সোমবার, ২৭ মে ২০২৪, ০১:২৫ অপরাহ্ন

লেখাপড়া থেকে দূরে পথ হারাচ্ছে শিশুরা

লেখাপড়া থেকে দূরে পথ হারাচ্ছে শিশুরা

স্বদেশ ডেস্ক:

শ্রাবণের আকাশে কখন রোদ, কখনো বৃষ্টি- এমন বর্ষা মৌসুমে স্কুলগামী শিশুরা মেতে থাকত তাদের দ্বিবার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে। করোনা মহামারীর কারণে এখন স্কুল বন্ধ। স্কুলে যেতে হয় না, শিশুরা মনে করছে তাদের লেখাপড়াও বন্ধ। বই-খাতা-কলম-পেন্সিল থেকে দূরে থাকতে থাকতে এখন পড়ার টেবিল থেকে টান উঠে গেছে। টেলিভিশন, ট্যাব, স্মার্টফোন, ভিডিওগেম আসক্ত হয়ে পড়েছে অনেক শিশুই। পাড়া-মহল্লার গলিতে সময়ে-অসময়ে আড্ডায় মেতে উঠছে কিশোর বয়সীরা। জড়াচ্ছে সহিংসতায়। গতানুগতিক লেখাপড়ার রুটিন থেকে দূরে সরে সুনাগরিক হওয়ার পথ হারাচ্ছে শিশুরা।

৯ বছর বয়সী সানবিম। রাজধানীর একটি কিন্ডারগার্টেনের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। অভিভাবকের অভিযোগ- স্কুল বন্ধ থাকায় বাসায় বই নিয়ে বসে না। সারাক্ষণ ফোনে গেম খেলে।

বিকালে বাসার গলিতে বন্ধুদের সঙ্গে মোবাইলে গেম খেলে। গত বৃহস্পতিবার খেলার সময় ঝগড়ায় জড়িয়ে এক বন্ধু ইট দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে। রক্তাক্ত সানবিমকে রেখে বন্ধুরা পালিয়ে যায়। প্রতিবেশী একজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। খবর পেয়ে সেখানে যান মা-বাবা। সানবিম তাদের জানায়, বাজি ধরে মোবাইলে একটি গেম খেলছিল চার বন্ধু মিলে। বন্ধু তোহার কথা না শোনায় ক্ষিপ্ত হয়ে সে ইট দিয়ে আঘাত করে।

চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার পঞ্চিম উপলতা গ্রামে গত রবিবার ঘটে বড় দুর্ঘটনা। ফুটবল খেলার মধ্যে ঝগড়ার জের ধরে এক শিশুকে আরও কয়েকজনে মিলে পানিতে চুবিয়ে মারার চেষ্টা করে। কোনো রকম বেঁচে যায় ওই শিশুটি। এ নিয়ে অভিভাবক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে ঝগড়া।

শিক্ষার্থীদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার গ্রামেই বেশি। এখন স্কুল বন্ধ, কোনো কোনো বাবা সন্তানকে নিয়ে যাচ্ছেন তার কাজে সহযোগিতার জন্য। চাঁদপুর সদরের সাখুয়া ইউনিয়নের দিনমজুর শফিকুর রহমান। করোনায় বিধিনিষেধে তার হাতে কাজ নেই। বাড়ির পাশের বিল-ডোবায় জাল দিয়ে মাছ ধরে তা বিক্রি করেই সংসার চালাচ্ছেন। পঞ্চম শ্রেণি পডুয়া ছেলে শহিদের স্কুল বন্ধ, বাড়িতেও পড়তে বসে না। তাই তাকে মাছ ধরতে নিয়ে যান শফিক। তাদের পাশের গ্রামের ছলিম উল্লাহ আখ চাষ করছেন, চারা আখের পাতা ভাঙার কাজে সহযোগিতা করে তার চতুর্থ শ্রেণি পড়–য়া মেয়ে নাসরিন। ছলিম উল্লাহ্ জানান, স্কুল বন্ধ, পড়ালেখা নেই। খেলাধুলা আর মাকে রান্নায়, বাবাকে আখখেতের কাজে সহযোগিতা করেই নাসরিনের সময় কাটে।

করোনা সংক্রমণ শুরুর পর গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। দফায় দফায় সেই ছুটি বাড়িয়ে আগামী ৩১ জুলাই বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে এ ছুটি আরও বাড়তে পারে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী রয়েছে চার কোটি ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ২২৬ জন। স্কুল বন্ধের মধ্যে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। পাঠক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষায় সংসদ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, কমিউনিটি রেডিও এবং অনলাইনে প্রাথমিক মাধ্যমিক স্তরের পাঠদান করা হয়। এ ছাড়া, ক্লাস রেকর্ডিং করে কিশোর বাতায়ন, শিক্ষক বাতায়ন এবং ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। অবশ্য মাধ্যমিকের ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ কার্যক্রম গত বছরের ৩০ জুলাই পর্যন্ত সম্প্রচারের পর বন্ধ রয়েছে। তবে এসব ক্লাস কার্যক্রমে শহরের শিক্ষার্থীরা উপকৃত হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা যুক্ত হতে পারেনি। এরপর সরকার সবার কাছে পৌঁছানোর জন্য ভিন্ন পদ্ধতিতে পাঠ-পরিকল্পনা চালু করে।

গত মঙ্গলবার রাতে মুজিববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ওয়েবিনারে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, শিক্ষার্থীদের করোনার টিকা দেওয়া শেষ হলে দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ১২ দিনের মাথায় টেলিভিশনে ক্লাস শুরু করা হয়। অনলাইন ক্লাস অস্বীকার করার সুযোগ নেই। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমেও গুরুত্ব দিতে হবে।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার যে মোক্ষম সময়- সেটাই এখন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চারা এখন আর বইয়ের কাছে যায় না। শহরের অভিভাবকরা হয়ত নানাভাবে সন্তানদের লেখাপড়ার মধ্যে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু গ্রামের পরিস্থিতি আরও খারাপ। এখন কেউ যদি স্কুলপড়–য়া ছেলেমেয়েদের দিয়ে কোনো কাজ করিয়ে সামান্য আয়ের মুখ দেখে তা হলে তাকে আর স্কুলে পাঠাবে না। তিনি আরও বলেন, এই মহামারীতে শুধু শিশুরাই নয়, একটা প্রজন্মই পথ হারিয়ে যাচ্ছে।

বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, করোনা মহামারী বৈশ্বিক সমস্যা। সব দেশ তাদের অর্থনীতি, শিক্ষাসহ অন্য খাতগুলো কীভাবে পুনরুদ্ধার করবে তার একটা পরিকল্পনা নিচ্ছে, নিয়েছে। বাজেট বরাদ্দ দিচ্ছে। আমাদের শিক্ষার যে ক্ষতি হলো, হচ্ছে- এর পুনরুদ্ধারে কী হবে? এখন কী করা উচিত- এ নিয়ে আমি খুব হতাশ। সরকার শিল্পখাতে প্রণোদনা দিয়েছে- এটি রাষ্ট্রের জন্য বড় ইস্যু। কিন্তু শিক্ষা খাত কি বড় ইস্যু নয়? তা হলে এ খাতে কেন প্রণোদনা দেওয়া হলো না। একজন শিক্ষক কেন তার ৪০-৫০ জন শিক্ষার্থীকে রোজ ফোন দেবেন? তাকে কী সরকার বলেছে এ বাবদ আপনাকে সরকার প্রণোদনা দেবে। বেসরকারি শিক্ষকরা তো এখন বেতনই পায় না। তা হলে সরকারের কি আদেশ-নির্দেশ দিয়েই দায়িত্ব শেষ? তিনি আরও বলেন, নামকাওয়াস্তে টেলিভিশন ক্লাস হয়েছে। এটি কতটুকু মানসম্মত হয়েছে। শিক্ষকদের দক্ষতার জন্য কত টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অনলাইন ক্লাস যদি শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় করা না হয়, তা হলে মুখ ফিরিয়ে নেবে শিক্ষার্থীরা, তা-ই হয়েছে। এখন ভাববার সময় এসেছে- সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাজেট দিয়ে সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি পুনর্বিন্যাস করে শিক্ষার্থীদের শিখনপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে ধারাবাহিকভাবে অ্যাসাইনমেন্ট বা নির্ধারিত কাজের মাধ্যমে মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই অ্যাসাইনমেন্ট মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অর্জিত শিখনফল সবলতা বা দুর্বলতা চিহ্নিত করে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখন শিক্ষার্থীরা যদি বাড়ির বাইরে সময় কাটায় আর অভিভাবকরা তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন, সরকার কী করে কোটি কোটি শিক্ষার্থীর বাড়িতে থাকা বা শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপনে বেঁধে রাখবে? এরপরও আমরা শিক্ষকদের বলছি, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখতে। তাদের লেখাপড়া বিষয়ে খোঁজখবর নিতে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম বলেন, অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। শিক্ষার্থীরা যাতে পাঠ্যবই অধ্যয়ন করে, অভিভাবকদের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বলা হয়েছে। সরকারের এ আদেশ কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন অতিমারী চলছে। আমরা প্রান্তিক পর্যায়ে খোঁজ নেব।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877