শনিবার, ২৫ মে ২০২৪, ০৩:০৬ অপরাহ্ন

‘মেরুদণ্ড’ গড়ছেন বেতন ছাড়াই

‘মেরুদণ্ড’ গড়ছেন বেতন ছাড়াই

স্বদেশ ডেস্ক:

শিক্ষক যখন ভ্যানচালক, ফল বা তরকারি বিক্রেতা কিংবা রাজমিস্ত্রির জোগালি, তখন লজ্জিতই হতে হয়। কারণ তারাই তো জাতির মেরুদণ্ড তৈরির কারিগর। আজ তাদেরই শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ানোর জো নেই। করোনা দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি সংকটে শিক্ষার্থীদের বেতনের ওপর নির্ভরশীল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। ৯ মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকায় বেতন পাচ্ছেন না শিক্ষকরা। তাই পেটের টানে লজ্জার আবরণ সরিয়ে রাস্তার ধারে ফল কিংবা সুরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রি করতেও দেখা যায় অনেককে।

আবার লকডাউনকালে অন্ধকারে মুখ ঢেকে খাবারের জন্য হাত পাততে বাধ্য হন কেউ কেউ। নিরুপায় হয়ে আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছেন কয়েক শিক্ষক। ভাড়া দিতে না পেরে বিদ্যালয় বিক্রির বিজ্ঞাপনও বিদ্ধ হয়েছে কোমল হৃদয়। তবু জীবন-জীবিকার লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষাগুরুরা। নিজের প্রাপ্তির জন্য দিনের পর দিন পদস্থদের দ্বারে দ্বারে দিয়ে যাচ্ছেন ধরনা। কিন্তু কে শুনে কার কথা! উল্টো জেঁকে বসেছে চাকরি হারানো শঙ্কা।

‘শিক্ষকদের বেতন নিশ্চিত না করলে বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের অধিভুক্তি বাতিল করা হবে’Ñ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এমন নোটিশে আতঙ্কে দিন কাটছে এই স্তরের প্রায় সাড়ে চার হাজার শিক্ষকের। তারা বলছেন, বেতনের নিশ্চয়তা না দিয়ে, উল্টো চাকরিটা নিয়েই যেন চলছে টানাটানি। ভুক্তভোগী শিক্ষকরা বলছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির শর্তে বলা ছিলÑ অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের কলেজ কর্তৃপক্ষ বেতনভাতা পরিশোধ করবে। সেই শর্ত মেনেই শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে ওইসব কলেজে চালু করা হয় অনার্স কোর্স।

কিন্তু করোনারকারণে দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খোলায় বন্ধ রয়েছে আয়-রোজগার। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছে না বেসরকারি কলেজগুলো। এ পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি দেশের প্রায় সাড়ে তিনশ বেসরকারি কলেজকে অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের বেতন নেওয়ার নির্দেশ দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শন দপ্তর। আর এতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের হুশিয়ারি দেওয়া হয় সেই নির্দেশনায়। সেই নোটিশ পাওয়ার পর উল্টো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন শিক্ষকরা। তাদের দাবিÑ অধিভুক্তি বাতিল হলে তো শিক্ষকদের চাকরিটাই আর থাকবে না। এ প্রসঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান বলেন, ‘শিক্ষকদের বেতন নিশ্চিত করতে কলেজগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেসব কলেজ বেতন দেবে না, তাদের অধিভুক্তি বাতিল করা হবে। মনিটরিং করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জানা যায়, সাত বছর আগে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (পিএমও) এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছিল। পিএমওর নির্দেশনা অনুযায়ী, শিক্ষা মন্ত্রণালয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দেয়। তাতে অনার্স-মাস্টার্স স্তরে নিয়োগ দেওয়া শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির আগে শিক্ষা আইনে অন্তর্ভুক্ত করে বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে মতামত চাওয়া হয়। কিন্তু গত সাত বছরেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে কোনো সুপারিশ করেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি। তবে শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষকে ২০১৬ সালে এবং করোনা মহামারী শুরুর পর চিঠি দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ গত ১৩ জুন নতুন করে চিঠি দিয়ে বলা হয়Ñ অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের বেতন না দিলে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অধিভুক্তি বাতিল করবে। এক শিক্ষক বলেন, ‘এর আগে বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তর উঠিয়ে দেওয়ার আলোচনায় এমনিতেই আমরা চাকরি হারানোর শঙ্কায় আছি। এখন নতুন করে যোগ হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই নোটিশ। এতে কলেজ কর্তৃপক্ষের কোনো সমস্যা না হলেও চাকরি নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন আমার মতো সব শিক্ষকই।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক হারুন-অর-রশিদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘শিক্ষকদের পক্ষ থেকে বেতনের দাবি করে গত ১৩ জুন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়। ওই দিনই কলেজ কর্তৃপক্ষকে নোটিশটি জারি করা হয়। কিন্তু এই নোটিশের পর থেকে উল্টো নিজেদের চাকরি নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন শিক্ষকরা।’

বাংলাদেশ নিগৃহীত অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মিল্টন ম-ল বলেন, ‘২৯ বছর ধরে কলেজ কর্তৃপক্ষ কোনো বেতনভাতা দেয়নি, নামমাত্র কিছু সম্মানী দেওয়া হয়েছে কেবল। করোনার সময় সেটিও বন্ধ। দীর্ঘদিন আন্দোলন করে বেতন দাবি করলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যলয় কর্তৃপক্ষও কোনো সাড়া দেয়নি। কার্যকর পদক্ষেপও নেয়নি। এই প্রথমবার শক্ত পদক্ষেপ হিসেবে নোটিশ করা হলেও তা শিক্ষকদের চাকরির অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে। কেননা কলেজ কর্তৃপক্ষ অধিভুক্তি বাতিলের এই ভয়ে বেতন দেবে বলে মনে হয় না। বরং শিক্ষকদের সম্মান বাঁচাতে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে বেতন চাওয়াই বন্ধ করে দিতে হবে।’ মিল্টন ম-ল আরও বলেন, ‘আগে ইচ্ছে করেই বেতন দেয়নি বেশিরভাগ কলেজ। আর এখন তো করোনার কারণে তারা টিউশন ফি আদায় করতে পারছে না। তাই কলেজগুলো অনার্স-মাস্টার্স স্তরের অধিভুক্তি রক্ষার জন্য শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার কথা ভাবছেও না। তাই কলেজ কর্তৃপক্ষ বা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে অধিভুক্তি বাতিলের নোটিশ শিক্ষকদেরই বরং আতঙ্কিত করেছে।’

বেসরকারি স্কুল-কলেজ জনবল কাঠামো অনুযায়ী, ডিগ্রি স্তর পর্যন্ত এমপিওভুক্ত কলেজে ১৯৯৩ সালে অনার্স-মাস্টার্সের অনুমোদন দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বিধিবিধান অনুযায়ী, নির্ধারিত স্কেলে কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের মূল বেতন দেওয়ার শর্তে এই অনুমোদন মেলে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় টিউশন ফি থেকে শিক্ষকদের বেতনভাতা দেওয়ার নির্দেশনা দেয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কলেজগুলোর জনবল কাঠামোতে স্থান পায়নি অনার্স ও মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের পদ। ফলে সরকারি বিধিবিধানের আলোকে এমপিওভুক্ত হওয়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয় তারা। এ কারণে শিক্ষকরা ২৯ বছর ধরে বেতনভাতা নিশ্চিতের আন্দোলন করে আসছেন।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877