স্বদেশ ডেস্ক:
‘উনিশ শতকের আশির দশকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ৮৫ বছরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সময় বহু দাবিনামা নিয়ে আন্দোলন করেছে। দাবিনামার অধিকাংশই ছিল ন্যায়সঙ্গত ও জনসমর্থিত। কিন্তু দুটি দাবিনামা এ অঞ্চলের রাজনৈতিক জীবনে এনে দিয়েছে আমূল পরিবর্তন। পাল্টে দিয়েছে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভূগোল। প্রথমটি হলো- ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রস্তাব, যার মুখ্য রচয়িতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ হলেও উত্থাপক ছিলেন শেরেবাংলা ফজলুল হক। …দ্বিতীয় দাবিনামাটি হলো ১৯৬৬-র ফেব্রুয়ারিতে উত্থাপিত বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা।’ প্রয়াত লেখক, গবেষক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবদুল মকসুদ এভাবেই তার একাধিক লেখায় লাহোর প্রস্তাব ও ছয় দফা সম্পর্কে মূল্যায়ন করেছেন।
তিনি ছয় দফা সম্পর্কে বলেছেন, ‘…তারপর রাজনীতি যে মোড় নেয়, সেটাই হয়ে ওঠে বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারা।’
আজ ৭ জুন সেই ঐতিহাসিক ছয় দফা
দিবস। যে দাবিনামা নিয়ে দলে ও দলের বাইরে অনেক বিতর্ক ওঠা সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান তার লক্ষ্যে অবিচল হেঁটেছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালের এই দিনটি ছিল একদিকে আশাজাগানিয়া, অন্যদিকে তৈরি হয় রাজনৈতিক বৈরিতা। ‘বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা’ আদায়ের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের ডাকে হরতাল চলাকালে নিরস্ত্র জনতার ওপর পুলিশ ও তৎকালীন ইপিআর গুলিবর্ষণ করে। এতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে মনু মিয়া, সফিক, শামসুল হকসহ ১১ জন শহীদ হন। শহীদের রক্তে ৬ দফা আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র; রাজপথে নেমে আসে বাংলার মুক্তিকামী জনগণ। অবিস্মরণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ দিনটিকে আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বাঙালি।
পাকিস্তানি শাসন-শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে স্বৈরাচার আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ডাকা হয় এক জাতীয় সম্মেলন। সেখানে পূর্ব বাংলার জনগণের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ফিরে ৬ দফার পক্ষে দেশব্যাপী প্রচারাভিযান শুরু করেন এবং বাংলার আনাচে-কানাচে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে জনগণের সামনে এর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। এর পর সেই ৬ দফাই হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সনদ। এর প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী সরকার ১৯৬৬ সালের ৮ মে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার রাজপথ।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ৬ দফা আন্দোলন ১৯৬৬ সালের ৭ জুন নতুন মাত্রা পায়। এর প্রতি বাঙালির অকুণ্ঠ সমর্থনে রচিত হয় স্বাধীনতার রূপরেখা। আর সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অঙ্কুরিত হয় স্বাধীনতার স্বপ্নবীজ। ৬ দফাভিত্তিক ১১ দফা আন্দোলনের পথপরিক্রমায় শুরু হয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। সর্বোপরি ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বাংলার জনগণ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে একচেটিয়া রায় দেন। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পরও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন সরকার গঠনে নির্বাচিত বাঙালি জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য গড়িমসি শুরু করে, তখনই ১৯৭১-এর ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঐতিহাসিক সেই ভাষণেও ৬ দফার মর্মবাণী উচ্চারিত হয়। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালনা এবং দেশের অভ্যন্তরে সব সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় ৬ দফার ভিত্তিতেই।
ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস উপলক্ষে এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘ঐতিহাসিক ৬ দফা কেবল বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ নয়, সারাবিশ্বের নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের মুক্তি আন্দোলনের অনুপ্রেরণার উৎস। ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণার পর শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে বারবার গ্রেপ্তার করে এবং তার ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। তা সত্ত্বেও তিনি ৬ দফার দাবি থেকে পিছপা হননি। তার নেতৃত্বে দাবি আদায়ের আন্দোলন বেগবান হয় এবং তা অল্প সময়ের মধ্যে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে।’ রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘তরুণ প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার দাবি থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে বলে আমার বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন। তার সেই স্বপ্ন পূরণে সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে আমি সবার প্রতি আহ্বান জানাই।’
পৃথক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭ জুন এক অবিস্মরণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা আদায়ের লক্ষ্যে এদিন আওয়ামী লীগের ডাকে হরতাল চলাকালে নিরস্ত্র জনতার ওপর পুলিশ ও তৎকালীন ইপিআর গুলিবর্ষণ করে। এতে ১১ জন শহীদ হন।’ তিনি বলেন, ‘ঐতিহাসিক ৭ জুনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার অক্ষুণœ রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার বদ্ধপরিকর।’
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবসকে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালন করে আসছে। কিন্তু এ বছর বৈশি^ক মহামারী করোনা ভাইরাসে সৃষ্ট সংকটের কারণে ঐতিহাসিক এই দিনটিতে জনসমাগম এড়িয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে কর্মসূচি নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। এর মধ্যে রয়েছে সূর্যোদয়ক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভবন, কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ৯টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন। বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন এবং ই-পোস্টার প্রকাশ করেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি। সেই আলোচনা অনুষ্ঠানে বিশেষ বক্তব্য দেবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
৬ দফা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমু, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও।