বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪১ পূর্বাহ্ন

জামায়াত সঙ্গ ত্যাগে বিএনপির পিছুটান

জামায়াত সঙ্গ ত্যাগে বিএনপির পিছুটান

স্বদেশ ডেস্ক:

কয়েক মাস আগে বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্ক ছেদের গুঞ্জন উঠেছিল। তা নিয়ে অল্পবিস্তর আলোচনাও চলে কিছু দিন। কিন্তু এখন সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে বিএনপি। পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আবারও একাট্টা হয়েছে দলটি। নীতিনির্ধারকরা বলছেন, দেশ-বিদেশে রাজনৈতিক নানা মেরুকরণের কারণেই জোট ছাড়া করার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেছেন তারা।

বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, আফগানিস্তানের ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে নেওয়া তালেবানদের ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্বসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ও সংস্থাগুলো নিয়মিতই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, বৈঠকও করছে। এ বিষয়টি সামনে এনে বিএনপিও মনে করছে, ধর্মীয় রাজনীতিতে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা দোষের নয়। সম্পর্ক ছিন্ন করলে বরং জামায়াতকে চাপে রেখে বিএনপির বিরুদ্ধেই কাজে লাগাবে সরকার। বিএনপি তাই সরকারকে সেই সুযোগ দিতে চায় না। তা ছাড়া সামনে সরকারবিরোধী আন্দোলনের যে ছক তৈরি করছে ২০-দলীয় জোট, সেটি সফল করতে জামায়াতকে সঙ্গে রাখা জরুরি। এ বিষয়ে পরামর্শ করে করণীয় ঠিক করতে চায় বিএনপি।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি ও জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতা গত শনিবার রাজধানীর উত্তরায় একান্তে দীর্ঘ আলোচনায় বসেছিলেন। ওই বৈঠকের পর দিন গত রবিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে একমঞ্চে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল

ইসলাম আলমগীর ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরোয়ার বক্তব্য রাখেন। সেখানে উভয় নেতাই সরকার পরিবর্তনে আন্দোলনের ওপর জোর দেন। জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা জানান, খালেদা জিয়া নেতৃত্বে থাকাকালে বিএনপি জোটের বাইরে যাবে না জামায়াত। কেননা বিরোধী রাজনৈতিক জোটের চরম এই দুঃসময়ে জোট ছেড়ে গেলে দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও জামায়াতকে বাঁকা চোখে দেখবে।

জানতে চাইলে ২০-দলীয় জোটের প্রধান সমন্বয়ক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান আমাদের সময়কে বলেন, ‘জামায়াত আমাদের সঙ্গে আছে এবং থাকবে।’ আর জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল- দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা? এর জবাবে আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘আমাদের সম্পর্ক সব সময়ই ঘনিষ্ঠ।’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহাজাহান আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমাদের দলের মহাসচিব সম্প্রতি বলেছেন- সরকার হটাতে গণঅভ্যুত্থান ছাড়া বিকল্প নেই। তার এ বক্তব্যে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের চিন্তার বহির্প্রকাশ ঘটেছে। এটিকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। সে জন্য কাউকে বাদ দিয়ে নয়; ডান-বামসহ সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক শক্তিকে একত্রিত করেই কাজ করতে হবে।’ বৃহত্তর এই জোটের শরিক লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) একাংশের মহাসচিব শাহাদাৎ হোসেন সেলিম আমাদের সময়কে বলেন, ‘জোটের দলগুলোর মধ্যে মান-অভিমান থাকলেও সম্পর্ক ছিন্নের মতো ঘটনা ঘটেনি। বরং দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিকালে জোট নেতাদের ঐক্যবদ্ধ আলোচনাতেই সব সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ধর্মীয় রাজনীতির ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না করে বরং সংশ্লিষ্ট দলগুলোর বিভিন্ন কার্যক্রমে সমর্থন দিচ্ছে বিএনপি। সম্প্রতি হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যুর পর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শোক বাণী দেন। দলের স্থায়ী কমিটিতেও তার সেই শোক প্রস্তাব পাস করা হয়। তবে বাবুনগরীর জানাজায় দলের একটি প্রতিনিধি দল অংশ নিলে সেটি আরও ভালো হতো বলে মনে করেন বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা।

বিএনপির অপর এক নেতা জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক দেওয়ায় সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়া থেকে পশ্চিমা বিশ্ব সরে দাঁড়ায় বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। এর পর থেকে জামায়াত বিষয়ে দলের তৃণমূল ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মতামত নেন তারেক রহমান। সর্বশেষ এক বছর আগে স্থায়ী কমিটির সদস্যদেরও মতামত নেন তিনি। দুই-একজন ছাড়া বাকি সবাই জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার বিষয়ে মত দেন। এর পর গুলশানে গত বছর ঈদের শুভেচ্ছাবিনিময় করতে গেলে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা এই মতামত জানান। জবাবে খালেদা জিয়া জামায়াত সঙ্গ ত্যাগের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আরও ভাবার পরামর্শ দেন নেতাদের।

এ অঞ্চলের রাজনীতি বিশ্লেষণ করে বিএনপির এক নেতা জানান, জামায়াতের সঙ্গে তার দলের সম্পর্ক কখনই ছিন্ন হবে না। তার মতে, ‘বিএনপি ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী এবং ভারতবিরোধী মনোভাবের কারণে ভোটারদের কাছে জনপ্রিয়। খালেদা জিয়াও জামায়াত ছাড়ার ব্যাপারে কখনই সায় দেননি। জামায়াত ছাড়ার পর বিএনপি কী করবে? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর কিন্তু কারও কাছেই নেই।’ বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, ‘কয়েক মাস ধরে দ্রুতই পরিবর্তন ঘটছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির পটভূমি। ভারতের সঙ্গে সরকারের কয়েকটি বিষয়ে দ্বিমতের কথা শোনা গেলেও দুপক্ষের সম্পর্ক এখনো বেশ দৃঢ়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে চীন। সরকারের সঙ্গে তাদেরও বেশ সখ্যতা বেড়েছে। তবে চীনের সঙ্গে ভারতের বৈরীভাব কারও অজানা নয়। অন্যদিকে ভারত বিরোধিতার কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের বন্ধুত্ব অনেক পুরনো। আবার পাকিস্তানের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে জামায়াতের সম্পর্ক গভীর, বিএনপির সঙ্গেও সুসম্পর্ক আছে দেশটির।’

এমন প্রেক্ষাপটে গত ২২ জুলাই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টেলিফোনে আলাপের পর বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা নড়েচড়ে বসেন। হঠাৎ শেখ হাসিনার সঙ্গে ইমরানের ফোনালাপ ও আম কূটনীতি কেন? এর কারণ অনুসন্ধানে নামেন বিএনপির আন্তর্জাতিক উইংয়ের দায়িত্বশীলরা। সব বিশ্লেষণ করে দলটির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, জামায়াতের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক। বিএনপিও তাদের মিত্র। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের ভারতপ্রীতির কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সম্পর্ক কখনই দৃঢ় হবে না- এটি নিশ্চিত। বরং বিএনপি ও জামায়াতকে একমঞ্চে আনার জন্য অতীতে পাকিস্তান কাজ করেছে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু একজন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশ অন্তরঙ্গ। বর্তমান ভূ-রাজনীতির বিষয়ে মিন্টু বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য কোনো কারণে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হলেও সরকারবিরোধী আন্দোলনে দুদলের পথ হবে অভিন্ন।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত তখনকার ক্ষমতাসীন দল বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। কিন্তু তারা জোটে ছিল না। আওয়ামী লীগ যেদিন হরতাল দিয়েছিল, একই দিনে জামায়াতও হরতালের ডাক দিত।’

পাকিস্তানের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্কের বিষয়ে তার বিশ্লেষণ, ‘গত কয়েক বছর ধরেই চীনের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের সম্পর্ক ভালো বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু তখন তো পাকিস্তানের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক খুবই বৈরী ছিল। আবার চীন ও পাকিস্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা কারও অজানা নয়। সুতরাং ইমরানের একটি ফোনালাপে কিংবা আম কূটনীতির কারণে সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভালো হয়ে গেছে, তা বলা যাবে না। এটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের বিষয় আছে। তবে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে ভারতকে কোণঠাসা রাখতে চাইবে চীন- এটিও সবার জানা। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের ভালো সম্পর্ক হলে তা এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্ক হবে, যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন।’

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877