শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ১০:১২ পূর্বাহ্ন

হিমালয়ের শৈবতীর্থ কেদারনাথ শৃঙ্গ…….

হিমালয়ের শৈবতীর্থ কেদারনাথ শৃঙ্গ…….

মার্জিয়া লিপি: বছর কয়েক আগের কথা। ভারতভ্রমণে গন্তব্য ছিল দেরাদুন, সিমলা, নৈনিতাল, দিল্লি। হাওড়া থেকে যাত্রা করে দুন এক্সপ্রেসে দুই দিন দুই রাত কাটানোর পর তৃতীয় দিনে সূর্য হঠাৎই বলল, হিমালয়ের ট্রেকিং করব কি না? পাহাড়ে ২৮ কিলোমিটার হাঁটতে পারব কি না? সে-সময় অবধি ট্রেকিংয়ের কোনো পূর্বপ্রশিক্ষণ ছিল না। আমার ৩০ বছরের জীবনে তখনো পাহাড়ে হাঁটার অভিজ্ঞতা কেবল মাধবকু- আর সীতাকু-ের চন্দ্রনাথ মন্দিরে। হাওর এলাকায় বাড়ি হওয়ার কারণে শুকনা মৌসুমে সদর জেলার বাড়ি থেকে গ্রামের বাড়ি আসা-যাওয়ার জন্য কয়েক কিলোমিটার হাঁটতে হয়; কিন্তু সেটা পাহাড়ে নয়, সমতলে। সে অভিজ্ঞতা আর আত্মবিশ্বাসকে সম্বল করে সূর্যকে প্রশ্ন করলাম, ২৮ কিলোমিটার হাঁটলে কী পাবো? উত্তরে শুনলাম ‘হিমালয়’।
কল্পনার চোখে ভেসে উঠলশাদা বরফের শৃঙ্গ হিমালয় আর শেরপাদের ছবি। এর আগে দিব্যচোখে কাঞ্চনজঙ্গাকে দেখেছিলাম দার্জিলিংয়ে। সেখানে প্রতিষ্ঠিত তেনজিং নোরগের মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে গত ট্যুরে কিছুটা সময় কাটিয়েছিলাম। তখন ইচ্ছে হয়েছিল, নিজের মনে মনে ভাবছিলাম, একটু আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠব কি না? চেষ্টা করে দেখব নাকি, শেরপাদের মতো পাহাড়ে যেতে পারি কি না?
১৯৫৪ সালে ভারতের দার্জিলিংয়ে তেনজিং নোরগের মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়। পর্বত আরোহণে উৎসাহ ও প্রশিক্ষণের জন্য তেনজিং নোরগে ও এডমন্ড হিলারির আগ্রহে ভারতে প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহেরু হিমালয় পর্বতারোহণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। দুঃসাহসিক পর্বত আরোহণের মৌলিক ও উচ্চতর ব্যবহারিক বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই ইনস্টিটিউট। এভারেস্ট বিজয়ী তেনজিং নোরগে ছিলেন এ ইনস্টিটিউটের প্রথম প্রশিক্ষণ ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। সূয্যের্র হিমালয়ে ট্রেকিংয়ের প্রস্তাবে এত কিছু না ভেবেই ঝোঁকের মাথায় অবশেষে রাজি হয়ে গেলাম। একটু দুশ্চিন্তা আর পিছুটান ছিল কলকাতা থেকে করে নিয়ে আসা সিমলা, নৈনিতাল আর দিল্লির রিটার্ন টিকিটগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে।
ভাবনার জাল ছিন্ন হলো একসময়। ঘণ্টাখানেক পর অবশেষে শিবালিক পাহাড়ের পাদদেশে হরিদ্বারে পৌঁছালাম। হরিদ্বারের পুরনো পরিচয় মায়াপুরী নামে। এখান থেকেই গঙ্গার সমতলে যাত্রা শুরু হয়েছে।
পবিত্র হিন্দুতীর্থ হরি ও হরের সহাবস্থান ঘটেছে হরিদ্বারে। গঙ্গাই হরিদ্বারের মূল আকর্ষণ। অতীতে নাম ছিল গঙ্গাদ্বার। পাহাড় থেকে গঙ্গা নামছে সমতলে, হরিদ্বারের ‘হরি কি পাউরি’ ঘাটে। বিশ্বাস করা হয় গঙ্গাস্নানে সব পাপ ক্ষয় হয়। পূর্বে চ-ী পাহাড়, পশ্চিমে মনসা পাহাড় রয়েছে হরি কি পাউরিকে কেন্দ্র করে। তীথযাত্রী আমি, সূর্য আর কলকাতার দুজনের গন্তব্য উত্তর প্রদেশের হিমালয় শৈবতীর্থ কেদারনাথ শৃঙ্গ। দুপুরে হিমালয়ের ট্রেকিংয়ের প্রস্তুতি হিসেবে মনসামঙ্গল পাহাড়ে চার ঘণ্টার ট্রেকিং শেষ করি।
সন্ধ্যায় হরি কি পাউরি ঘাটে ৯৯৯টি ফুল, প্রদীপ দিয়ে সাজানো পাতার ভেলায় মঙ্গলারতির কথা এখনো স্মৃতিতে রয়েছে। হরিদ্বারে স্টেশনে রিটার্ন টিকিট ফেরত দেওয়ার সময় কলকাতার দাদাদের কাছে ধরা পড়লাম। বিস্মিত হওয়ার পালা। পাসপোর্টের নাম দেখে বুঝে গেলÑ আমরা দুজন তীর্থ সহযাত্রী, হিন্দু নয়, মুসলিম ভোর ৫টায় রওনা হলাম শৈবতীর্থ হিমালয় শৃঙ্গের উদ্দেশে। কাঁধে হ্যাভারস্যাক, হাতে স্পাইক লাগানো লাঠি আর হঠাৎ ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উইন্ডসর। কেদারশৃঙ্গের পাদদেশে মন্দাকিনী নদীর কূলে, গাড়োয়াল হিমালয়ে ১২,৮৬৬ ফুট উঁচুতে কেদারনাথের মন্দির। সে-সময় ছিল অক্টোবর মাসের ১৯ তারিখ। দেয়ালীর পর ২৫ তারিখে মন্দিরের মূর্তিকে সমতল ভূমি উখিমঠে অধিষ্ঠিত করা হয়। তখন বরফের কারণে বন্ধ হয়ে যায় গৌরীকু-ের যোগাযোগব্যবস্থা।
যাত্রাপথে অপরূপ সৌন্দর্য। কেদারনাথের পথে সবুজ মন্দাকিনী আর শ্বেত অলকানন্দা নদী রুদ্রপ্রয়াগে মিলিত হয়েছে। সঙ্গমে একখ- শিলানাম ‘নারদশিলা’। কথিত আছে, সেখানে শিলায় বসে নারদ তার বীণা বাজাতেন। কেদারনাথ যাওয়ার জন্য হরিদ্বার থেকে ১৩ ঘণ্টা বাস জার্নি করে প্রথমে পৌঁছেছি গৌরীকু-ে। শিবের পার্বতী এখানকার উষ্ণকু-ে স্নান করতেন, তাই এ জায়গার নামকরণ গৌরীকু-।
গৌরীকিংবদন্তি শিবজায়া পার্বতী রিতুস্নানে কু-ে আসেন। গণেশকে পাহারায় রেখে স্নানে যান দেবী। সাধুবেশী শিব গণেশের হাতে বাধা পেয়ে ত্রিশূলাঘাতে মু- কাটেন গণেশের আবার দেবীরই অনুরোধে শিব এক হস্তীমু- এনে জুড়ে দেন গণেশের মু-কাটা ঘাড়ে। প্রাণ পায় গণেশ। নামও হয় সেই থেকে গণপতি। পুরাণে কিংবদন্তি আছে, হিমালয়কন্যা গৌরী শিবকে পতিরূপে পেতে এখানে তপস্যা করেন।
গৌরীকু- থেকে ২৮ কি মি আসা যাওয়া, ট্রেক বা পায়ে হাঁটার পথশৈবতীর্থ কেদারনাথ শৃঙ্গ।
যদিও হেলিকপ্টার, ঘোড়া, ড্যান্ডিঅনেক কিছুর ব্যবস্থা রয়েছে, তবে আমাদের চার জনের ভরসা চরণযুগল। কলকাতার শিবুদার প্রেরণা আমি। তার ভাষায়, ‘একটা মেয়ে মানুষ, তার চোখের সামনে দিয়ে হিমালয়ের শৃঙ্গে যাচ্ছে, আর সে পারছে না; তা কী হয়?’ আমিও পারছিলাম না, তার পরও অনেক কষ্টে এক রকম মনে মনে কাঁদতে কাঁদতে হাঁটছিলাম। পা সাথে আছে কি না বুঝতে পারিনি। গৌরীকু- থেকে ৭ কিলোমিটার যাওয়ার পর রামবাড়াতে যাত্রাবিরতি করলাম। সেখানে অসংখ্য ভেড়ার দেখা মেলল। ভেড়ার আধিক্যের কারণে নাকি এ জায়গার এরূপ নামকরণ। ছোট্ট পাহাড়ি টঙে চা খেলাম শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা বাড়ানোর আশায়। দলনেতা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তিনি জানতেন পাহাড়ে একই গতিতে হাঁটতে হয়। থেমে গেলে স্থিতি জড়তার কারণে চলার গতি শ্লথ হয়ে যায়।
এত উচ্চতায় অক্সিজেন কম তাই নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। বুকের ভেতরে প্রচ- চাপ অনুভব করছিলাম।
কেদারশৃঙ্গের বরফের রূপালি ঝলক, পথের সমস্ত কষ্ট দূর করে দেয়। কেদারনাথ ভারত ইন্দোচীন সীমান্তে অবস্থিত ১,০০০ বছরের পুরনো হিন্দু মন্দিরের প্রধান পবিত্র মন্দির কেদারনাথ। লোকশ্রুতি, পা-বরাই নাকি এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। হিমালয়ের পাদদেশে মন্দাকিনী নদীর আদি পর্যায়ের উৎসস্থলে ভারতের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত। শোনা যায়, গান্ধী সরোবর থেকে মন্দাকিনীর উৎসস্থলের পথেই যুধিষ্ঠির স্বর্গযাত্রা করেন। ১৪,০০০ ফুট উঁচুতে অপার্থিব সৌন্দর্যের লীলাভূমি শ্বেতশুভ্র বরফের গান্ধী সরোবর। গান্ধীজির চিতাভস্ম এখানে বিসর্জিত হয়তাই এ নামকরণ। প্রচ- বৈরী আবহাওয়ার কারণে এই মন্দিরটি শুধু এপ্রিলের শেষার্ধে কার্তিক পূর্ণিমায় শরতের পূর্ণচন্দ্রে উন্মুক্ত হয়। শীতে দেয়ালীর পর মন্দিরের মূর্তিকে সমতল উখিমঠে অধিষ্ঠিত করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, আদি শংকরাচার্য মন্দিরটি নির্মাণ করেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের চতুর্ধামের অন্যতম কেদারনাথ।
গ্রানাইট পাথরের বড় বড় সøাব এই চড়াই-উৎরাইয়ে কিভাবে এত উঁচুুতে আনা সম্ভব হয়েছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। মহাভারতে জানা যায়, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে চাঁদের কলঙ্কের মতো কলঙ্কিত হয়ে পড়েন পঞ্চপা-ব। নিহত স্বজনদের জন্য অনুশোচনায় তীর্থযাত্রা গ্রহণ করেন পঞ্চপা-বরা। মহর্ষি বেদব্যাসের পরামর্শে হিমালয়ে গেলেন পঞ্চপা-ব মহাদেবদর্শনে। শিব পালিয়ে বেড়ান একটি ষাঁড়ের আকার ধারণ করে। গুপ্তকাশী থেকে গৌরীকু-ে পৌঁছে পিছু নেন শিবের। পালের অহংকারী ষাঁড় পায়ের নিচ দিয়ে পার হতে অস্বীকৃতি জানালে পঞ্চপা-ব ভীম শিব বলে সন্দেহ করে মাটির গভীরে প্রোথিত করেন ষাঁড়টিকে। শুধু লেজটি থেকে যায় ভীমের হাতে। এই অংশটিই প্রধানতম কেদার হিসেবে পরিচিত। অবশিষ্ট চারটি অংশ গাড়োয়ালে তুঙ্গনাথ, রুদ্রনাথ, মদমহেশ্বর, কল্পেশ্বর ছড়িয়ে আছে। প্রধান কেদার ও অবশিষ্ট চারটি কেদার নিয়ে পঞ্চকেদারতুঙ্গনাথ, রুদ্রনাথ, মদমহেশ্বর, কল্পেশ্বর। ষাঁড়রূপী শিবের সম্মুখভাগ ছিটকে পড়ে নেপালে পশুপতিনাথে।
৩৮৮৬ মিটার উঁচুতে ভারতের সর্বোচ্চ মন্দির তুঙ্গনাথ। এ মন্দিরে দেবতা মহিষরূপী শিবের বাহু। জনশ্রুতি আছে, তুঙ্গনাথ দর্শনে তীর্থের পূর্ণতা মেলে। ধূসর রঙের পাথরের গুহারূপী রুদ্রনাথ মন্দির। সবুজে ছাওয়া-রঙ-বেরঙের রডোডেনড্রন, নানা রঙের আলপাইন ফুলে শোভিত পথ পেরুতে হয়। শীতে রুদ্রনাথ থেকে দেবতা নেমে এসে আসীন হন গোপেশ্বরে। মদমহেশ্বর নদীও নেমেছে এই পাহাড় থেকে। দীপাবলি থেকে অক্ষয় তৃতীয়ার মদমহেশ্বর মন্দির বন্ধ থাকে। মন্দিরে শিলাস্তূপ মহিষরূপী শিবের জটা কল্পেশ্বর। কল্পেশ্বর সারা বছর ধরে পরিদর্শন করা যায়।
কেদার দর্শনের রাস্তার দু’পাশে গভীর খাদ। হিমালয়ের শাদা বরফে সোনা রঙের রোদের তীব্র ছটায় মনে হয়, যেন পাহাড়ে আগুন ধরে গেছে। খালি চোখে তাকানো যায় না। রোদচশমায় তাকিয়ে দেখছিলাম বরফে সূর্যের তীব্র আলোর প্রতিফলন। অসাধারণ অপার্থিব। প্রতিমুহূর্তে বিমোহিত হয়েছি। পথের নৈসর্গিক দৃশ্য, মন্দাকিনীর সবুজ সুন্দর প্রবাহ, অসংখ্য ঝরনা, পাহাড়ের গা বেয়ে পাথর চিরে ছুটে যাচ্ছে প্রচ- বেগে, কোথাও বা ঝিরঝিরিয়ে। জীবন কী সুন্দর চারপাশের শ্বেতশুভ্র তুষার ওপরে গাঢ় নীল আকাশচারপাশে আশ্চর্য আলো অবাক বিস্ময়ে দেখছিলাম, শাদা বরফের শৃঙ্গ হিমালয়কে, শৈবতীর্থ কেদারনাথ শৃঙ্গকে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877