ফিরোজ আহাম্মদ: মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সূরা হুজরাতের ১১ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষকে উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারী অপর কোনো নারীকেও যেন উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না; ঈমানের পর মন্দ নাম অতি মন্দ।’ সূরা হুজরাতের ১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ তোমরা অধিকাংশ অনুমান থেকে দূরে থাক; কারণ অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দাও করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভ্রাতার গোশত খেতে চাইবে?’
পবিত্র কুরআনে গিবত করাকে আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। বর্তমান সময়ে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, অফিস-আদালত থেকে শুরু করে প্রায় সর্বত্রই গিবত ও পরনিন্দার চর্চার প্রতিযোগিতা হয়। আর এ গিবত ও পরনিন্দা একটি মনস্তাত্ত্বিক রোগ। যে রোগ অন্যের ভালো কিছু সহ্য করতে না পারাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়। যার কোন রকম আনুষ্ঠানিক চিকিৎসা বা দাওয়াই নেই। অথচ এই দূরারোগ্য সামাজিক ক্যান্সারকে নিত্যদিনের সঙ্গী বানিয়ে আমরা বেশ ভালো জীবনযাপনের মিথ্যা চেষ্টায় মত্ত রয়েছি। অন্যের সম্পত্তি, বাড়ি, গাড়ি, ভালো চাকরি, ব্যবসায়িক আয়-উন্নতি, রুটি-রোজগার, বিয়ে-শাদি, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সামাজিক অবস্থান দেখে মানুষ মাত্রই মনের মধ্যে কম বেশি হিংসা আসে। পবিত্র কুরআনে সূরা হিজরের ৮৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণিকে ভোগ-বিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি, তার প্রতি তুমি কখনও তোমার চক্ষুদ্বয় প্রসারিত করো না।’ সূরা তা-হা’র ১৩১ নং আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘তুমি তোমার চক্ষুদ্বয় কখনও প্রসারিত করো না তার প্রতি, যা আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণিকে পার্থিব জীবনের সৌন্দর্যস্বরূপ উপভোগের উপকরণ হিসেবে দিয়েছি, এটা দ্বারা তাদের পরীক্ষা করার জন্য।’
আমাদের সমাজে দেখা যায়, যখন প্রতিবেশী কেউ বাড়িঘর নির্মাণসহ বিভিন্ন কাজ-কর্মে সাফল্য অর্জন করেন, তখন নিজের কাজ-কর্ম রেখে অন্যের গিবত ও পরনিন্দায় ব্যাকুল হয়ে পড়ি আমরা। এ ছাড়া কম বেশি আমরা সকলে কুৎসা রটাতে পছন্দ করি। পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের অসঙ্গতি ও বিশৃঙ্খলার মূলে রয়েছে হিংসা, গিবত ও পরনিন্দা চর্চা। অথচ হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : তোমরা একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করো না, পরস্পর হিংসা করো না, পরস্পর বিরুদ্ধাচারণ করো না। তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা। তোমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে থাকো। কোনো মুসলিমের জন্য তিন দিনের অধিক তার ভাইকে পরিত্যাগ করে থাকা জায়েজ নয়।
হজরত আবু হোরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হজরত রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘তোমরা অনুমান থেকে বেঁচে থাকো। কারণ অনুমান বড় মিথ্যা ব্যাপার। আর কারো দোষ অনুসন্ধান করো না, গোয়েন্দাগিরি করো না, একে অন্যকে ধোঁকা দিও না, আর পরস্পর হিংসা করো না।’ অথচ আমরা প্রতিনিয়তই অন্যের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। অফিস আদালতেও দেখা যায় কিছু সহকর্মী থাকেন যারা নিজেকে নির্দোষ ভাবেন এবং ক্যান্টিনে কিংবা অফিসের বারান্দায় অন্য সহকর্মীর গিবত করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সহকর্মীর সামনে পেছেন নিজের অযোগ্যতাকে ঢাকতে গিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট অকপটে অপপ্রচার চালিয়ে যান। সমাজের অসংগতি দূর করতে হলে এবং পরকালে নাযাত পেতে হলে ব্যক্তি পর্যায়ে কিম্বা গোষ্ঠীগতভাবে হিংসা পরনিন্দা চর্চা থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে। শুক্রবারের জুমার আলোচনায় হিংসা গিবত সম্পর্কে কোরআন হাদিস ভিত্তিক আলোচনার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। যে সব জায়গায় তাফসিরুল কোরআনের মাহফিল হয় সেখানেও হিংসা, গিবত ও পরনিন্দার উপর বয়ান কিম্বা আলোচনা বাড়াতে হবে।
ইসলামের ইতিহাসে ধিকৃত আবু জাহেল জানতো এবং মনে মনে বিশ্বাসও করতো, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (স) আল্লাহর প্রেরিত রসƒল। ফেরাউন জানতো এবং মনে মনে বিশ্বাসও করতো যে হযরত মুসা (আ) আল্লাহর প্রেরিত নবী। আবু জাহেল ও ফেরাউন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, হে আল্লাহ তুমি স্পষ্টত জান আমরা সমাজের নেতা। আমাদেরকে নবী না বানিয়ে হজরত মোহাম্মদের (সা.) মতো এতিম দুর্বলকে কেন নবী হিসেবে পাঠিয়েছ। হজরত মুসার (আ.) মতো দুর্বলকে কেন নবী হিসেবে পাঠিয়েছ। দেখুন, এখানেও তাদের বিদ্বষের মূলে ছিল হিংসা। তওবা-আস্তাগফিরুল্লাহ। আসুন, আমরা সকলে নিজের দোষ অন্বেষণে বেশি মনোযোগী হই। হিংসা, গিবত পরিহার করি।
লেখক: সুফিবাদ গবেষক।