স্বদেশ ডেস্ক:
ইভ্যালির পর আরও নয়টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযানে নামছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট। বিভিন্ন অফারের নামে প্রতারণা ও আর্থিক জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগে আলোচনায় আসা এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলা হয়েছে। এরই সূত্র ধরে প্রথমে ইভ্যালির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে র্যাব। পর্যায়ক্রমে নানা অনিয়ম-অপরাধে জড়ানো অন্য ই-কমার্স সাইটগুলোর বিরুদ্ধেও অভিযান চালাবে পুলিশ-র্যাব। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে, র্যাবের পাশাপাশি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এবং ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযানে নামছে।
সূত্র জানায়, এখন থেকে বিভিন্ন অভিযানে যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলার পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও মামলা ও তদন্ত করা হবে। এসব প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অপরাধ করায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করার কথা বলছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ ছাড়া প্রযোজ্য ক্ষেত্রে মানিলন্ডারিংয়ের মামলাও করা হবে।
বিভিন্ন অফারের ফাঁদে ফেলে গ্রাহকদের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অফারের নামে বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে অথবা অর্ধেক দামে পণ্য বিক্রির নামে প্রতারণা করে আসছে। এ ছাড়া অগ্রিম টাকা নিয়েও সময়মতো পণ্য সরবরাহ করছে না এসব প্রতিষ্ঠান।
জানতে চাইলে সিআইডির প্রধান ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, এ ধরনের বেশকিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আমরা অনুসন্ধান করেছি। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির কিছু বিষয় তারাও দেখভাল করে।
চটকদার ছাড়ের মাধ্যমে সারাদেশে বিপুল পরিমাণ গ্রাহক তৈরি করে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ শুরু করে ইভ্যালি। প্রতিষ্ঠানটির এমডি রাসেলকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব জানায়, বিদেশি একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় অফারের আলোকে ইভ্যালির কার্যক্রম শুরু করেন রাসেল। বর্তমানে এর গ্রাহকসংখ্যা ৪৪ লাখের বেশি। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইভ্যালির দায় ছিল ৪০৩ কোটি টাকা, যেখানে প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ কেবল ৬৫ কোটি টাকা। বিভিন্ন সংস্থায় প্রকাশিত বিপুল এই দেনার বিষয়ে র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে প্রতিষ্ঠানটির এমডি ও সিইও রাসেল কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি; বরং জিজ্ঞাসাবাদে তিনি এ দেনার পরিমাণ আরও বেশি, ‘প্রায় হাজার কোটি টাকা’ বলে জানিয়েছেন। দায় বাড়ার একপর্যায়ে ইভ্যালিকে দেউলিয়া ঘোষণার পরিকল্পনা করছিলেন রাসেল।
এ ছাড়া ধামাকা শপিংয়ের মালিকপক্ষ গ্রাহকের ৫৯৮ কোটি টাকা নিয়ে দেশ ছেড়েছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ১১৭ কোটি টাকা পাচারের ‘প্রমাণ পেয়েছে’ সিআইডি। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএমডি জসিম উদ্দিন চিশতিসহ তার স্ত্রী ও তিন সন্তান এবং ধামাকা শপিংয়ের এক পরিচালক এবং চারটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে তারা। ই-অরেঞ্জের মালিকপক্ষ প্রতারণামূলকভাবে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমানসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ই-অরেঞ্জের মালিকদের একজন বনানী থানার সাবেক পুলিশ পরিদর্শক শেখ সোহেল রানা পালিয়ে দেশ ছাড়ার পর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফর হাতে গ্রেপ্তার হন।
র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, বেশকিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তাদের বলা হয়েছে। এর মধ্যে ইভ্যালির বিরুদ্ধে মামলা থাকায় আগে এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এ ধরনের অন্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও অভিযান চালানোর কথা জানিয়েছে র্যাব।
র্যাব-পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে। এগুলো হলো- ইভ্যালি, আলেশা মার্ট, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, সিরাজগঞ্জ শপিং, আলাদিনের প্রদীপ, বুম বুম, কিউকম, আদিয়ান মার্ট ও নিডস ডটকম বিডি।
তবে এর মধ্যে ইতোমধ্যে ইভ্যালির এমডি মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে গত বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
সূত্র জানায়, এর আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এই ১০টি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়। ইভ্যালিসহ এই ১০টি ই-কমার্সের সঙ্গে ক্রেডিট, ডেবিট ও প্রি-পেইড কার্ডের লেনদেন বন্ধ করে দেয় বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক। কার্ড ব্যবসায় এগিয়ে থাকা এসব ব্যাংকের মধ্যে কেউ কেউ গ্রাহকদের এসএমএস ও ই-মেইলের মাধ্যমে জানানোর পাশাপাশি নিজস্ব ওয়েবসাইটের নোটিশ বোর্ডেও নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জানায়। কেউ যেন প্রতারণার শিকার না হন, সে লক্ষ্যে নিজ উদ্যোগেই এসব ব্যাংক এমন পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আমাদের সময়কে বলেন, পর্যায়ক্রমে বেশকিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে। ইভ্যালির বিরুদ্ধে মামলা থাকায় প্রতিষ্ঠানটির এমডি ও চেয়ারম্যানকে আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিকে, র্যাবের পাশাপাশি সিআইডি ও ডিবি এ ধরনের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযানে নামছে। সিআইডি ইতোমধ্যে এ ধরনের বেশকিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে। অনুসন্ধান শেষে একটি তালিকাও প্রস্তুত করেছে সিআইডি। অনুসন্ধানে দালাল প্লাস নামে একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার তথ্যও উঠে এসেছে।
এদিকে ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জের মতো প্রতারক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) একেএম হাফিজ আক্তার। গতকাল শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান।
সংবাদ সম্মেলনে হাফিজ আক্তার বলেন, ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জসহ এমন আরও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা প্রতারণা করেছে। বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে পণ্য বিক্রির অফার দিয়ে যারা গ্রাহকদের পণ্য দেয় না, তারা মূলত প্রতারণা করছে। এসব বিষয়ে তদন্ত চলছে, তদন্ত শেষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কাজ করছে। এ ধরনের প্রতারকদের বেশি বেশি ধরা হলে ধীরে ধীরে প্রতারণা কমে আসবে। আমরা চাই সুন্দর একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফরম ফিরে আসুক। দেশে ই-কমার্স প্রসারিত হোক।
প্রতারিতরা টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা এমন প্রশ্নে হাফিজ আক্তার বলেন, আমাদের কাজ প্রতারণা ঘটলে তাদের আইনের আওতায় আনা। কেউ প্রতারিত হলে বা টাকা দিলে সেগুলো ফেরত পাবে কিনা এটি বিচার বিভাগের বা আদালতের বিষয়। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি আদালতে প্রমাণসহ উপস্থাপন করলে সে বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত দেবেন।