শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৭:৫৩ অপরাহ্ন

ব্যাংকের মুনাফায় শুভংকরের ফাঁকি

ব্যাংকের মুনাফায় শুভংকরের ফাঁকি

স্বদেশ ডেস্ক:

ব্যাংকগুলোর মুনাফায় শুভংকরের ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। প্রচলিত নিয়মের আওতায় সুদ আদায় না করেও সেগুলো আয় খাতে দেখানো হয়েছে। খেলাপি ঋণকে নিয়মিত হিসাবে দেখানো হয়েছে।

খেলাপি ঋণের বিপরীতে যথাযথ প্রভিশন সংরক্ষণ না করে সেই অর্থকে মুনাফা হিসাবে দেখানোর নজির রয়েছে। এভাবে ফুলেফেঁপে মুনাফা দেখানো হলেও বাস্তবে অর্জিত মুনাফার পরিমাণ খুবই কম।

অথচ করোনার মধ্যে ঋণ আদায়ে বড় ধরনের ছাড় দেওয়া হলেও চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ব্যাংকগুলো রেকর্ড পরিমাণ পরিচালন মুনাফা করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলোর আয়ের বড় অংশই আসে সুদ খাত থেকে। এর বাইরে থেকে আসে খুবই কম। ২০১৮ সালের চেয়ে ২০১৯-এ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নিট সুদ আয় বেড়েছিল সাড়ে ৯ শতাংশ।

২০১৯-এর চেয়ে ২০২০ সালে এ খাতে আয় তো বাড়েইনি, উলটা কমেছে ২৯ দশমিক ১ শতাংশ। তবে আলোচ্য সময়ে সুদবহির্ভূত খাত থেকে ব্যাংকগুলোর আয় বেড়েছে। তারপরও মোট আয় কমেছে। ২০১৮ সালের চেয়ে ২০১৯-এ মোট আয় বেড়েছিল প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ।

২০১৯-এর চেয়ে ২০২০ সালে মোট আয় কমেছে প্রায় আড়াই শতাংশ। সুদ থেকে নগদ আদায় না করেই কাগজে-কলমে আদায় করে ব্যাংকগুলোর এ অবস্থা। তারপরও চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা অর্জিত হয়েছে।

করোনার কারণে গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ব্যাংকগুলোর ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত করা হয়েছে, যা চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্নভাবে বহাল থাকবে। ফলে গত বছর ব্যাংকগুলো ঋণের বিপরীতে নগদ কোনো সুদ বলতে গেলে আদায় করতে পারেনি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ঋণ নিয়মিত থাকলে এর বিপরীতে যে সুদ আসে, তা নগদ আদায় না হলেও ব্যাংক আয় খাতে নিতে পারে। তবে ঋণখেলাপি হয়ে গেলে সে সুদ আয় খাতে নিতে পারে না। ওই সুদ স্থগিত হিসাবে রাখতে হয়। গত বছর ব্যাংকগুলো সুদ খাতে আয় দেখিয়েছে ৯০৮ কোটি টাকা।

সুদবহির্ভূত খাত থেকে ২০১৮-এর চেয়ে ২০১৯ সালে আয় বেড়েছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০-এ বেড়েছে সাড়ে ২৪ শতাংশ। ২০১৯ সালে সুদবহির্ভূত আয় হয়েছিল ৩০০ কোটি টাকা। গত বছর আয় হয়েছে ৩৭৩ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, পরিচালন মুনাফা ব্যাংকগুলো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখাতেই পছন্দ করে। এতে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা বিভ্রান্ত হয়। ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা থেকে করপোরেট কর প্রদান, মূলধন, প্রভিশন সংরক্ষণ করে যে নিট মুনাফা থাকে, তা থেকে লভ্যাংশ বিতরণ করা হয়। ফলে অনেক ব্যাংক মোটা অঙ্কের পরিচালন মুনাফা করলেও এসব দায় মিটিয়ে নিট মুনাফা থাকে না বা কম থাকে। ফলে তারা লভ্যাংশ দিতে পারে না।

এ কারণে ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা প্রকাশ থেকে বিরত থাকা উচিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে দেখা যায়, অনেক ব্যাংক আয় বাড়াতে খেলাপি হওয়ার যোগ্য ঋণকে খেলাপি হিসাবে না দেখিয়ে নিয়মিত হিসাবে দেখায়। ফলে ওই সুদ আয় খাতে নিয়ে যায়। ২০১৯ সালে এমন প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এদিকে ঋণের বিপরীতে ঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। নিয়মিত ঋণের বিপরীতে ১ থেকে ২ শতাংশ। খেলাপি ঋণের তিনটি শ্রেণি রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে নিম্নমান ঋণে ২০ শতাংশ, দ্বিতীয় পর্যায়ে সন্দেহজনক ঋণে ৫০ শতাংশ এবং শেষ পর্যায়ে মন্দ ঋণে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়।

নিয়মিত ভোক্তাঋণের বিপরীতে ৫ শতাংশ প্রভিশন রাখার কথা। সেটিকে ২০২০ সালের অক্টোবরে কমিয়ে ২ শতাংশ, গৃহঋণে ১ শতাংশ করা হয়। গৃহঋণে আগে ২ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখার নিয়ম ছিল। প্রভিশন সংরক্ষণের হার কমানোর ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণের বিপরীতে ঝুঁকি বেড়েছে।

কেননা ঋণখেলাপি হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। প্রভিশন না থাকলে খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের কাছে কোনো তরল (সহজে নগদায়নযোগ্য) সম্পদ থাকে না। ব্যাংকিং খাতে গত মার্চ পর্যন্ত প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। ১১টি ব্যাংকে প্রভিশন ঘাটতি আছে। তবে কিছু ব্যাংকে উদ্বৃত্ত হয়েছে।

কেন্দ্রীয় প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ এ ব্যাংক খাতে নিট মুনাফা কমেছে ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১৮ সালের চেয়ে ২০১৯-এ ব্যাংক খাতে নিট মুনাফা বেড়েছিল ৯৪ দশমিক ৩ শতাংশ। করোনার প্রভাবে এক বছরের ব্যবধানে নিট মুনাফা এক শতাংশও বাড়ানো সম্ভব হয়নি। উলটা আগের চেয়ে নেতিবাচক হয়েছে।

সূত্র জানায়, ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে আদায় অযোগ্য মন্দ ও সন্দেহজনক ঋণের হার বেড়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন রাখার চাহিদাও বেড়েছে। নিম্নমানের ঋণ কমেছে। অথচ এসব ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হয় ২০ শতাংশ। আর সন্দেহজনকে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ ঋণে শতভাগ প্রভিশন রাখার বিধান রয়েছে।

করোনাকালে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সহায়তায় বড় ছাড় দিয়ে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের সক্ষমতা বাড়ানো হলেও বাস্তবে ঋণপ্রবাহ বাড়েনি। ২০১৯ সালে ব্যাংকগুলো মোট আমানতের ৭৭ দশমিক ৩ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে। ওই বছর তাদের সক্ষমতা ছিল আমানতের ৮৫ শতাংশ।

এখন আমানতের ৮৭ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারে। ইসলামি ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগসীমা ৯০ থেকে বাড়িয়ে ৯২ শতাংশ করা হয়। এতে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা বাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু মাত্র ১৪টি ব্যাংক ওই সীমার চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণে সক্ষম হয়েছে। বাকি ব্যাংকগুলো তা পারেনি। গড়ে ৭২ দশমিক ২ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে, যা ২০১৯ সালের চেয়ে সাড়ে ৪ শতাংশ কম।

আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নগদ অর্থ বা ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও ছাড় দিয়েছে। দুই সাপ্তাহিক ভিত্তিতে ৫ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ এবং দৈনিক ভিত্তিতে সাড়ে ৪ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৩ শতাংশ নির্ধারণ করেছে।

এতে বাংলাদেশ ব্যাংকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জমা টাকার মধ্যে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা বাজারে এসেছে। এভাবে ঋণ বিতরণের সক্ষমতা বাড়ানো হলেও প্রকৃতপক্ষে ঋণ বিতরণ বাড়েনি। ফলে ব্যাংকগুলোর আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877