ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ:
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশসহ পৃথিবীজুড়ে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে অন্তত ৪০টি বজ্রপাত হয় বলে আন্তর্জাতিক গবেষণায় উঠে এসেছে। পৃথিবীর বজ্রপাতপ্রবণ অঞ্চলের একটি বাংলাদেশ। এ অস্বাভাবিকতার কারণ- বায়ুমণ্ডলে কালো মেঘ বেড়ে যাওয়া। কালো মেঘ সৃষ্টির পেছনে বাতাসে নাইট্রোজেন ও সালফারের পরিমাণ বাড়াকেই দায়ী করছেন বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে ৮০ লাখ বজ্রপাত সৃষ্টি হয়। উন্নত দেশগুলোতেও একসময় বজ্রপাতে বহু মানুষের মৃত্যু হতো। কিন্তু তারা বজ্রনিরোধক খুঁটি বা পোল স্থাপন করা, মানুষকে সচেতন করায় ক্ষতি কমিয়ে এনেছে। এর আগে বৈজ্ঞানিক তথ্যভিত্তিক ব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাভিত্তিক সচেতনতা সৃষ্টি করেছে উন্নত দেশগুলো। এতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের দেশগুলোসহ পূর্ব-এশিয়ায় বজ্রপাতে হতাহতের সংখ্যা বহুলাংশে কমেছে। যদিও বজ্রপাত সম্পর্কে অনেক কল্পকাহিনী প্রচলিত, বিজ্ঞানের কল্যাণে বজ্রপাতের কারণ পরিষ্কার হয়েছে। সহজ ভাষায় বায়ুমণ্ডলে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জের গঠন ও পৃথকীকরণে বজ্রপাত সংঘটিত হয়। সারা বছরের হিসাবে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত সংঘটিত হয় ভেনিজুয়েলার মারাকাইবো হ্রদে। অন্য দিকে আফ্রিকার কঙ্গো অববাহিকার অবস্থান দ্বিতীয়।
বজ্রপাত একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও বর্তমানে এর ব্যাপকতা জনজীবনকে ভাবিয়ে তুলছে। ক্ষতি নিয়ে এখন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ কিংবা ডাটাবেইজ তৈরিতে কর্তৃপক্ষ তৎপর। ২০১১ সালের পর থেকে এর প্রবণতা ক্রমাগতভাবেই বেড়ে চলছে। যেমন- ২০১৫ সালে ৯৯ জন, ২০১৬ সালে ৩৫১ জন ও ২০১৭ সালে ২৬২ আর ২০১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ৫৭ জনের মৃত্যু, ২০২১ সালে মে পর্যন্ত ১৬ জনের মৃত্যু ও চার শতাধিক আহত হওয়ার খবর রয়েছে, যা গ্রামাঞ্চলে ফসলের মাঠে, পুকুরের পাড়ে ও হাওরে বেশি সংঘটিত হচ্ছে।
বজ্রপাতে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২৫০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর, বুয়েট, দুর্যোগ ফোরাম, গণমাধ্যমসহ একাধিক তথ্য মতে, বজ্রপাতে ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল পর্যন্ত দুই হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। এত বেশি মৃত্যুহারের জন্য আমাদের অসচেতনতাকেই দায়ী করছেন বিশ্লেষকগণ। তারা বলেছেন, বজ্রপাত সম্পর্কে দেশের প্রান্তিক ও নিরক্ষর জনসাধারণের সঠিক ধারণা না থাকার দরুন মৃত্যুহার বেশি। ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাতের সময়ও এ দেশের লোকজন খোলা মাঠে কাজ করে। বিশেষ করে হাওর অঞ্চলের কৃষক ও জেলে সম্প্রদায়।
দেশী-বিদেশী গবেষণা বলছে, দেশে গত কয়েক বছরে কালবৈশাখীর পাশাপাশি বজ্রপাত বেড়েছে। বজ্রপাতে মৃত্যু নিয়ে একক কোনো কারণ চিহ্নিত করতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। অনেকটাই ধারণানির্ভর তথ্য তারা মনে করছেন, তাপমাত্রা ও বাতাসে সিসার পরিমাণ বৃদ্ধি, জনজীবনে ধাতব পদার্থের ব্যবহারের আধিক্য, মোবাইলফোন ব্যবহার ও এর টাওয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি, বনভূমি বা গ্রামাঞ্চলে উঁচু গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস, জলাভূমি ভরাট ও নদী শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বজ্রপাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আর এসব ক’টির সাথে জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের সম্পর্ক আছে। বিশ্বখ্যাত সায়েন্স পত্রিকার নিবন্ধে ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বজ্রপাতের আশঙ্কা ১২ শতাংশ বেড়ে যায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আবহাওয়া সম্পর্কিত দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বজ্রপাত। প্রযুক্তির ব্যবহার করে বজ্রপাতে মৃত্যু কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে, তবে সচেতনতা এবং সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। এখনই এই দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এটি স্থায়ী হতে পারে।
বজ্রপাতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হিসাবে- এক. দেশের বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলো শনাক্ত করতে হবে আবহাওয়া জরিপের ভিত্তিতে। বর্তমানে গণমাধ্যমের বদৌলতে আমরা যেসব তথ্য পাই তা থেকে দেখা যায় যে, দেশের ১৪টি জেলা বজ্রপাতের ঝুঁকির আওতায় রয়েছে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের নাম সবার আগে। এলাকার মানুষকে বার্তাটি দেয়ার দায়িত্ব কার? অবশ্যই সরকারের। তবে স্থানীয়ভাবে কর্মরত সামাজিক সংগঠনগুলোর দায়িত্বও কম নয়। যেহেতু মার্চ থেকে মে পর্যন্ত এই বজ্রপাতের প্রকোপ খুবই বেশি। তাই বিভিন্নভাবে প্রচারণা, সতর্কীকরণ, সামাজিক সভা ও মাইকিং করা যেতে পারে। যেসব বিষয় এতে স্থান পাবে তা হলো বজ্রপাতের সময় পাকা ভবনের নিচে আশ্রয় নেয়া, উঁচু গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি থেকে দূরে থাকা, বাড়ির জানালা থেকে দূরে থাকা, ধাতব বস্তু স্পর্শ না করা, বিদ্যুৎচালিত যন্ত্র থেকে দূরে থাকা, গাড়ির ভেতরে না থাকা, পানি থেকে দূরে থাকা, বজ্রপাতের আশঙ্কা দেখা দিলে নিচু হয়ে বসা, রাবারের জুতো ব্যবহার করা, বজ্রপাতজনিত আহত ব্যক্তিদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। জলবায়ু পরিবর্তন, বনভূমির পরিমাণ হ্রাস, বড় বড় গাছ কর্তন ও বৈদ্যুতিক বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণে বজ্রপাত ও এর ক্ষতি দু’টিই বেড়েছে। একটি দেশের আয়তনের এক-চতুর্থাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন, কিন্তু আমাদের দেশে সামাজিক বনভূমির পরিমাণ হিসাবে আনলেও তা কোনোভাবেই ২৫ শতাংশ হয় না। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে বনভূমির পরিমাণ বাড়াতে হবে। প্রকৃতির সাথে সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে সখ্য গড়ে তুলতে হবে।
বজ্রপাতে নারীদের তুলনায় কর্মক্ষম পুরুষের মৃত কিংবা আহতের সংখ্যাই বেশি, যা সামাজিকভাবে একটা দুশ্চিন্তার কারণ। এসব পরিবারকে পুনর্বাসনের দায়িত্ব সরকারের। এর জন্য বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। চাকরির ক্ষেত্রেও এই পরিবারের প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। তৃতীয়ত: মাঠে ঘাটে কিংবা জলাধারে মৎস্য শিকারের সময় বেশি মানুষ দুর্ঘটনায় পতিত হয়; বিশেষত হাওরের এসব জায়গায় মুঠোফোনের টাওয়ার লাইটেনিং এরস্টোর লাগিয়ে বজ্রপাতের ঝুঁকি কমানো যায় । কারণ গত কয়েক বছরে প্রায় চার হাজার নারী-পুরুষ বজ্রপাতের কারণে আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। তাদের বেঁচে থাকতে ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও করতে হবে। বজ্রপাতে মৃতদের মধ্যে নারী, শিশু, প্রবীণের তুলনায় কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। দুনিয়ার তাবৎ দুর্যোগে যখন প্রবীণ, নারী, শিশুদের লাশের মিছিল সবচেয়ে লম্বা থাকে সেখানে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মারা যায় পরিবারের সবচেয়ে কর্মঠ মানুষটি। এই দুর্যোগের এটি আরেকটা ভয়াবহ দিক। পরিবারের একমাত্র রোজগেরে চলে গেলে অন্যদের জীবন যে কী দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ অনুধাবন করতে পারবে না। ২০১৬ সালে বজ্রপাতে নিহত ৩৫১ জনের মধ্যে ২২০ জনই ছিলেন পরিবারের একমাত্র রোজগেরে। ২০১৭ সালে নিহত ২৬২ জনের মধ্যে ২০০ জনই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। বজ্রপাতে আনুপাতিক হারে কর্মক্ষম পুরুষ মৃত্যুর হার যুক্তরাষ্ট্রেও বেশি। গত বছর সেই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম মানুষ বজ্রপাতে মারা যায়। মাত্র ১৬ জন। তাদের ১৫ জনই ছিলেন পুরুষ। মাঠে কৃষিকাজ, মাছ ধরা বা নৌকায় করে যাতায়াতের সময় বজ্রপাতে অধিকাংশ মানুষ মারা যায় বলে মৃতদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রে বজ্রপাতে আগে যেখানে বছরে ৪০০-৪৫০ জন মারা যেত, সেখানে এখন মারা যায় ২০-৪০ জন। গবেষকরা বলছেন, নগরায়ণের ফলে এটা সম্ভব হয়েছে। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি মানুষ নগরে থাকছে। বিদ্যুতের লম্বা খুঁটি মানুষের উচ্চতার অনেক ওপরে থাকায় আর খুঁটির সঙ্গে আর্থিংয়ের ব্যবস্থা বজ্রপাত থেকে মানুষের জীবনহানি রোধ করে। ক্ষতি হয় বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির। বড় বড় গাছ ধ্বংস করে ফেলায় আমাদের গ্রামাঞ্চল অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। গ্রামের জমিদারবাড়ির ছাদে, মন্দিরের চ‚ড়ায় কিংবা মসজিদের মিনারে যে ত্রিশূল বা চাঁদ-তারা দিয়ে আর্থিং করা থাকত, সেটাও বজ্রপাতের প্রাণহানি থেকে মানুষকে রক্ষা করত। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের হাওর অঞ্চল (সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া), সাতক্ষীরা-যশোরের বিল অঞ্চল আর উত্তরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও দিনাজপুর অঞ্চলে বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা বেশি ঘটে। গত বছর প্রায় ৫৭ শতাংশ মানুষই মারা যান মাঠে অথবা জলাধারে (নদী, খাল ও বিল) কাজ করার সময়। এসব অঞ্চলে মুঠোফোনের টাওয়ার লাইটেনিং এরস্টোর লাগিয়ে বজ্রপাতের ঝুঁকি কমানো যায়। মুঠোফোন কোম্পানিগুলো করপোরেট দায়িত্বের অংশ হিসেবে কাজটি করতে পারে। পল্লী বিদ্যুৎ ও সীমান্তরক্ষীদের সব স্থাপনায় কমবেশি এটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
বজ্রপাত থেকে বাঁচতে সচেতনতার বিকল্প নেই। সতর্ক হলে মৃত্যুর সংখ্যা কমানো যেতে পারে। দুঃখজনক সত্যটি হলো, বাংলাদেশে বজ্রপাতের ওপর তেমন কোনো গবেষণা নেই। তবে ইউরোপ, জাপান ও আমেরিকায় বিষয়টি নিয়ে বড় বড় গবেষণা চলছে। আমাদের দেশে সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করলেও এর ঝুঁকি প্রশমনে দৃশ্যমান উদ্যোগ কম। বাংলাদেশে বজ্রপাতের পূর্বাভাস ও এলাকা শনাক্তকরণ যন্ত্র স্থাপন করা এখন সময়ের দাবি। কিন্তু সরকার বেশ কয়েকটি স্থানে বজ্রপাত পূর্বাভাস যন্ত্র বসালেও এর ফোরকাস্টিংয়ের ব্যবস্থা এখনো করতে পারেনি। এ জন্য আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। আবার বজ্রপাতের ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রাথমিক পর্যায়ে সারা দেশে ৫০ লাখ তালগাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিলেও এটিও খুব একটি কার্যকর নয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর, বুয়েট, দুর্যোগ ফোরাম, গণমাধ্যমের তথ্য ও একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হিসাব মতে, গত ছয় বছরে সারা দেশে বজ্রপাতে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। বজ্রপাতের এমন আচরণই বলে দিচ্ছে মানবজাতির কার্যক্রমের ওপর প্রকৃতি কতটা নাখোশ। মানুষের অধিক চাহিদা আর লোভে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্টের খেসারত হিসেবে প্রকৃতির প্রতিশোধ কি বজ্রপাত- বিষয়টি নিয়ে এখন গভীরভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে।
লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি