ড. রাহমান নাসির উদ্দিন: ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন বলেছিলেন, জ্ঞানই আলো। কেননা, শিক্ষার দার্শনিক ভিত্তি হচ্ছে : শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে। আর একজন সত্যিকার শিক্ষক আলোর বাতিঘর। কেননা, একজন সত্যিকার শিক্ষকই পারেন মানুষের মন-মনন-মানসিকতা, চিন্তা-চেতনায় আলোর আভা ছড়াতে এবং প্রকৃতার্থে মানুষকে আলোকিত করতে। মানুষ প্রাণী হয়ে জন্ম নিলেও দীর্ঘ সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে সে প্রাণিত্ব বা পশুত্ব পরিহার করে সত্যিকার মানুষ হয়ে ওঠে। এবং এই মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন শিক্ষক। তাই সমাজ এখনও শিক্ষকদের যথেষ্ট সম্মানের জায়গায় বসায়। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) ইংরেজি বিভাগের উপদেষ্টা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদকে যেভাবে কিছু শিক্ষার্থী শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়েছে (ভাগ্যিস আগুন লাগাতে পারেনি), তাতে অবাক বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেছি। সমাজ আজ বর্বরতার কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, কিছু শিক্ষার্থী মিলে একজন শিক্ষককে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে এবং গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মারতে উদ্যত হয়। এ ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। এ ঘটনাই প্রমাণ করেÑ প্রাণিত্বকে (পশুত্ব) আমরা খুব একটা বেশি বর্জন করতে পারিনি। অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের গায়ে কেরোসিন ঢালার খবর পাওয়ার পর থেকে নিজের গায়ে কেবলই কেরোসিনের গন্ধ পাচ্ছি তাই, এ নিবন্ধ সে কেরোসিনের গন্ধ থেকে মুক্তির কিঞ্চিৎ চেষ্টামাত্র।অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই এ ঘটনা বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষিত মহল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, পেশাজীবী হিসেবে শিক্ষকদের নিজস্ব ঘরানা এবং জনপরিসরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সঙ্গে সঙ্গে পেশাজীবী হিসেবে শিক্ষকের মর্যাদা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা নিয়েও নতুন সওয়াল-জবাব শুরু হয়েছে এবং এ ঘটনার কারণে আশপাশে খানিক হা-হুতাশও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। সমাজের এ তীব্র প্রতিক্রিয়ার মূল কারণ হচ্ছে সমাজে এখনও শিক্ষকের মর্যাদা খানিকটা হলেও বিদ্যমান। কেননা, আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে কোনো শিক্ষকের শিক্ষার্থী ছিলাম বা আছি। ফলে, একজন প্রবীণ অধ্যাপক যখন কতিপয় শিক্ষার্থী কর্তৃক শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত, তখন সমাজের বিদ্যমান মূল্যবোধের গায়ে একটা শক্ত আঘাত লাগে। একজন প্রবীণ অধ্যাপকের গায়ে যখন কিছু শিক্ষার্থী কোরোসিন ঢেলে দেয়, তখন সমাজের বিদ্যমান আত্মসম্মানবোধ খানিকটা হোঁচট খায় বৈকি। তাই, অধ্যাপক মাসুম মাহমুদের গায়ে কেরোসিন ঢালার ঘটনায় সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়।
এখানে মনে রাখা জরুরি, দিল্লির বাদশা আলমগীরের সন্তান শিক্ষকের পায়ে পানি ঢেলেছিল বলে বাদশা শিক্ষককে ডেকে তিরস্কার করেছিলেন এই বলে, আপনি তো আমার ছেলেকে আদব-কায়দা কিছুই শেখাননি যদি তা শিখত তাহলে সে আপনার পায়ে শুধু পানি ঢালত না; পায়ের ময়লাও পরিষ্কার করে দিত। কাজী কাদের নওয়াজের শিক্ষকের মর্যাদা কবিতায় শিক্ষকের মর্যাদার যে প্রতীকী রূপকল্প তৈরি করা হয়েছে, শিক্ষকের সে মান-মর্যাদা আজকের দিনে হয়তো অকল্পনীয়। কিন্তু সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা এখনও একেবারে হাওয়ায় উড়ে যায়নি কিংবা পানিতে ডুবে যায়নি। সে কারণে কিছুদিন আগেও একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা কর্তৃক একজন প্রধান শিক্ষককে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠ-বস করানোর ঘটনায় সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ নিজের কান ধরে ওঠ-বস করে শিক্ষকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে এবং এ রকম ঘৃণ্য কাজের তীব্র প্রতিবাদ করেছে। এগুলো হচ্ছে উপসর্গ, যা সমাজে শিক্ষকের জায়গা এখনও একটা মর্যাদাকর স্থানে রাখা আছে, তাকে প্রতীকী প্রতিভাত করে।
লেখা বাহুল্য, শিক্ষকের মর্যাদা বিষয়ে জাতিসংঘে ১৯৬৬ সালে একটি সার্বজনীন গ্রহণযোগ্য সনদ স্বাক্ষরিত হয়, যা শিক্ষকের মর্যাদা বিষয়ক ইউনেস্কো এবং আইএলও সনদ নামে পরিচিত। বিশ্বব্যাপী শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষার জন্য জাতিসংঘ এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। সনদ তৈরি করে শিক্ষকের মর্যাদা কতটা সুরক্ষিত হয়, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু আমার ধারণা, বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর এ সনদ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। ধারণা থাকতেই হবেÑ এমন কথাও নেই। ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষকের মর্যাদা মূলত সমাজ-সংস্কৃতির বিবর্তমান অংশ হিসেবে এতদঞ্চলে বেড়ে উঠেছে। গুরুভক্তি শিক্ষকের মর্যাদার মূল সূত্র। কেননা, গুরুকে ভক্তি করা আমাদের সমাজে শিক্ষার অন্যতম উপাত্ত। তাই শিক্ষকের মর্যাদা দীর্ঘদিনের সামাজিক অনুশীলনের ভেতর দিয়ে প্রজন্ম পরম্পরায় সমাজের অভ্যন্তরে একটি শক্ত-মজবুত মূল্যবোধ হিসেবে আমাদের সমাজ-জীবনে বিদ্যমান। কিন্তু ইউএসটিসির ঘটনা সে মূল্যবোধের ঠুনকো ফানুসকে উন্মোচিত করে।
তবে সঙ্গে সঙ্গে এটাও অনস্বীকার্য, সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা ক্রমেই পতনশীল। সে জন্য কি শুধুই সমাজ দায়ী বা শিক্ষার্থীরাই দায়ী? যদি পাইকারি হারে সমাজের অধঃপতনকে শিক্ষকের প্রতি সমাজের মর্যাদা হ্রাসের কারণ হিসেবে দায়ী করি, তা হবে নির্ভেজাল পক্ষপাতদুষ্ট বিবেচনা। কেননা, শিক্ষক নিজেরাই কি খানিকটা এ মর্যাদাহানির জন্য দায়ী নয়? এখানে মনে রাখা জরুরি, মর্যাদা কোনো কম্পিউটার প্রোগ্রামিং অপশন নয় যে, শতাব্দীর পর শতাব্দী এবং দশকের পর দশক ধরে তা বাই-ডিফল্ট এনাবল বা স্বয়ংক্রিয় করা থাকবে। আজকের দিনের শিক্ষক আর দিল্লির বাদশা আলমগীরের যুগের শিক্ষকের মধ্যে বিস্তর ফারাক। সক্রেটিসও শিক্ষক ছিলেন। শুধু নামে নয়; জ্ঞান-গরিমা, নৈতিকতা, আদর্শ এবং কথা-কাজে সত্যিকার শিক্ষক, যিনি নিজের দর্শন ও আদর্শের জন্য হাসিমুখে হ্যামলক পান করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাই, সক্রেটিসকে বলা হয় শিক্ষকদের শিক্ষক।
কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, আজকে আমরা যারা শিক্ষক, তারা মর্যাদা নিজেরাই খানিকটা ক্ষুণœ করেছি। ছাত্রী ধর্ষণ (সম্প্রতি গায়ে আগুন দিয়ে নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা), মেয়ে শিক্ষার্থীদের নানা যৌন হয়রানি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষায় নানা অনিয়ম, ক্রমবর্ধমান অপেশাদারি মনোভাব, নিজ দায়িত্বে নিত্য অবহেলা, দৃশ্যমান নৈতিক অবক্ষয়, বেশুমার এনজিওবাজি, নির্লজ্জ দলবাজি, ক্ষমতা- কেন্দ্রের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ এবং প্রাপ্ত ক্ষমতার অশোভন ব্যবহার প্রভৃতি শিক্ষকদের মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার পক্ষে কোনোভাবেই কাজ করে না। এটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য। শিক্ষার্থীরাই শিক্ষকদের সবচেয়ে কাছ থেকে দেখা ও শিক্ষকের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পায়। শিক্ষকদের ব্যক্তিগত নৈতিকতা, আদর্শ ও পেশাদারিত্ব একজন শিক্ষার্থী যখন খুব কাছ থেকে দেখে, তখন তার ভেতর শিক্ষকের জন্য কোনো মর্যাদা জাগ্রত হয় না। বরং এক ধরনের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা তৈরি হয়ে তা শিক্ষার্থীর মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। সেটাই ক্রমান্বয়ে সমাজে সংক্রমিত হয়। এভাবে সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা ক্রমান্বয়ে লোপ পেয়েছে বা পাচ্ছে। তাই, শিক্ষকের মর্যাদা যে সমাজে ক্রমহ্রাসমান, এ জন্য শুধুই সমাজকে এবং ক্রমপতনশীল সামাজিক মূল্যবোধকে দায়ী করা যাবে না। খোদ শিক্ষকরাও তার জন্য খানিকটা দায়ী।
তবে, শিক্ষকের মর্যাদাহানির এ ব্যাখ্যাকে বা শিক্ষকের মর্যাদাহানিতে শিক্ষকের নিজেদের ভূমিকার উপরোক্ত আলোচনাকে কোনোভাবেই একটি সার্বজনীন চিত্র হিসেবে গণ্য করা যাবে না। বরং, এটা বলা অধিকতর সমীচীন হবে, দেশের বেশির ভাগ শিক্ষক এখনও শিক্ষকতাকে একটি মহান পেশা হিসেবে ভাবেন, মানেন এবং সে মোতাবেক নিজেদেরকে সব লোভ-হিংসা-অহঙ্কার-অন্যায়-অন্যায্যতার ঊর্ধ্বে রেখে জ্ঞান বিতরণের মহান দায়িত্বে ব্রত রেখেছেন। বিপথগামী শিক্ষকের সংখ্যা খুবই নগণ্য। এরা প্রধানত এবং মূলত চাকরিজীবী। শিক্ষকতা এদের কাছে স্রেফ একটা চাকরি। আর দশটা চাকরির মতো জীবিকা নির্বাহের একটি উপায় মাত্র। কিন্তু শিক্ষকতা যে এক মহান পেশা, প্রজন্মের পর প্রজন্ম তৈরির একটি মিশন, একটি নিত্য সেবা প্রদানকারী মহৎ কাজÑ তা এসব লোক কখনোই মন-মনন ও চিন্তায় ধারণ করেন না। ফলে, এসব শিক্ষক নামের সনাতন চাকরিজীবীকে শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লাখ লাখ নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষককে একই পাল্লায় মাপা যাবে না। যেমনটি মাপা যাবে না অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদকে।
অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে জীবনের ৬৫ বছর পর্যন্ত অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করেছেন। একজন জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে তিনি অত্যন্ত সুপরিচিত। ইংরেজি সাহিত্যে পা-িত্যের জন্য অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ সর্বজনবিদিত। তার মানের একজন শিক্ষক ইউএসটিসির মতো একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেনÑএটা শিক্ষার্থীদের জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয় হওয়া কাক্সিক্ষত ছিল। কিন্তু তাকে কিছু শিক্ষার্থী যেভাবে অপমান, অসম্মান ও অমর্যাদা করেছে, তা শিক্ষক সমাজের জন্য যেমন অপমানের, তেমনি শিক্ষার্থী সমাজের জন্যও লজ্জার। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের যে অসম্ভব পবিত্র একটি দিক আছে; এ ঘটনা সে দিকটিকে কলঙ্কিত করেছে নিঃসন্দেহে। শিক্ষার্থীরা একজন শিক্ষকের সঙ্গে এ ধরনের অশোভন ও লজ্জাকর আচরণ কেন করেÑ তার সমাজ মনস্তত্ত্ব গভীরভাবে বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। ক্রমবর্ধমান পুঁজির আগ্রাসন, মুনাফামুখী সামাজিক গতিশীলতা, ক্রমহ্রাসমান সামাজিক মূল্যবোধ, আত্মপর বিকাশমান ব্যক্তি-মনস্তত্ত্ব, ক্রমবর্ধমান লুটেরা মনোবৃত্তি, ক্রমভঙ্গুর সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি, বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বেয়াড়া পরিবৃদ্ধি এবং শিক্ষার্থী নয় পরীক্ষার্থী বানানোর বিদ্যমান শিক্ষা-কাঠামো প্রভৃতি বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। অন্যথায়, সমাজ কাঠামো টিকিয়ে রাখার ন্যূনতম সুতোটিও আর অটুট থাকবে না। খুব সহসাই টুটে যাবে।