেখে ১৪৯টি পদে সিনিয়র অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে। অথচ আন্দোলনে উসকানি দিয়ে তাদের পদায়ন বন্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে-যা প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন ও ব্যাংকের টেকসই অস্তিত্বের প্রতি হুমকীস্বরূপ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাবেক ওই আমলা ব্যাংককর্মীদের বিভ্রান্ত করে ধারাবাহিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগ ব্যাহত করছেন। সরকারকে বিব্রত করতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রকল্পকে টার্গেট করেছেন তিনি। এরই অংশ হিসেবে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে কুৎসা রটানো হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী এক বাংলাদেশি এক সময় তার অর্থের জোগানদাতা ছিলেন। কিন্তু এখন ওই প্রবাসীর সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। গোটা বিষয়টি তদন্তে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা মাঠে নেমেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গ্রামের প্রতিটা বাড়িকে উৎপাদনমুখী খামারে রূপান্তরে ২০০৯ সালে ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প’ গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৯-২০১৩ সাল মেয়াদি প্রকল্প পরবর্তীতে জুন ২০১৬ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। এর অধীনে ৪০ হাজার ২১৫টি সমিতির মাধ্যমে সংগঠিত প্রায় ২২ লাখ পরিবারে সঞ্চয় প্রবণতা বৃদ্ধি, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং অন্যান্য কর্মসূচিতে দৃশ্যমান অগ্রগতি হওয়ায় প্রকল্পের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরিচালনার জন্য পল্লী সঞ্চয় ব্যংক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পের কার্যক্রমে আরও ৩২ লাখ পরিবারকে সম্পৃক্ত করার জন্য কার্যক্রম সম্প্রসারণ ও মেয়াদ জুন ২০১৬ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।
সঙ্গত কারণেই সংশোধন করা হয় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক আইন। এ সময় প্রকল্পের পাশাপাশি পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কার্যক্রম চালানোর জন্য জুন ২০১৬-এর আগে গঠিত ৪০ হাজার ২১৫টি সমিতির প্রায় ২২ লাখ পরিবার এবং সঞ্চয়, সম্পদ এবং জনবল স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা হয়। সংশোধিত আইনের বিধান অনুযায়ী, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক ও একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মধ্যে ২০১৭ সালের ২২ মার্চ একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। সমঝোতা অনুযায়ী ৪০ হাজার ২১৫টি সমিতির প্রায় ২২ লাখ সদস্য এবং সঞ্চয় ও আবর্তক ঋণ তথা সম্পদ স্থানান্তরিত হয় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে। প্রকল্পের নতুন নাম হয় ‘আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প’।
জানা গেছে, প্রকল্পে কর্মরত ৫ হাজার ৩৬৮ জনবলের মধ্যে ৪ হাজার ৭৫৬ জনকে বর্তমানে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এর মধ্যে উপজেলা সমন্বয়কারী ৩৮৬ জনের মধ্যে ৩৬২ জন, ফিল্ড সুপারভাইজার ৭৪৩ জনের মধ্যে ৭২৭ জন, কম্পিউটার অপারেটর ৩৭৯ জনের মধ্যে ৩৭৪ জন, মাঠ সহকারী ৩ হাজার ৮৩৫ জনের মধ্যে ৩ হাজার ২৬৮ জন ও অন্যান্য পদে ২১ জন স্থানান্তরিত হয়েছেন। অবশিষ্ট ৬১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী শৃঙ্খলাজনিত বিষয় ও অভিযোগ এবং নিম্ন পারফরম্যান্সের কারণে এখনো স্থানান্তরিত হননি। তবে যারা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করবেন, তাদেরও ব্যাংকে স্থানান্তর করা হবে জানান সংশ্লিষ্টরা।