সোমবার, ২৭ মে ২০২৪, ০১:২১ পূর্বাহ্ন

তিন বছরে সুন্দরবনে বাঘ বেড়েছে ৮টি

তিন বছরে সুন্দরবনে বাঘ বেড়েছে ৮টি

স্বদেশ ডেস্ক:

পৃথিবীতে শত বছর আগেও বাঘ ছিল লাখের বেশি। বর্তমানে সে সংখ্যা ৯৫ শতাংশ কমে ৩ হাজার ৯০০টিতে দাঁড়িয়েছে। তাই প্রাণিটি রক্ষার শপথ নিয়ে ২০১০ সাল থেকে সারা বিশ্বে ২৯ জুলাই পালিত হচ্ছে বিশ্ব বাঘ দিবস। ২০১০ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত টাইগার সামিট ও ২০১৪ সালে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাঘ সম্মেলনে ১৩টি বাঘ সমৃদ্ধ দেশ ২০২২ সালের মধ্যে নিজ নিজ দেশে এর সংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধির চুক্তি করে। অথচ সর্বশেষ ২০১৮ সালের ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘের অস্তিত্ব চিহ্নিত হয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালের জরিপে এই বনে বাঘ দেখা গিয়েছিল ১০৬টি। তিন বছরের ব্যবধানে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ৮ শতাংশ।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের তথ্যমতে, বর্তমানে পৃথিবীর মাত্র ১৩টি দেশে বাঘের অস্তিত্ব বজায় রয়েছে। এ ১৩টি বাঘ সমৃদ্ধ দেশকে বলা হয়- টাইগার র‌্যাঞ্জ কান্ট্রি (টিআরসি)। দেশগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, ভুটান, নেপাল ও রাশিয়া।

দেশের বাঘ গবেষক এবং বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বাঘের চলাচলের এলাকায় মানুষের বিচরণ, চোরা শিকারি, পিটিয়ে হত্যা, বাচ্চা চুরি, ঝড়-বাদলে আশ্রয়স্থলের ক্ষতিসহ নানা কারণে প্রাণীটির স্বাভাবিক বিকাশে বাধা পড়ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বাঘ বিশেষজ্ঞ ড. মনিরুল এইচ খান আমাদের সময়কে বলেন, ‘সুন্দরবনে পরিবেশগত কিছু সমস্যা আছে। কিন্তু বাঘ রক্ষায় প্রথম এবং প্রধান উপায়টি হচ্ছে- চোরা শিকারিদের অপতৎপরতা বন্ধ করা। তা হলেই কেবল ম্যানগ্রোভ বনটিতে বাঘ টিকে থাকবে। নয়তো সেদিন হয়তো খুব বেশি দূরে নয় যে, সুন্দরবন থেকে বাঘ হারিয়ে যাবে।’

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ আমাদের জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগার। তবে বনটির বাংলাদেশ অংশে এর সংখ্যা এক সময় আশঙ্কাজনকভাবে কমতে থাকে। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত দুই দফায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করেন বিশ্ব বন্যপ্রাণী তহবিলের ট্রাস্টি ব্রিটিশ পাখিবিদ গাই মাউন্টফোর্ট। সে সময় বন বিভাগের পক্ষ থেকে তাকে জানানো হয়, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৩০০টি। তবে এ বনে প্রথমবারের মতো বাঘ শুমারি হয় ১৯৭৫ সালে।

একটি বেসরকারি গবেষণায় জার্মান গবেষক হেন রিডসে জানান, সেখানে ৩৫০টি বাঘ রয়েছে। ১৯৮২-৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ পরিচালিত এক জরিপেও সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৩০০টি বলে উল্লেখ করা হয়। ১৯৯৮ সালে নেপালি বংশোদ্ভূত আমেরিকান গবেষক কীর্তি তামাং সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নিয়ে পরিচালিত একটি প্রকল্প শেষে বাঘের সংখ্যা ৩৫০টি বলে উল্লেখ করেন। পরে ২০০৪ সালে একটি জরিপ শেষে বন বিভাগ জানায়, সুন্দরবনে বাংঘের সংখ্যা ৪৪০টি। কিন্তু এ জরিপটিতে তাড়াহুড়া করে তথ্য সংগ্রহের অভিযোগ ওঠে। তাই ২০০৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বাঘ গবেষক ড. মনিরুল এইচ খান ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের মাধ্যমে গবেষণা করে জানান, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা মাত্র ২০০টি। এর পর ২০১০ সালে বন বিভাগ এবং ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ যৌথভাবে পরিচালিত বাঘ শুমারির পর জানায়, বনটিতে বাঘের সংখ্যা ৪০০ থেকে ৪৫০টি।

পাঁচ বছর পর ২০১৫ সালে বন বিভাগ অপর একটি জরিপ শেষে ঘোষণা দেয়, সুন্দরবনে বাঘ রয়েছে কেবল ১০৬টি। তবে ২০১৫ সালের জরিপটিতে অত্যাধুনিক ক্যামেরা ট্রাপিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হলেও আগের প্রায় সবগুলো জরিপই করা হয়েছিল পাগমার্ক (পায়ের ছাপ) পদ্ধতিতে। আবার ২০১৮ সালে আমেরিকার দাতা সংস্থা ইউএসএআইডির অর্থায়নে ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের মাধ্যমে এক গণনায় সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। সে হিসাবে, তিন বছরের ব্যবধানে রয়েল বেঙ্গল বাড়ে কেবল আটটি। এ বিষয়ে ড. মনিরুল এইচ খান বলেন, ‘যদিও এটা ঠিক যে বাঘের সংখ্যা ১১৪টি মানে একেবারে ১১৪টিই, বিষয়টি এমন নয়। তবে ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের মাধ্যমে উঠে আসা সংখ্যাটি মোটামুটি বাস্তব সংখ্যার কাছাকাছি।’ আগামী ২০২২ সালে সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘ গণনা করার কথা রয়েছে।

খুলনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ) ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ‘লকডাউনের মধ্যে পর্যটকদের পদচারণা বন্ধ থাকায় বাঘের বিচারণ লক্ষ করা যাচ্ছে। তাদের প্রজনন ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকায় ইতোমধ্যে বাঘের সংখ্যা আগের তুলনায় বাড়তে পারে বলে ধারণা আমাদের।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাঘ রক্ষায় কয়েকটি কিল্লা করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে যাতে তারা সেখানে আশ্রয় নিতে পারে।’ সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড়ের সময় প্রায় দুদিন সুন্দরবনে পানি জমে থাকায় বাঘদের সমস্যা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

জানা গেছে, গত শতকের নব্বই দশক পর্যন্ত বাঘ কেবল সুন্দরবনের বাওয়ালি বা বনজীবীদের আতঙ্কের কারণ ছিল। কিন্তু চলতি শতকের শুরুর দিকেই বন উজাড়, চোরা শিকারের ফলে হরিণ কমে যাওয়া, নতুন এলাকার খোঁজ বা খাদ্য সংকটে প্রায়ই লোকালয়ে হানা দেয় বাঘ। এদের আক্রমণে বেশ কয়েকজন নিহত ও গৃহপালিত পশু হত্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চোরা শিকারি, বাওয়ালি-বনজীবীদের পাশাপাশি লোকালয়ের মানুষও বাঘ হত্যা করতে শুরু করে।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৪৮টি বাঘ মারা গেছে। এর মধ্যে ২২টি সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগে এবং ১৬টি পশ্চিম বিভাগে মারা যায়। এর মধ্যে স্বাভাবিকভাবে মারা গেছে মাত্র ১০টি বাঘ। বাকি ৩৮টির মধ্যে ১৪টিকে পিটিয়ে মেরেছে স্থানীয় জনতা, ১৩টিকে হত্যা করেছে শিকারিরা এবং একটি বাঘ প্রাণ হারায় ২০০৭ সালের সিডরে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এ সময় বনের ভেতর থেকে ১০টি বাঘের চামড়া ও হাড়গোর উদ্ধার করে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাঘ রক্ষায় বনে স্মার্ট প্যাট্রোল ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। দুই বিভাগ মিলিয়ে চারটি করে আটটি স্মার্ট প্যাট্রোল রয়েছে বর্তমানে। জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনের নদী ও খালে মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। স্মার্ট প্যাট্রোলের পাশাপাশি বন বিভাগের নিয়মিত টহল ও অভিযানও জোরদার করা হয়েছে।

বন বিভাগ বলছে, সুন্দরবনের বাঘ রক্ষায় ‘বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প’ গ্রহণের বিষয়টি সরকারের বিবেচনাধীন। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বয়স ও লিঙ্গ অনুপাতে সুন্দরবনের কম বাঘসম্পন্ন এলাকায় বাঘ স্থানান্তর, ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘ জরিপ, সুন্দরবনে বাঘের প্রধান খাবার হরিণ ও বন্য শূকর জরিপ, বাঘের আপেক্ষিক ঘনত্ব নির্ধারণ, সুন্দরবনের লোকালয় সংলগ্ন এলাকায় নাইলনের রশির বেষ্টনী তৈরি, ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো পরিবীক্ষণ, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ইত্যাদি নানাবিধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। যদিও বন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ‘বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প’ বিবেচনার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও তা ফেরত দেওয়া হয়। তাই কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে এটিকে আবার অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। তিনি আরও জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে সুন্দরবনের মধ্যে আশ্রয়েরে জন্য ৭০টি কিল্লা স্থাপনের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হবে। এ ছাড়া বাঘের খাবার ও আবাসস্থল নিয়ে গবেষণার জন্য পাঠানো হবে বরাদ্দের প্রস্তাব।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877